যেভাবে প্রতিষ্ঠা হলো জামেয়া
আরবের বুকে যখন ইসলামের প্রথম সূর্য উদিত হয়, তখন ইসলামের নব প্রভাতের মৃদু সমীরণের পরশ নিতে আবালবৃদ্ধবণিতা রাসূলে আকরাম সা.’র দরবারে পঙ্গপালের মতো ছুটে আসতে থাকেন। রহমতে দু’জাহান রাসুল সা. আল্লাহ প্রদত্ত ইলমের অমীয়সুধা তৃষ্ণার্থ সাহাবাগণের মাঝে বিলিয়ে দিতে থাকেন। গঠিত হয় ‘আসহাবে সুফফার’ মাদরাসা। হুবহু এরই যেনো পুনোরাবৃত্তি ঘটল এই জামেয়ার বেলায়। জাহেলিয়্যাতের ঘনঘোর অন্ধকারে আবদ্দ মুক্তিকামী মানুষ যখন দ্বীনের সুশীতল হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য উদগ্রীব। তখন মুক্তির দিশারী আরিফবিল্লাহ হযরত মাওলানা আকবর আলী রাহ. ইলমে ওহির জ্ঞান মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতে মনস্থ করেন। হযরত ইমাম সাহেব নামাযের পর মুসল্লিদের ‘তরজমায়ে কুরআন’ শুনানো শুরু করেন। মুসল্লিদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। বয়স্ক ও বালক বালিকারা ইসলামি শিক্ষা গ্রহণের জন্য ইমাম সাহেবের খেদমতে জড়ো হতে থাকেন, ক্রামন্বয়ে মেট্রিকের ছাত্ররাও তাঁর কাছে কুরআন শরিফ পড়া আরম্ভ করে। দরগাহ মহল্লার মানুষের চাহিদা ও আগ্রহে শিশু কিশোররাও আসতে থাকে দ্বীনের সার্বিক জ্ঞান আহরণের জন্য। এভাবেই চলতে থাকে দীর্ঘদিন।
অতঃপর যখন খলিফায়ে হাকিমুল উম্মত, মুফতিয়ে আজম, মুফতি শফি রাহ. সিলেট সফরে আগমন করেন। তখন হযরত ইমাম সাহেবকে একটি মক্তব বা মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন। তাঁর পরামর্শ ও প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘আরিফ বিল্লাহ রাহবরে তরিকত ইমাম আকবর আলী রাহ. মাজারের দক্ষিণপার্শ্বে ১৯৬১ সনের ৭ নভেম্বর মোতাবেক ১৩৮১ হিজরির ১৮ জামাদাউল উলা একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন ‘মাদরাসায়ে তালিমুল কুরআন দরগাহে হযরত শাহজালাল রাহ.’। যা আজকের এই জামেয়া। তালিম তাবলিগের গুরুদায়িত্বে নিয়োজিত মুসলিম উম্মাহর সেরা সন্তান ইমাম আকবর আলী রাহ. তাঁর নিষ্ঠাপূর্ণ অক্লান্ত পরিশ্রমের বদৌলতেই সেদিনকার সেই ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানটি আজ তাঁর মিশন নিয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম হয়েছে। কালের ঝুড়ি থেকে পঞ্চান্নটি বসন্ত ঝরে পড়েছে। হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে অনেক বন্ধুর পথ মাড়িয়ে আজ বহু দূর এগিয়ে এসেছে এই জামেয়া। দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের বহুদেশে পৌঁছে গেছে তাঁর জাগরণী পয়গাম। বলতে দ্বিধা নেই ‘জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম’ কোনও গতানুগতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, একটি দ্বীনি আন্দোলন। একটি নীরব বিপ্লব। এ ক্ষুদ্র পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। কয়েকটি মূল পয়েন্টের ওপর অতি সংক্ষেপে আলোকপাত করার প্রয়াস পাবো ইনশা আল্লাহ।
জামেয়া প্রতিষ্ঠায় যারা সার্বিক সহযোগিতা করেন
পৃথিবীর বুকে যে কোনও প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পেছনে কারও সহযোগিতা, কারও অবদান থাকে, তেমনই এই জামেয়া প্রতিষ্ঠার পেছনেও একদল নিবেদিতপ্রাণ নিরলস কর্মবীর মানুষের অবদান রয়েছে। তাঁদের মধ্যে যারা সর্বাগ্রে, তারা হলেন সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসার সুপারেনটেনডেন্ট হাজি আরশাদ আলী সাহেব ও তাঁর ছাত্র দরগাহ শরিফের প্রাক্তন প্রভাবশালী মুতাওয়াল্লি এ জেড আব্দুল্লাহ সাহেব ও দরগাহ মসজিদের প্রাক্তন ইমাম ছাঈদ আলী কাছারী সাহেব। হাজী আরশাদ আলী সাহেবের সুপারিশে সরেকওম এ.জেড. আবদুল্লাহ সাহেব মাদরাসার জায়গা করে দেন। তাঁদের নাম অনুচ্চারণে জামেয়ার ইতিহাস রচনা অলিক কল্পনা বৈ কিছু নয়।
জামেয়ার নাম প্রসঙ্গ
জামেয়ার প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল ‘মাদরাসায়ে তালিমুল কুরআন দরগাহে হযরত শাহজালাল রাহ. সিলেট’। জামেয়া প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আর পশ্চাতে ফিরে তাকাতে হয়নি। যদিও এটা সত্য যে, প্রত্যেক উৎকৃষ্ট কাজের সূচনাতে বাধা-বিপত্তির উদ্ভব ঘটে। এ সব প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকুলতা, চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে অগ্রসর হতে হয়। তেমনই এই জামেয়াও প্রতিকুলতার হিমালয় ডিঙিয়ে অনেক বাধার বিয়াবান পেরিয়ে ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হতে থাকে তাঁর লক্ষ্যপানে। জামেয়ার এই উন্নততর রূপ শিক্ষার সফলতা ও ব্যাপকতার কারণে প্রয়োজন পড়ে নাম পরিবর্তনের। অতঃপর ১৯৭৫ ঈসায়ী সনে যখন খলিফায়ে থানভী ক্বারী তৈয়্যিব রাহ. সিলেট আগমন করেন। তখন তিনি রাসুলে করিম সা.’র হাদিস- ‘ইন্নামা আনা ক্বাসিমুন ওয়াল্লাহু ইউতি’ অর্থাৎ আমি হলাম জ্ঞান বিতরণকারী আর মহান আল্লাহ হলেন এর দাতা, এর দিকে লক্ষ্য রেখে এর নাম রাখেন মাদরাসায়ে ক্বাসিমুল উলূম দরগাহ হযরত শাহজালাল রাহ.। এর আরও কিছুদিন পরে শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হলে মাদরাসা শব্দের স্থলে ‘জামেয়া’ শব্দ সংযোজন করা হয়।
পাঠ্যক্রম প্রণয়ন
‘জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম’র মূল লক্ষ্য ও মূখ্য উদ্দেশ্য হলো নতুন প্রজন্মকে সামগ্রিকভাবে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশ প্রেমিক, সুনাগরিক ও ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক ও প্রচারক হিসেবে গড়ে তোলা। এ লক্ষ্য অর্জনে যেসব উপকরণের প্রয়োজন, তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ববহ হচ্ছে আরবি, বাংলা ও উর্দু ভাষায় যথাযথ বুৎপত্তি অর্জন। কেননা, ইসলামি জ্ঞান বিজ্ঞানের মূল উৎস কোরআনে করিম ও হাদিসে রাসুল স.সহ অন্যসব প্রামাণ্য কিতাব আরবিতে লিপিবদ্ধ। আরবি ভাষা-সাহিত্যে পা-িত্য এবং কুরআন-হাদিস ও ফিক্হ ইত্যাদি বুঝার প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলি তথা উসুলে হাদিস, উসুলে তাফসির উসুলে ফিক্হশাস্ত্র বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণ পারদর্শিতা ব্যতীত ইসলামের সঠিক জ্ঞানার্জন এক কথায় অসম্ভব? অন্যদিকে জ্ঞানের একটা বিশাল অংশ উর্দু ভাষায় রচিত। উর্দু ভাষায় দক্ষতা ব্যতীত আকবিরদের লেখনী ও রচনা থেকে জ্ঞান আহরণ করা দুঃসাধ্য। অনুরূপভাবে ব্যাপকভিত্তিতে ইসলামের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে দাওয়াতী ভাষা হিসেবে তথা যে কোনও দেশের প্রচলিত জাতীয় বা সরকারি ভাষায় যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জন এবং যুগ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামবিরোধী বিভিন্ন মতবাদ ও চিন্তাধারা সম্পর্কে সম্যক ধারণাসহ প্রয়োজনীয় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন অতীব প্রয়োজন। কেননা ইসলামি জ্ঞানার্জন একজন মুসলমানের জন্য যেমন ফরয বা অবশ্য করণীয়, তেমনই তাঁর প্রচার-প্রসারও ফরজ। প্রচার-প্রসারে ভাষা বিশুদ্ধ পা-িত্যপূর্ণ ও আকর্ষণীয় হওয়া বাঞ্ছনীয়, যাতে মানুষ তা পড়ে বা শুনে বিমোহিত হয়। এ জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-ই ছিলেন না। সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকও ছিলেন। পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত যারা ইসলামের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করে দাওয়াত-তাবলিগের ময়দানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে গেছেন এবং করে যাচ্ছেন তাদের বক্তৃতা ও লেখনীর ভাষাশৈলী সর্বগ্রাহ্য সূনিপুণ। তাছাড়া স্থান, কাল ও পাত্র-বিশেষ, বাচনভঙ্গি ও রচনাশৈলিতে ভিন্নতা থাকা দরকার। গাঁ-গ্রামের অশিক্ষিত মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছাতে যে ভাষা প্রয়োগ করা হবে, উচ্চশিক্ষিত এলিটদের কাছে সেই ভাষা প্রয়োগ করে দাওয়াত দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের মানুষকে যে পদ্ধতিতে তাবলিগ করা যাবে, তা আমেরিকানদের বেলায় প্রযোজ্য হবে না। স্বাভাবিক অবস্থায় যে নিয়মে কথা বলা হবে, তা কোনও দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা যাবে না। ইসলামি দাওয়াতের এ নিয়মপদ্ধতি ইসলামের মতোই সর্বকালীন ও সার্বজনীন। এতেই ইসলামি দাওয়াতের সাফল্য নিহীত।
উপর্যুক্ত বিষয়াবলি সামনে রেখেই জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম এর বিজ্ঞ পরিচালক ইমাম আকবর আলী রাহ.ও তাঁর সহকর্মীরা জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম-এর পাঠ্যতালিকা প্রণয়ন করেছেন এবং ১৫টি শিক্ষাবর্ষে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ শ্রেণিগত মান অনুসারে বিন্যস্ত করেন। ১. ইলমে আক্বাইদ, ২. ইলমে তাফসির ও ইলমে উসূলে তাফসির, ৩. ইলমে হাদিস ও ইলমে উসূলে হাদিস, ৪. ইলমে ফিক্বহ ও ইলমে উসূলে ফিক্বহ, ৫. ইলমে ফারাইয বা উত্তরাধিকারী সম্পদবণ্টন বিদ্যা, ৬. ইলমে তাজবীদ, ৭. ইলমে আদব/আরবি-উর্দু-বাংলা সাহিত্য, ৮. ইলমে তারিখ/ইসলামি ইতিহাস, ৯. ইলমে ইক্বতেসাদ/অর্থনীতি, ১০. ইলমে মানতিক্ব/যুক্তিবিদ্যা, ১১. ইলমে বালাগাত/ভাষা অলঙ্কার, ১২. ইলমে নাহু/বাক্যগঠন বিধি, ১৩. ইলমে সরফ/শব্দ প্রকরণ, ১৪. বৈষয়িক বিদ্যা বাংলা, অংক, ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাস প্রভৃতি। উপরিউক্ত বিষয়সমূহ বিজ্ঞ শিক্ষকম-লীর মাধ্যমে ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়া হয়। জামেয়ার প্রতিজন উস্তাযই হচ্ছেন জ্ঞানাকাশের দেদীপ্যমান এক এক তারকা। যারা শিক্ষা ও দীক্ষার ময়দানে দক্ষ শাহসওয়ারের মতো কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
ছাত্রদের মধ্যে ঐক্য ও ভাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি, তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ, চিন্তা ও চেতনার দিক থেকে একদল দক্ষ দুরদর্শী সমাজসচেতন কর্মী সৃষ্টি, নীতি ও নৈতিকতার দিক থেকে সর্বোত্তম আদর্শের নজীর স্থাপন, মানবীয় সকল গুণাবলির বিকাশ সাধন ও সামাজিক দায়িত্ববোধের ক্ষেত্রে একদল যোগ্যকর্মী বাহিনী গড়ে তোলাই হচ্ছে তাদের ঐকান্তিক লক্ষ্য। যার দরুন জামেয়া আজ ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। তাইতো জামেয়া তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুগে-যুগে জাতিকে উপহার দিয়েছে একঝাঁক মেধাবী মুখ, প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিস, বিজ্ঞ মুফতি, বিদগ্ধ লেখক, তুখোড় বক্তা, সাহসী সাংবাদিক, সফল রাজনীতিবিদ ও নিঃস্বার্থ সমাজসেবক। বাঙলাদেশসহ গোটা বিশ্বে জামেয়ার ফারেগিন ইকামত-ই দ্বীন ও খিদমাত-ই দ্বীনের জন্য জীবনের শেষ রক্তবিন্দু বিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন।
জামেয়ার ফাত্ওয়া বিভাগ
জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম’র প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই স্থানীয় পর্যায়ের লোকজন দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ধর্মীয় সমস্যাবলি নিয়ে জামেয়ায় উপস্থিত হতেন, জামেয়ার কর্ণধার প্রাজ্ঞ উলামায়ে কেরাম তাঁদের সমস্যাবলির সমাধান দিতেন। যার দরুন জামেয়ার সুনাম-সুখ্যাতি উত্তরোত্তর ছড়িয়ে পড়তে থাকে দূর-দূরান্তে। ক্বাসিমুল উলূম ও তার শিক্ষকম-ীর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আস্থাবোধ জনমনে গ্রথিত ও বদ্ধমূল হতে থাকে অভাবনীয় গতিতে। দূর নিকটের লোকজন তাদের জিজ্ঞাসা নিয়ে ঝোঁকে পড়েন জামেয়ার দিকে। প্রবাস থেকেও সমাধান প্রার্থীদের চিঠিপত্র আসতে থাকে। জনগণের তীব্র প্রয়োজন অনুধাবণ করেই জামেয়া কর্তৃপক্ষ ‘দারুল ইফতা’ নামে একটি আলাদা বিভাগ চালু করেন। বর্তমানে এ গুরুদায়িত্ব যারা আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা হলেন, উস্তাযে মুহতারাম শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহিব্বুল হক সাহেব গাছবাড়ি, উস্তাযে মুহতারাম মুফতি মাওলানা আবুল কালাম যাকারিয়া সুনামগঞ্জী। এ দু’মহান ব্যক্তিত্বই জামেয়ার মুফতি হিসেবে স্বীকৃত। দ্বীন ইসলামের প্রতিটি শাখায় রয়েছে তাঁদের পা-িত্য, তাঁদের আপাদমস্তকে রয়েছে সুন্নতে নববীর অনুসরণ, খোদাভীরুতা, বিনয় ইত্যাদি মহৎ গুণাবলির ঔজ্জ্বল্য।
তাখাসসুস ফিল ফিক্বহ্ বা ইসলামি আইন ও গবেষণা বিভাগ
যুগ যত সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, মানুষের সমস্যাও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সমস্যার সমাধানে যোগ্য মুফতির চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ গুরুত্ব উপলব্দি করেই জামেয়ার পরিচালকম-লী একদল যোগ্য মুফতি তৈরির লক্ষ্যে ‘তাখাসসুস ফিল ফিক্বহ’ নামক একটি বিভাগের সূচনা করেন। দুই বছর মেয়াদী এই বিশেষ বিভাগে দাওরায়ে হাদিস অর্থাৎ টাইটেল ক্লাশে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ ছাত্রদের মধ্যে ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের মৌখিক ও লিখিত ইন্টারভিউ-এর মাধ্যমে কৌটাভিত্তিক পদ্ধতিতে ছাত্র ভর্তি করা হয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৯০জন ছাত্র তাখাসসুস কোর্স সম্পন্ন করে ফারিগ হয়েছেন; বর্তমানে উক্ত ইসলামি আইন ও গবেষণা বিভাগটি কৃতিত্বের সঙ্গে সাফল্যপানে এগিয়ে চলছে।
জামেয়ার গ্রন্থাগার
জনৈক আরবি কবি বলেন, ‘সময়ের শ্রেষ্ঠতম ও সর্বোত্তম সঙ্গী হচ্ছে গ্রন্থ।‘ অপর এক আরবি কবির ভাষ্য হচ্ছে : জগতে আমার প্রিয়তম বন্ধু হলো কিতাব। ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান শায়বানী রাহ. একসময় অধ্যয়নরত অবস্থায় অধ্যয়নের স্বাদ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে ওঠেছিলেন: ‘ওহে! এমনতর স্বাদ থেকে রাজা-বাদশার সন্তানেরা কোথায়।’ আমরা যা জানি তার পরিমাণ একেবারেই কম। আর যা জানিনা, এর পরিমাণ অতি বিশাল ও বিস্তৃৃত। জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বেশিবেশি বই পড়া। নিয়মিত অধ্যয়ন, অবিশ্রাস্ত অনুশীলনের মাধ্যমে স্মৃতির আয়নায় গড়ে তোলা যায় জ্ঞানের বিশাল ভা-ার। কিন্তু সব ধরণের কিতাবাদি সংগ্রহ করা ছাত্রদের জন্যে কঠিন। অর্থের অভাবে অনেকেই ইচ্ছে মতো মূল্যবান গ্রন্থাদি কিনতে পারে না। যার দরুন তাদের পাঠের অনিবার্য তৃষ্ণায় ভাটা পড়ে যায়।
এ কারণে ‘ক্বাসিমুল উলূম’ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কালের শ্রেষ্ঠ মহামনীষীদের রচিত দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য কিতাবাদির এক মহাসম্ভার গড়ে তোলেছে। প্রতি বছর শিক্ষাবর্ষের প্রারম্ভে শত শত ছাত্রের মাঝে বিপুল পরিমাণ পাঠ্যকিতাব বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। বছরান্তে পুণরায় সেগুলি ফেরৎ নেওয়া হয়। জামেয়ার গ্রন্থাগারে রয়েছে দুনিয়াজোড়া প্রাচ্য-প্রাচীন ও আধুনিককালের তাফসির গ্রন্থাবলি। বিপুলসংখ্যক হাদিস গ্রন্থাবলি, গবেষণাধর্মী বিশাল কলেবরের শত-শত দূর্লভ ইসলামি আইন গ্রন্থাদি, যা কোনও কোনোটি ত্রিশ-চল্লিশ খ-ে সমাপ্ত। এছাড়াও যুগের চাহিদা পুরণ করার মতো রয়েছে পুস্তকের এক বিশাল ভা-ার। ছাত্র-শিক্ষকদের অহর্নিশি মোতালা’য়া চলে এখানে। ছাত্ররা গভীর জ্ঞান ও পা-িত্য অর্জনের প্রবল নেশায় এ-গ্রন্থাগারে বসে গবেষণাকর্মে রত থাকে।
জামেয়ার ছাত্রাবাস
সিলেটসহ গোটা বাংলাদেশে যত ক্বওমি মাদরাসা রয়েছে, হাতেগোনা কয়েকটি মাদরাসা ব্যতীত ক্লাস রুমেই ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা। আলাদা কোনও ছাত্রাবাস পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কেননা ছাত্রদের আবাসিক ব্যবস্থার জন্য রয়েছে বিশাল ছাত্রাবাস। মাদরাসার অনতি দূরে রাজারগল্লী এলাকার পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে এ ছাত্রাবাসটি। প্রায় এক একর জমির ওপর স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে ছাত্রাবাসটি। এর প্রবেশ পথে রয়েছে বিশাল গেইট, গেইটের ভেতরে ডানপার্শ্ব ঘেষে রয়েছে বয়োবৃদ্ধ একটি নারিকেল গাছ। যেনো অসংখ্য স্মৃতি নিয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে নীরবে। প্রতি বছর ভাগাভাগা নারিকেল প্রসব করে তৃপ্ত করে তুলছে সবাইকে। এর পার্শ্বে রয়েছে সুন্দর মেহমানখানা যা অতিথিদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। খুব-ই সুন্দর ও মনমুগ্ধকর এ ছাত্রাবাসটির শেষ প্রান্তে রয়েছে বিশাল তিন তলা বিল্ডিং। গেইটের সোজা মাঠের বুকচিরে প্রশস্থ একটি রাস্তা তিন তলা বিল্ডিং-এ এসে লেগেছে। তিন-চার হাত প্রশস্থ এ রাস্তা থেকে বিভিন্ন কামরায় যাতায়াতের জন্য রয়েছে ছোট-ছোট পথ।
তাকরার
এর ইংরেজি ‘গ্রুপ স্টাডি’ আর বাংলায় সম্মিলিত অধ্যয়ন। আরবি হল ‘মুযাকারা’, যা মাদরাসার ছাত্রদের কাছে ‘তাকরার’ হিসেবে বেশ চেনাজানা। তাকরার অর্থই হচ্ছে পূণরাবৃত্তি; কোনও কিছু দ্বিতীয়বার করা। অর্থাৎ শিক্ষক যে-বিষয়ে ক্লাসে পাঠ দিয়েছেন, সে বিষয় সম্মিলিতভাবে দ্বিতীয় বার অধ্যয়ন করা। এখানে যে তাকরার করাবে, তার কোনও ভুল হলে উপস্থিত কারও না কারও কাছে অবশ্যই ধরা পড়বে। সঙ্গে সঙ্গে শুধরে দেওয়া হবে। কারও কাছে কোনও বিষয় অস্পষ্ট থেকে গেলে পারস্পরিক প্রচেষ্টায় সমাধান হয়ে যাবে। সবাই মিলেও যদি সঠিকতায় পৌঁছা না যায় বা কিছু সন্দেহ থেকে যায়, শিক্ষকের শরণাপন্ন হয়ে সমাধান করে নিবে। এ ধরণের শিক্ষার দরুন ছাত্রদের মাঝে বহুগুণের সমাবেশ ঘটে। তাঁর জ্ঞান হয় পরিপক্ষ। স্মরণে থাকে বহু দিন। পাঠ বুঝার মধ্যে ভুল থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা দূর হয়। ফলে শিক্ষার্থীর মধ্যে অপরকে পাঠ দানের ও বোঝানোর যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। লেখাপড়ায় হয় আত্মবিশ্বাসী এবং পরীক্ষায় তাকে মাত্রাতিরিক্ত ঝামেলা পোহাতে হয় না।
বোর্ডিংসিস্টেম মাদরাসাগুলোতে তাকরারের এ ধরণের পদ্ধতি থাকার কারণে ছাত্রদের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়ে ওঠে। গ্রাম্য মাদরাসাসমূহে তাকরারের সুযোগ হয় না বা হলেও খুবই কম। ফলে অনেক মেধাবীমুখ অবহেলিত থেকে যায়, বিকশিত হতে পারে না জীবনের স্পর্ধিত আঙ্গিনায়।
জামেয়ার হিফজ বিভাগ
হিফজের ছাত্রদের থাকা-খাওয়ার জন্য রয়েছে ভিন্ন ব্যবস্থা। গজার মাছের পুস্করনীর পশ্চিম প্রান্তে ‘দারুল এক্বামাহ’ নামে একটি আলাদা ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছে। যেহেতু হিফজ বিভাগের শিক্ষাদান পদ্ধতি ক্লাসিক্যাল কোর্সের শিক্ষাদান পদ্ধতির চেয়ে ভিন্ন, তাই এর ব্যবস্থাপনা ও ইন্তেজাম আলাদা করা হয়েছে।
হিফজ বিভাগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে; শেষ রাতে বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে সকল ছাত্রদের জাগিয়ে দেওয়া। হিফজ তাকমীল বিভাগ বা শেষবর্ষে যারা উপনীত, তাদের জন্য সাপ্তাহিক ‘দাওরা’ অর্থাৎ দু-জনের একজন অপরজনকে পিছনের পড়া শুনানো বাধ্যতামূলক করে রাখা হয়েছে। একারণেই এখানে শিক্ষা গ্রহণকারী প্রতিটি ছাত্র একজন যোগ্য ও দক্ষ হাফিজ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে।
এ পর্যন্ত জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম’র একাডেমিক ও অবকাঠমোগত সফলতার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বিস্তারিত বর্ণনার জন্য শতশত পৃষ্ঠার প্রয়োজন। এ সবের বর্ণনা এখানে সংগত নয়, প্রয়োজনও নয়। অত্যন্ত প্রতিকুল পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠানের এ রকম চোখ ধাঁধানো অগ্রগতি একমাত্র আল্লাহরই দান এবং মুহতারাম প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আকবর আলী রাহ.’র নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞার সুফল বৈ কিছু নয়।
লেখত : মুহাদ্দিস, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।