নারীর প্রতি বৈষম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি অতি পুরনো। সে তুলনায় নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলন সেদিনের। বিভিন্ন কারণে নারী তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও ইউরোপ-আমেরিকার নারীমুক্তি আন্দোলন মূলত ধর্মকেই এর জন্য দায়ী করেছে।
ফলে ধর্মের প্রতি মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস বহু গুণে কমে গেছে। অনেকাংশে ধর্মকে ডিজিটাল যুগের সহযাত্রী হওয়ার অযোগ্য বলে আখ্যা দেয়া হয়। এর যৌক্তিক কিছু কারণও রয়েছে। যেমন- হিন্দুধর্মে সতীদাহ প্রথা, বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ, পৈতৃক সম্পদ থেকে নারীকে বঞ্চিতকরণ ইত্যাদি। মানুষের প্রতি যদি এই হয় ধর্মের বিধান, তাহলে তা অধর্ম। কারণ ধর্ম এসেছে মানুষের কল্যাণের জন্য। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধানের সীমা অতিক্রম করে মনগড়া নীতি আরোপ করা হয়। তা
অবশ্যই পরিত্যক্ত। অন্য যেকোনো ধর্মের তুলনায় ইসলামে নারীকে তার যথাযথ অধিকার ও মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এটা আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং বাস্তব। নারীমুক্তি আন্দোলনকারীরা ধর্মের কথা শুনলেই নাসিকা কুঞ্চিত করেন। বাঙালি জাতির নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রপথিক বেগম রোকেয়া এ ধারণাতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি তার আন্দোলনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, ধর্ম কখনোই মানবতার অকল্যাণে নয়, বরং তা মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দেয়ার চালিকাশক্তির
উৎস। বর্তমানে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নারীমুক্তি আন্দোলন ধর্মকে তাদের গলার কাঁটা ভাবলেও, বেগম রোকেয়া ধর্মের প্রতি যথেষ্ট সম্মান দেখিয়ে তাঁর আন্দোলন চালিয়েছিলেন। সফলকামও হয়েছেন তিনি। যারা বলে ইসলাম নারীকে ঠকিয়েছে, তারা হয় ইসলামের ব্যাপারে যথেষ্ট অজ্ঞ অথবা ইসলামের প্রতি সহিংস মনোভাব লালন করেন। মূলত ইসলামে নারী-পুরুষের মাঝে কোনো বৈষম্য নেই (সূরা নিসা, ১২৪)। তবে কিছু কিছু বিষয় যা সৃষ্টিগতভাবে নারী-পুরুষের
পার্থক্য করে। আর এ পার্থক্যের কারণে স্বতন্ত্র দু’টি জাতি নারী ও পুরুষ। নারীমুক্তি আন্দোলনের মূলনীতিই হলো নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরকরণ। নারীমুক্তি আন্দোলনের ফলে নারীর সপক্ষে আইনি ব্যবস্থা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিবর্তন হলেও সমানতালে বেড়েই চলছে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, নারীকে ব্যবসার পণ্য হিসেবে ব্যবহারসহ কর্মক্ষেত্রে নারীর মানসিক চাপ। ফলে নারী সপক্ষের আইন কাগজে-কলমে থাকলেও এর দ্বারা তারা আশানুরূপ ফলে পাচ্ছে না। আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, ধর্ষণসহ নারীর প্রতি নানামুখী নির্যাতন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলছে।
ইউরোপ-আমেরিকার নারীরা হারাচ্ছে দাম্পত্য জীবনের সুখশান্তি। ফলে সমাজজীবনে নেমে এসেছে নানামুখী বিপর্যয়। বেগম রোকেয়ার কামনা এটা ছিল না। তিনি নারীকে মানসিক ও সামাজিকভাবে অশান্তিমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তিনি শিক্ষাকেই নারীমুক্তির প্রথম ও প্রধান অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘শিক্ষা বিস্তারই এসব অত্যাচার-নির্যাতনের একমাত্র মহৌষধ। … শিক্ষা অর্থে আমি প্রকৃত সুশিক্ষার কথাই বলি; … আমি চাই সেই শিক্ষা- যা তাদের নাগরিক অধিকার
লাভে সক্ষম করবে,… শিক্ষা মানসিক এবং শারীরিক উভয়বিধ হওয়া চাই [সুবহে সাদেক, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, মতিচুর প্রথম খণ্ড, পৃ. ২২৭]।
নিছক সুগৃহিণী হতে গেলেও যে শিক্ষার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য, তা তিনি সংসারের নৈমিত্তিক কাজের ফিরিস্তি দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন সুগৃহিণী (মতিচুর, প্রথম খণ্ড) প্রবন্ধে। এসব ধারণা মোটেও ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। বরং ইসলাম এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে এবং একটি জাতির চালিকাশক্তির উৎস হিসেবে শিক্ষাকে বিবেচনা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই নারীকে বাদ দিয়ে নয়। আমরা দেখতে পাই মহানবীর সা: স্ত্রী আয়েশা রা: ছিলেন তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় শিক্ষিত ও
নারীশিক্ষা বিতরণের প্রধান উৎস। নারীর সম্মান রক্ষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার ইসলামের পর্দার বিধানকে তিনি কখনোই খারাপ মনে করতেন না। তিনি নিজে পর্দা করতেন এবং পর্দার সপক্ষে কথা বলেছেন। তবে পর্দার নামে বাড়াবাড়ি করে নারীকে মোড়কায়িত করাকে তিনি ভালো মনে করেননি। তার অবরোধবাসিনী গ্রন্থের পুরোটাই অবরোধ প্রথার কুফল নিয়ে রচিত। তিনি উগ্রপন্থা অবলম্বন করেননি। তার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ‘… অবরোধের সহিত উন্নতির বেশি বিরোধ নাই। উন্নতির
জন্য অবশ্য উচ্চশিক্ষা চাই। সকল সভ্য জাতিদেরই কোনও না কোনোওরূপ অবরোধ প্রথা আছে। এই অবরোধ প্রথা না থাকিলে মানুষ ও পশুতে প্রভেদ কি থাকে? …. তবে সকল নিয়মেই একটা সীমা আছে। … এ দেশে অবরোধ প্রথা বেশি কঠোর হইয়া পড়িয়াছে। …আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠনসহ (বোরকা) মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নেই। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য শৈলবিহারে বাহির হইলেও বোরকা সঙ্গে থাকিতে পারে। বোরকা
পরিয়া চলাফেরায় কোন অসুবিধা হয় না। তবে সেজন্য সামান্য রকমের একটু অভ্যাস চাই, বিনা অভ্যাসে কোন কাজ হয়?’ (বোরকা, মতিচুর, প্রথম খণ্ড)
ইসলামে বাড়াবাড়ি বা উগ্রতার কোনো স্থান নেই (সূরা বাকারা: ১২৪, ২৫৬)। মধ্যমপন্থা অবলম্বন করাই ইসলামের রীতি। কারণ আল্লাহ পাক মুসলিম জাতিকে মধ্যমপন্থার করে সৃষ্টি করেছেন (সূরা বাকারা: ১৪৩)। রাসূল সা: মধ্যমপন্থার কাজকে সর্বোত্তম বলে ঘোষণা করেছেন। বেগম রোকেয়ার ব্যক্তিগত জীবনাচরণ এবং রচনাবলি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি পর্দার বিরোধী ছিলেন না, পর্দার নামে নারীদের গৃহবন্দী করে রাখার বিরুদ্ধে তার যত আপত্তি- ‘… আমি অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে
দণ্ডায়মান হই নাই। কেহ যদি আমার স্ত্রী জাতির অবনতি প্রবন্ধে পর্দাবিদ্বেষ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য দেখিতে না পান, তবে আমাকে মনে করিতে হইবে আমি নিজের মনোভাব উত্তমরূপে ব্যক্ত করিতে পারি নাই, অথবা তিনি প্রবন্ধটি মনোযোগসহকারে পাঠ করেন নাই। সে প্রবন্ধে প্রায় সমগ্র নারী জাতির উল্লেখ আছে। সকল সমাজের মহিলাগণই কি অবরোধে বন্দিনি থাকেন? অথবা তাহারা পর্দানশীল নহেন বলিয়া কি আমি তাহাদিগকে সম্পূর্ণ উন্নত বলিয়াছি? আমি মানসিক দাসত্বের আলোচনা করিয়াছি’ (অর্দ্ধাঙ্গী, মতিচুর, ১ম খণ্ড)।
অন্য একটি প্রবন্ধে একটি চরিত্রের বাচনে তিনি বলেন- ‘কোরআন শরিফের বিধান মানিলে অবলা-পীড়নও চলে না, অন্যায় অন্তঃপুর প্রথাও চলে না’ (নারীপূজা, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ)।
মূলত পবিত্র কুরআনের প্রতিটি বিধানই মানবতার কল্যাণের নিমিত্তে। তার যথার্থ অনুসরণ মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারায় ধর্মের অবস্থান ছিল উচ্চে। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালন করতেন। মেরি ডালি, তাসলিমা নাসরিন ও উগ্র নারীবাদীদের মতো তিনি ধর্ম আইন ও বিজ্ঞানকে পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেননি। বরং ধর্মের প্রতি তিনি ছিলেন সশ্রদ্ধ। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক দেশের জাতীয় উন্নতি, আধ্যাত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির যাবতীয় কারণগুলোর মধ্যে প্রধান কারণ হইতেছে ধর্ম’ (নারীপূজা, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, পৃ: ৬১)। তিনি বিশ্বাস করতেন- ‘… একমাত্র ইসলাম ধর্মই নারীকে তাহার প্রাপ্য অধিকার দান করিয়াছে, কিন্তু ভারতবর্ষে সেই মুসলিম… নারীর দুর্দশার একশেষ হইয়াছে’ (নূর-ইসলাম, মতিচুর, ২য় খণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৫)।
ইসলামের পর্দা প্রথা সম্পর্কে তিনি বলেন- ‘শাস্ত্রে পর্দা সম্বন্ধে যতটুকু কঠোর ব্যবস্থা আছে, প্রচলিত পর্দা প্রথা তদপেক্ষাও কঠোর। যাহা হউক কেবল শাস্ত্র মানিয়া চলিলে অধিক অসুবিধা ভোগ করিতে হয় না। আমার বিবেচনায় প্রকৃত পর্দা সে-ই রক্ষা করে, যে সমস্ত মানবজাতিকে সহোদর ও সহোদরার ন্যায় জ্ঞান করে’ (কূপমণ্ডূকের হিমালয় দর্শন, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত পৃ. ১৮৯)।
একুশ শতকের নারী আন্দোলনবাদীরা ইসলাম ও তার বিধানকে নিষ্ঠুরভাবে পরিহার করে। অনেকে পর্দাকে সেকেলে বলেও মন্তব্য করে। তারা মনে করেন, পুুরুষের মতো প্যান্ট-শার্ট পরে বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়ানোই প্রকৃত নারীমুক্তির স্বরূপ। এ ধারণা একেবারেই অবাস্তব। যদি তাই হবে তবে ইউরোপ-আমেরিকার নারীরা হতো সবচেয়ে বেশি সুখী। তাসলিমা নাসরিনের মতো যারা নারীস্বরূপ কল্পনা করে এবং বাস্তবায়নে সচেষ্ট, তারা প্রকৃতপক্ষে নারীমুক্তি আন্দোলনের নামে নিজেদের স্বার্থ
হাসিলে ব্যস্ত বললেও ভুল হবে না। আর যা হোক, তাদের আন্দোলন বেগম রোকেয়ার নারী জাতির স্বার্থের আন্দোলন নয়।
বর্তমান নারীমুক্ত আন্দোলনবাদীরা উত্তরাধিকারী সম্পদে নারী-পুরুষের সমান অংশকেই বাস্তব ও সমঅধিকার বলে ব্যাখ্যা দেয়। এটা মূলত সমাজজীবনে বিপর্যয়ের আরেকটি বাস্তব কারণ হতে পারে। কারণ পুরুষের তুলনায় মহিলাদের আয়ের খাত বেশি, ব্যয়ের খাত শূন্যে। এ ব্যাপারে বেগম রোকেয়া বলেন- ‘আপনারা মুহাম্মদীয় আইনে দেখিতে পাইবেন যে বিধান আছে, পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের অর্ধেক ভাগ পাইবে। … তবে দেখিবেন কার্যত কন্যার ভাগে শূন্য (০) কিংবা যৎসামান্য পড়িতেছে’ (অর্দ্ধাঙ্গী, মতিচুর, ১ম খণ্ড, পূর্বোক্ত পৃ. ২৯)।
বেগম রোকেয়া বাস্তবসম্মত আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। সম্পদে নারীর অংশ পুরুষের অর্ধেক তাই বলে তারা সমধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এ কথা বলার সুযোগ নেই। কারণ নারীর চেয়ে পুুরুষের অর্থ ব্যয়ের খাত বেশি এতে সন্দেহ নেই। এ জন্য ইসলাম যার যতটুকু অংশ প্রয়োজন তাকে ঠিক সে পরিমাণ অংশই দিয়েছে। হিন্দুধর্মে পৈতৃক সম্পদে কন্যার কোনো প্রাপ্য অংশ নেই। ইসলাম কন্যাকে পুত্রের উপস্থিতে অর্ধেক অংশ প্রাপ্য বলে ঘোষণা করেছে। এ কথা দ্বারা এটা বোঝাচ্ছি না যে, নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালো। বরং ইসলামে নির্ধারিত যে অংশ নারীর জন্য বরাদ্দ রয়েছে তার বাস্তবায়নকে বোঝাচ্ছি।
শুধু আইন করে বসে থাকার চেয়ে বাস্তবায়ন করাই বেশি ফলপ্রসূ। এ ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়া বাস্তবমুখী ‘চিন্তা’ করেছেন। ফলে তার আন্দোলনে নারী জাতির সত্যিকারের মুক্তি সাধিত হয়েছিল। আজকের আন্দোলন নারীর প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা ও সহিংসতা বহু গুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে। বেগম রোকেয়ার আন্দোলন ধর্মের প্রতি মানুষকে অনুৎসাহী কিংবা ঘৃণাবোধ জাগ্রত করেনি। বরং ধর্মের দোহাই দিয়ে অতিরঞ্জন, উগ্রতা ও ইসলামের বিধানের ভুল ব্যাখ্যাকে তিনি পরিত্যক্ত ও ঘৃণাভরে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ
করেছেন। ধর্মের নামে বাড়াবাড়িকে তিনি যেমন চরমভাবে বর্জন করেছেন, তেমনি ধর্মহীনতাকেও মূর্খতার পরিচয় বলে আখ্যা দিয়েছেন।
লেখক : প্রবন্ধকার