অনলাইন ডেস্ক :: রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রাখার বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের জারি করা রুলের শুনানি শুরু হবে আগামী ২৭ মার্চ। সোমবার রুলের প্রাথমিক শুনানির পরে আদালতের ১৪ জন সহযোগী বন্ধু (অ্যামিকাস কিউরি) থেকে ১২ জনকে প্রত্যাহার করে ২ জনকে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি নাঈমা হায়দারের নেতৃত্বে বৃহত্তর বেঞ্চ মামলাটির শুনানি শেষে এই আদেশ দেন।
বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। আদালতে আবেদনকারী পক্ষের শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী একেএম জগলুল হায়দার আফ্রিক। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন।
পরে আইনজীবী একেএম জগলুল হায়দার আফ্রিক জাগো নিউজকে বলেন, আদালত ২৭ মার্চ মামলার শুনানির জন্য পরবর্তী দিন ঠিক করেছেন। এর আগে হাইকোর্ট ১৪ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগের আদেশটি প্রত্যাহার করেছেন।
তবে দুইজনের নাম সুপারিশ করেছেন আদালত। তারা হলেন, ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার এম আমির-উল-ইসলাম।
রিটের পক্ষে আইনজীবী জগলুল হায়দার আফ্রিক আরো বলেন, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে অন্তর্ভুক্তির বিধান নিয়ে জারি করা রুল শুনানির জন্য বৃহত্তর বেঞ্চ গঠিত হয়েছে। ২৭ মার্চ এ বেঞ্চে শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।
সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে অন্তর্ভুক্তির বিধান বিষয়ে রিট মামলাটি করা হয়েছিলো ১৯৮৮ সালে। ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে ১৫ বিশিষ্ট ব্যক্তি আবেদনকারী হয়ে রিটটি দায়ের করেন।
রিট আবেদনকারীদের মধ্যে ছিলেন- সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, সাবেক বিচারপতি কে এম সোবহান, অধ্যাপক খান সরওয়ার মুর্শিদ, আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত, বদরুদ্দীন উমর, সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। রিট দায়েরকারীদের মধ্যে অনেকে ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন।
এ রিট দায়েরের দীর্ঘ ২৩ বছর পর ২০১১ সালের ৮ জুন একটি সম্পূরক আবেদন করা হয়। ওইদিনই হাইকোর্টের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী (আপিল বিভাগ থেকে অবসরপ্রাপ্ত) ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বিষয়টি নিয়ে রুল জারি করে।
পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে মতামত প্রদান ও শুনানির জন্য অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ১৪ জন বিশিষ্ট আইনজীবীকে নিয়োগ দেয়া হয়। তারা হলেন- টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ড. এম জহির, মাহমুদুল ইসলাম, এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার আখতার ইমাম, ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, আবদুল মতিন খসরু, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, এ এফ এম মেসবাহ উদ্দিন। ইতোমধ্যে আইনজীবী ড. এম জহির ও মাহমুদুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেছেন।
রুল জারির কিছুদিন পর ২০১১ সালের ২৫ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়। এতে ২ অনুচ্ছেদ আবারও সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে’। সংবিধানের এ সংশোধনীর পর আবারো রিটে সম্পূরক আবেদন করা হয়। ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ বিষয়টির ওপর আবারো রুল জারি করে। ওই রুলের ওপর শুনানির জন্য আজ (সোমবার) তারিখ ধার্য করা হয়েছে।
১৯৮৮ সালে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে অন্তর্ভুক্তির বিধান করার পর ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে রিটকারী ১৫ বিশিষ্টজনের মধ্যে অনেকে ইতোমধ্যে মারা গেছেন। ১৯৮৮ সালের ৫ জুন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে জাতীয় সংসদে অষ্টম সংশোধনী অনুমোদন হয়। একই সালের ৯ জুন এতে অনুমোদন দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ।
এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের আগস্টে ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির’ ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন।
ওই আবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে নানা ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ বাস করে। এটি সংবিধানের মূল স্তম্ভ বলা হয়েছে। এখানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে অন্যান্য ধর্মকে বাদ দেয়া হয়েছে। এটি বাংলাদেশের অভিন্ন জাতীয় চরিত্রের প্রতি ধ্বংসাত্মক।
এদিকে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে সংবিধান সংশোধনে সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখার সুপারিশ করে। পরবর্তীকালে ওই সুপারিশ অনুযায়ী সংবিধানে আনা হয় পঞ্চদশ সংশোধনী। এই সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বহাল রাখার বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি সম্পূরক আবেদন দাখিল করে রিটকারী পক্ষ।
আবেদনে বলা হয়, ‘সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম (আংশিক) ও ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে অনুমোদিত (পাস) হলেও সুপ্রিম কোর্ট এসব সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতির বিধান সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের আলোকে ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র সংবিধানে ফিরে এসেছে। আদি সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল হয়েছে। এটির সঙ্গে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম অব্যাহত রাখা হলে তা হবে সাংঘর্ষিক ও পঞ্চম সংশোধনীর মামলার রায়ের পরিপন্থী।’
সূত্র. এফএইচ/একে/পিআর