১লা এপ্রিল ২০১৬: হিথ্রো থেকে তার্কি কামাল আতাতুর্ক। ৩:৩০ ঘন্টার ফ্লাইট। তার্কি এয়ারক্রাফ্ট খুবই আধুনিক। তাদের সেবা এবং ব্যবহারের মান খুবই উচুঁ। আমার ছোট ছেলে মেয়ের জন্য আলাদা গিফ্ট। বাচ্চার দুধের জন্য গরম পানি বোতল পরিস্কার সহ অতিরিক্ত কেয়ার তাদের উপর ভক্তি বাড়িয়ে দিলো। মাগরিব এশা আদায় করে নিলাম কামাল আতাতুর্কের লাউঞ্জ মসজিদে। টয়লেট অজুখানা নামাজের জায়গার সুবিধা আর পরিচ্ছন্নতা তার্কিদের উন্নত মন মানসিকতার পরিচায়ক। নারী পুরুষের জন্য আলাদা ইন্তেজাম। মনে পড়ে গেল আমাদের ঢাকার এয়ারপোর্টের কথা! দুরগন্ধময় টয়লেট মশা ভর্তিহল অপরিস্কার নামাজের স্থান আমাদের দ্বীন হীনতার কথা স্মরণ করিয়া দেয়। বিমানে সেবার মানের কথা এখন থাক।
মানুষ গরীব হলে কি তার সব কিছুই গরীব হয় জানিনা। আচার ব্যবহার পরিচ্ছন্নতা কি টাকায় খরিদ করা যায়। আর উন্নত হতে হলে কি মানুষ দেখে দেখে কিছুই শিখতে পারেনা?
কিছুক্ষণের ভিতর আবার উড়াল কায়রোর পথে। আগের এয়ার ক্রাপ্টের চেয়ে কিছুটা ছোট। বোয়িং ৭৭৭ এর আলাদা মাজেজা। এই এয়ারক্রাপ্ট টেকনোলজী গোটা কটি দেশের হাতে।আমেরিকা এবং বৃটেনের হাতে সিংহভাগ। টেকনোলজি বিক্রি করে বিশ্বের রাজা তারা। আমেরিকার কথা না বলে শুধু যদি বৃটেনের কথা বলি তাহলে আগামি কয়েক প্রজন্ম তারা বিমান টেকনোলজি দিয়ে কেটে দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
ওরা কি স্বপ্নে দেখে তা অর্জন করেছে? কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যাসবায় আজ তাদের এখানে নিয়ে গেছে। আমরা কি করছি ? দা ছুরি চাকু আর রামদা দিয়ে রেখেছি ইউনির ছেলে মেয়েদের হাতে। বন্দুক পিস্তল হলো তাদের প্রিয় খেলা। শাসকদের নিকৃষ্ট দালালি ছাড়া জাতীয় ইউনির ছাত্র শিক্ষকদের আর কি কাজ? এখনতো পুরা জাতি উজাড় হওয়ার পথে। শিক্ষকরা টাকা পয়সার বিনীময়ে মেয়েদের দেহ ভোগের বিনীময়ে প্রশ্নপত্র ফাস করে দিচ্ছে। এমনকি নিজেদের প্রতিষ্ঠানের মান রক্ষার জন্য তারা প্রকাশ্যে নকলবাজি।
ভাবতে ভাবতে কায়রোতে নেমে এলো এয়ারক্রাপ্ট। কায়রো এবং ঢাকা মুদ্রার এপিট ওপিট। যদিও কৃষ্টি কালচারে আছে আলাদা পরিচয়। মোটামুটি বিনা বাধায় ২৫ ডলার করে ভিসা ফী প্রদান করে ইমিগ্রেশন পাস হলাম। লাগ্যাজ ক্লেইমে কিছুটা সময় গেল। সবকিছু একত্র করে হোটেল পীরমিড ইন’র পথে যাত্রা। শুরুতে ড্রাইভার বললো সে কায়রোর অলিগলি চিনে। এমন কি আগামিতে আরো যে কটি রাস্তা তৈরী হবে তাও নাকি তার মুখস্থ। ভাগ্যিস আরবি ভাষা জানায় কিসমতের কিল কিছুটা কম খেতে হয়েছে। রাতের ফাকা রাস্তায় শা শা করে ৩০-৩৫ মিনিটে এয়ারপোর্ট থেকে মেইন শহরে এসে পৌছুলাম। রাত আড়াইটা। হোটেল পীরামিডের নামে অসংখ্য হোটেল। প্রতি ১০ মিনিট পর এক একটি ডোরে সে নক করে তারপর যায় অন্য গলিতে। তিন থেকে চার মাইলের ভিতর আমাদের নিয়ে পুরা ২ঘন্টা ময়দানে তীহের মতো ঘুরা-ঘুরি। শেষ পর্যন্ত মনে হলো অনলাইনে হোটেল বুকিংএ হয়তো কোন ভুল আছে। সেইম রোড সেইম এরিয়া পরিস্কার এড্রেস কিন্তু সে খুজে পায়না। অবশেষে ফজরের আজান আর হোটেলের পাত্তা একসাথে।আলহামদুলিল্লাহ। আসলে ওখানে নাবালক ড্রাইভাররাও সাবালকি দেখায়। আর প্রতিটি মানুষ বাংলাদেশের মতো উৎসুক খুজে। এ যেন এক ভিখারী জাতি। বাংলাদেশ আর মিশরের মাঝে এখানে খুব মিল পেলাম। অথচ তার্কি ও ইউরোপের দেশ গুলোতে এমন পরিবেশ দেখা যায়না। হবেনা কেন। ফেরাউনের দেশে যুগে যুগে নব নব ফেরাউনের আবির্ভাব। বাংলাদেশ দখলে নিছে একটি দল আর ওখানেও একটি দল তবে তার নাম সেনা। ব্যবসা বাণিজ্য টাকা পয়সা সবকিছু তাদের দখলে। এখানে মন্ত্রী মিনিস্টাররা দেশে বিক্রি করে খাচ্ছে ওখানে মেলেটারি অফিসারদের দখলে সবকিছু। দেশের সাধরণ মানুষ খুবই গরীব। বন্দুকের নলই হচ্ছে মিশরের আইন। যে দেশে আইনের শাসন নেই সে দেশের প্রপার উন্নতি কল্পনা করা যায়?
ইসরাইল আমেরিকা এবং সৌদির যোগসাজসে মিশরের জনগণের উপর বসে আছে ২০১৬ এর বিশাল এক ফেরাউন বাহিনী। টাউট বাটপারের দেশ মিশর বললেও অত্যুক্তি হবেনা। যদিও দেশটির একটা ঐতিহ্য আছে। তাদের মুখ খোলতে মানা কথা বলতে মানা। পুলিশি একটি রাষ্ট্রে আজকের পদচারনা। একটি রাষ্ট্র যখন কারো নাগপাশে বাধা থাকে তখন এই রাষ্টের উন্নতি আগ্রগতি থাকে সুদূর পরাহত।
ফজরের নামাজ শেষে বিছানায় এলিয়ে দিলাম ক্লান্ত দেহকে। বার কয়েক ডাক এলো নাস্তার জন্য বাট ঘুমের আতিসহ্যে তা ফিরিয়ে দিলাম। অবশ্য সাড়ে এগারটার দিকে দেখলাম বিছানা আর সায় দিচ্ছেনা। আমাদের রুমের জানালা দিয়ে দেখছি পীরামিডের বিশাল উচ্চতা। এজন্য আজই পীরামিড দেখার লোভ সামলাতে পারলামনা। যেমন কথা তেমন কাজ। হোটেল প্রপাইডার সামীর একজনকে ডেকে আনলেন। তিনি নাকি গীজা বা পীরামিড এলাকা বিশেষজ্ঞ। আসলে এটা তাদের বিজনেস। অনেক কথা ও দরকষাকষির পর হাজার মিশরী পাউন্ডে রাজি হলেন পীরামিড ঘুরে দেখাবেন। তাও আবার ঘোড়ার গাড়ীতে করে। আমাকে নিকটজন বলে দিয়েছেন যে মিশনে একদামে কিছু নেই। তাই দরদাম করেই যা করার করবেন। বিদেশী দেখলে লোভের বারোমিটার তাদের একহাজারে গিয়ে লাফিয়ে উঠে। আমাদের মুহাম্মদ সহ ছয়জন। জীবনে এই প্রথম কোন ঘোড়ার গাড়ীতে উঠা। ছেলে মেয়ে বউবাচ্চা সবার মাঝে উৎসুক আনন্দ। এতো দূর পর্যন্ত এসেছি একসেকেন্ডের জন্য আমার ছেলেটা টুশব্দ করেনি। প্লেন থেকে হাইয়েস্ট অতঃপর ঘোড়ার গাড়ী। সবখানে সে যেন উপভোগ করছে। খুবই সাহসী মনে হলো তাকে। আমরা আল্লাহর নামে রওয়ানা দিলাম। দুটা ঘোড়ার গাড়ীতে করে আমরা ছয়জন।
ভাবছিলাম পীরামিডের গেইটে গিয়ে আমাদের নামিয়ে দেবে। না, ওখানে সকল তল্লাসি ও টিকেট কাটা শেষে ঘোড়ার গাড়ীতে করেই পুরো পীরামিড ঘুরা হলো। আসলে এতো উচ্চতা আর ১২মাইল এরিয়া বিস্তৃতি এই উপখ্যান দেখার জন্য পায়ে হেটে চলা মুশকিল দর মুশকিল। সুবাহানাল্লাহ। ঘোড়ার গাড়ীর চালক ও রাহবর রামাদ্বান আর আহমদের আরবী ইংরেজী মিশ্রিত কথা খুবই মধুর। সামনেই চোখে পড়লো বিশাল এক নাক ভাংগা মুর্তি। পুরুষের চেহারা নারীর চুল পিছনের দিক সিংহ। তার আশে পাশে অংখ্য সমাধি। যারা পীরামিড বানিয়েছে তাদেরকে নাকি হত্যা করে এখানে দাফন করা হয়েছে যাতে এই মমি ও পীরামিড রাহস্য দুনিয়ার অন্য কেউ জানতে না পারে। একলক্ষ দশহাজার শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই পীরামিড। ২৩ থেকে ৩০ বছর লেগেছে একেকেটি পীরামিড তৈরী করতে। কায়রো থেকে আসওয়ান হাজার মাইলের রাস্তা। আসওয়ানে নাকি ফেরাউনের মেইন মসনদ ও বিচরণ স্থল। সেখান থেকে নীলনদ দিয়ে নৌকাযোগে আনা হত বিশাল বিশাল পাথর। কত কেজি হবে একটি পাথরে? এবং কতটি পাথর ব্যবাহার হয়েছে এখানে? দুনিয়ার সকল বিশেষজ্ঞ নাকি এখনো বলতে অপারগ যে এতো বড় বিশাল পীরামিড তখনকার যুগে কিভাবে বানানো হয়েছ? ইহা একটি বিস্মকর ব্যাপার ছাড়া আর কিছু নয়? তিনটি মেইন পীরামিড বা স্মৃতিসৌধের প্রথমটি সম্রাট কিয়াফস’র আর এটা সবচেয়ে বড়। পরেরটি তারই ছেলে কেফরন’র। তারপরেরটি তারই পুত্র মিকারেনুস’র। কিয়াফস’র আশে পাশে ছোট তিনটি তার ছেলেদের। আর মিকারেনুস’র পাশের তিনটি তার স্ত্রীদের। এই পীরামিডের বয়স আজ থেকে পাঁচহাজার বছর আগের। আর তার অনতিদূরে আরেকটি আকারে ছোট কয়টি পীরামিড আছে ওখানের বয়স ৭হাজার বছর।
বড় পীরামিডের পাশে দাড়িয়ে কিছু জানা-বুঝা এবং উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম।একটন দেড়টন দুইটন ওজনের এই বিশাল পাথর একশ চল্লিশ ফুটের এতো উচ্চতায় উঠানো হলো কেমনে? আবার দেড় থেকে দুই মিলিয়ন স্টোন আসওয়ান থেকে এখানে নিয়ে আসা হলো কেমনে? আবার কোন প্রকার সিমেন্ট চুনামাটি ছাড়াই তা আটকে থাকলো কেমনে? এতো বিশাল পাথর সোজা করে কারা কিভাবে কাটলো? না ছিলো ক্রেন না ছিলো আজকের মতো আধুনিক জাহাজ! এই রহস্য কেউ এখনো ভাংতে পারেননি। কাটের নৌকা ওখানে সুসজ্জিত করে রাখা। ভিতরের সমাধি থেকে ফেরাউনের লাশ নিয়ে রাখা হয়েছে মিউজিয়ামে যা কাল দেখতে যাবো ইনশাআল্লাহ।ফেরাউন আসল নাম নয় উপাধি। আজকাল যেমন প্রেসিডেন্ড প্রধানমন্ত্রী রাাআ বাদশা কিংগ সুলতান আছেন তেমনি তাদের নেতাকে বলাহতো ফারাউ বা ফেরাউন। রহস্যের আরো একটি বিষয় হলো ৫-৬ ৭ হাজার বছর পরও দেখা যায় তাদের বডি অবিকল। এই কোন সে মেডিসিন বা পদার্থ যোগ করা হলো যার বদৌলতে লাশগুলো নিঃশেষ হয়ে যায়নি।
আমি লক্ষ করলাম ওখানের আশেপাশে অসংখ্য ঘোড়ার আস্তাবল। উট ৫ ভাগ গাধা ও ৫ ভাগ তবে ঘোড়া বলা যায় ৯০ ভাগ ওখানে বাহনের জন্য ব্যবাহার হয়। ইন্জয় করার মতো একটি পরিবেশ। ঘোড়ার উপর উঠে মনের সাধ মিটিয়ে দৌড়াতে পারবেন। তবে পড়ে যাবার আশংকায় আজ উঠিনি। এমনি একবার উটের উপর চড়ে ভয় পেলাম। ভাবতে লাগলাম সেই জামানায় সাহাবাগণের কথা।কিভাবে তারা স্বাচ্ছন্ধ্যে এই উট আর ঘোড়ায় চড়ে বিশ্বটাকে জয় করে নিয়ে ছিলেন।
পীরামিড গুলোর ভিতরে গভীরে আরেক জগত। নীচু হয়ে ঢুকতে হয়। নীচু এজন্য রাখা হয়েছে যাতে নাকি তাদের মহান নেতার এখানে সবাই যাতে মাথা নত করে সম্মান প্রদর্শন করে ঢুকে। ভিডিওতে দেখেছি অনেক। আর মাটির নীচে ওসব আবার দেখতে মন চায়নি। তবে ফুটেজে দেখেছি মৃত ব্যক্তির পাশে জীবনে যা যা জরুরত তার আরাম আয়েশের সবকিছুই তারা রেখেছিলো ওখানে। একজন ফারাউ কিংগের সম্মানের জন্য যা দরকার সবই তারা রেখেছিলো। কিছু লোট হয়েছে বাকি আছে কায়রো মিউজিয়ামে। স্বর্ণ মণিমুক্তা দামি আসবাব পত্র সবই ছিলো সাথী। তারা ধারনা করতো যে মহামান্য কিংগ একদিন আবার বেচেঁ উঠবেন; আর যাতে পুণরায় জীবিত হয়ে বাদশাহী করতে কোন অসুবিধা না হয়। পাগলের দলতো গুজরে গেছে তেব রেখে গেছে তাদের কর্মের ্ইতিহাস।
এই পীরামিডগুলো ছিলো আরো সু্ন্দর আস্তরণে ঢাকা। মুসলিম এক শাসক তা খোলে পাশেই একটি মসজিদ নির্মাণ করেগেছেন। সে কারণে কিছু কিছু পাথর লোজ হয়ে পড়ছে।