ডেস্ক রিপোর্ট :: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিদেশী বন্ধুদের অবদান কম নয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্থ থেকে তাদের অব্যাহত সমর্থন ও সহযোগিতা আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে ফুটিয়ে তুলেছে বিশ্বময়। ভারত পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় অনেক আলেমও রয়েছেন এ বিদেশী বন্ধুদের তালিকায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতন, নৃশংস গণহত্যা দেখে নিশ্চুপ বসে থাকতে পারেননি তারা। মুক্তিপাগল বীর সেনানীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তারা। অথচ এক অজানা কারণে আজকের তরুণ প্রজন্ম এ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। সরকারীভাবে অন্যান্য বিদেশীদের স্মআননা জানানো হলেও তাঁদের মূল্যায়ণ দেয়া হচ্ছে না। ১৯৭১ সালে এ দেশের নিরীহ জনগোষ্ঠীর ওপর পাক বাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.’র সাহেবজাদা জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতীয় পার্লামেন্টের লোকসভার সদস্য হযরত আসআদ মাদানী রাহ.। তাদের গণনির্যাতন বন্ধে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে তিনিও অনন্য ভূমিকা পালন করেন।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধের সময় বিশ্ব জনমত গঠনের লক্ষ্যে বিশেষ করে তার নেতৃত্বে কলকাতায় যে সভা ও সেমিনারগুলো অনুষ্ঠিত হয়, সে ইতিহাস আজও ভাস্বর হয়ে আছে। ‘৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের মুসলমান সমাজে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রবল জনমত গঠনের কাজ করেন মাওলানা আসআদ মাদানী। রাজধানী দিল্লিতে বিশাল মহাসমাবেশসহ ভারতজুড়ে প্রায় ৩০০টি সমাবেশ করেন তিনি। শরণার্থী শিবিরগুলোতে তার অপরিসীম সহযোগিতা ও দেখাশোনা, গণনির্যাতন বন্ধ করার জন্য তার বিরামহীন দুঃসাহসী ভূমিকা এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার প্রাপ্তিতে তার অবদান স্বাভাবিকভাবে তাকে স্বাধীনতার অন্যতম কাণ্ডারী দূতের মহিমা দিয়েছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের একপর্যায়ে পাক-হানাদার বাহিনীর সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ দেশে দমন-পীড়ন বৃদ্ধির লক্ষ্যে যখন কুখ্যাত সপ্তম নৌবহর এ উপমাহাদেশে যাত্রা করে, তখন মাওলানা আসআদ মাদানী রাহ. পঞ্চাশ হাজারেরও অধিক মুসলমানদের নিয়ে দিল্লির রাজপথে মিছিল করেন এবং তার নেতৃত্বে মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও করা হয়। তিনি ছিলেন ভারতের মুসলমানদের সর্ববৃহৎ সংগঠন জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল। ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল ও ১৮ আগস্ট কলকাতার মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে আয়োজিত জমিয়তের কনভেশন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে দু’দফায় দুটি রেজুলেশন পাস করেন তিনি। এছাড়া মাওলানা আসআদ মাদানী রাহ. পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা এলাকায় বাংলাদেশীদের জন্য শরণার্থী শিবিরের ব্যবস্থা করেন এবং জমিয়তের পক্ষ থেকে নিয়মিত রিলিফ বিতরণের ব্যবস্থা করেন। (সূত্র, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের ভূমিকা)
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কিছু অদূরদর্শী বিভ্রান্ত মুসলমান ধর্মের নামে শুধু পাকবাহিনীকে সমর্থন করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তাদের জুলুম নির্যাতনে মদদ জুগিয়েছে, নিজেরাও প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছে। স্বাধীনতার পর অধীকাংশই তাদের মুখোশ পাল্টালেও সেসব অপকর্মের কারণেই নিরীহ মুসলমান আলেম-ওলামা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর নেমে আসে মহাদুর্যোগ। সেই দুঃসময়েও শান্তির দূত হিসেবে আবির্ভূত হন হজরত আসআদ মাদানী রাহ.। ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত হিসেবে তিনি বাংলাদেশে আসেন। মাওলানা কাজি মুতাসিম বিল্লাহসহ বেশ ক’জন শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামকে নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি এ কথা বোঝাতে সক্ষম হন, অধিকাংশ আলেম-ওলামা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মোটেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন না। বরং সরেজমিন বহু ওলামায়ে কেরাম মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধারা তাদের ব্যাপক সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছে। বিষয়টি দূরদর্শী রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করায় এ দেশের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রমান্বয়ে দুর্যোগের কালো মেঘ দূর হয়ে যায়।
অপরদিকে ওলামায়ে কেরামকে সমবেত করে তাদের উদ্দেশে হজরত আসআদ মাদানী রাহ. বলেছিলেন, এই বাংলাদেশ আপনাদের, আপনাদের এখানেই থাকতে হবে। এ দেশকে ভালোবাসতে হবে। এ দেশে থেকেই দ্বীন ও ঈমানের কাজ করতে হবে। এটা যেমন আপনাদের অধিকার এবং তেমনি কর্তব্যও বটে।
১ অক্টোবর ২০১৩ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদান রাখায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা (মরণোত্তর) পদক প্রদান করে বিরল সম্মানে ভূষিত করে। তার পক্ষে এ সম্মান গ্রহণ করেন তার মেজ ছেলে মাওলানা মওদুদ মাদানী। এ সম্মান সব দেওবন্দি ওলামা-মাশায়েখের এবং এ দেশের সব মাদ্রাসার। মাওলানা আসআদ মাদানী রাহ. উপমহাদেশের মাদ্রাসাগুলার প্রাণকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিসে শূরা কমিটির সভাপতি ছিলেন। এছাড়া তার তত্ত্বাবধানেই মুসলিম পার্সোনাল আইন প্রণীত হয়। মানবতার কল্যাণে নিবেদিত এ মহাব্যক্তিত্বকে বলা হতো ফিদায়ে মিল্লাত অর্থাৎ উম্মাহর জন্য উৎসর্গিত। ২০০৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে ইন্তিকাল করেন তিনি। সিলেট রিপোর্ট থেকে সংগৃহিত।