বুধবার, ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ ভোর ৫:০২
Home / অনুসন্ধান / বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন : যুগান্তকারী না আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত?

বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন : যুগান্তকারী না আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত?

imagesইলিয়াস মশহুদ ::
“বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম কোম্পানীর কাছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট জমা দিয়ে সিম আমি ইউজ করবো না প্রয়োজনে নাম্বার বন্ধ হয়ে যাক। আমি বিশ্বাস করি, এটা চরম পর্যায়ের আত্মঘাতি একটা সিদ্ধান্ত।” আমার এক বন্ধু তার ফেসবুক ওয়ালে এন ক্ষোভাত্মক স্টাটাস দিয়েছে। এরপর আমি নিজেও অনেক চিন্তা-ভাবনার যা বুঝলাম, তাতে আমি রীতিমত অবাক হয়েছি।
বিশ্বের বুকে দ্বিতীয় দেশ হিসেবে আমরাই এই চরম আত্মঘাতি একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। এর আগে একটা দেশই এই ডিজিটাল বোকামীর পরিচয় দিয়ে কাজটা করেছিলো, তারা হলো পাকিস্তান। আজ বিশ্বের যে জায়গাতেই বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা হয়, পাকিস্তানের ছোটখাটো একটা সংশ্লিষ্টতা বের হবেই! এর পেছনে অনেক গবেষকই পাকিস্তানী জনগনের ঐ ফিঙ্গারপ্রিন্ট জমা দেয়ার কথা বলে থাকেন!
সিম রেজিষ্ট্রেশনের জন্য আজকে আমরা ফিঙ্গার প্রিন্ট জমা দিলাম ‘এয়ারটেল’ কোম্পানীর কাছে, ভবিষ্যতে দেখা গেলো ভারতে তাজমহল বা মুম্বাই এ্যাটাক টাইপের কোনো হামলায় অবিস্ফোরিত কোনো গ্রেনেড বা বোমায় বাংলাদেশি এক নাগরিকের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে! এমনটা যে হবেনা- এর নিশ্চয়তা কোথায়?
ফিঙ্গারপ্রিন্ট জমা দিলাম গ্রামীণ ফোন কোম্পানীর কাছে, কালকে দেখা গেলো পশ্চিমা কোনো দেশে জঙ্গী হামলায় কোনো এক বাংলাদেশির ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেলো! এবার পশ্চিমাদের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা যে চাইতে হবে না- এটাও কী বলতে হবে!
ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে স্বদেশটাকে চুষে খাওয়া এই সিম কোম্পানীগুলোকে কিভাবে বিশ্বাস করা যায়! এরা যে এই দেশকে ভালোবাসেনা, তার প্রমাণ তো এদের ব্যাবসায়িক নীতিতেই প্রকাশ। এসব সিম কোম্পানীর কাছে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মত সিকিউরিটির স্বর্বস্ব তুলে দেয়ার যৌক্তিতা নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবতে হয়েছে আমাকে। কারণ, কালকে যে অসাধু চক্রের মাধ্যমে এক হাজার টাকার বিনিময়ে আমার আঙ্গুলের ছাঁপ কোনো সন্ত্রাসী গোষ্টির কাছে বিক্রি হবে না- সেটার গ্যারান্টি কে দেবে? তারানা হালিম নাকি অটিষ্টিক জয়!
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভয়েস কলে যেনো অপরাধী তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট রেখে আসবে! কথা সহজ, কোটি টাকা ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে চলতে থাকা কিছু বেনিয়া মাল্টিন্যাশনাল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে এই ভয়ানক ডাটাবেজ করতে দিয়ে রাষ্ট্র এবং তার নাগরিকদের মাথার উপর ছড়ি ঘুরাতে দেওয়া যাবেনা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট একজন মানুষের চূড়ান্তÍ লেভেলের প্রাইভেট প্রাইভেসি। এটাকে লিফলেট বানিয়ে বিক্রির জন্য কারো হাতে তুলে দেয়া কতটা যৌক্তিক- অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়।
সিম কোম্পানির কাছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট না দিলেই কি হত না?
আমাদের দেশে আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করা হয় মূলত দ্রুত সময়ে অপরাধী চিহ্নিত করার কাজে। এটা খুবই গোপনীয় একটা বিষয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো- আঙ্গুলের ছাপ কেনো প্রয়োজন? হটাৎ করেই সিদ্ধান্ত হলো এখন থেকে দেশের সকল মোবাইল সিম নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করে। কারণটা অজানা। ধরে নিলাম এটা নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন। তাহলে সেটা শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে কি করা সম্ভব ছিল না? জাতীয় পরিচয়পত্রের মূল্যটা তাহলে কোথায় থাকল?
কিছু গুরুতর প্রশ্ন
ধরুন, বাংলাদেশী একটা কোম্পানী আমেরিকা বা ভারতে টেলকমের ব্যবসা করে। সেই দেশ কি সিম রেজিস্ট্রেশনের জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্টের অনুমতি দিবে? উত্তর অবশ্যই না।কিন্তু বাংলাদেশ দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে? উত্তর আসবে সন্ত্রাস ইস্যু। মেনে নিলাম কিন্তু ন্যাশনাল ইস্যু কি প্রাইভেট কোম্পানী দিয়ে করা যায়? উত্তর না। কিন্তু এটাই এখন বাংলাদেশে হচ্ছে!!
রাষ্ট্র একটি সামাজিক চুক্তির প্রতিষ্ঠান, যা আইন ও বিধান দ্বারা পরিচালিত হয়। যদি সেটাই রাষ্ট্রের সংজ্ঞা হয় তাহলে রাষ্ট্র কি মানুষের অধিকার বিরোধী কোনো আইন করতে পারে? উত্তর হল, আইনের বেসিক হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার বিরোধী কোনো আইন তৈরি হতে পারে না। তাহলে ব্যক্তির গোপনীয়তা যখন মৌলিক অধিকার, তখন কোন আইন বলে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম রেজিস্ট্রেশন হবে?
সরকারিভাবে যেটা করা যেত- সারাদেশের জনগণের আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা যেত সরকারের নির্দিষ্ট বিভাগের মাধ্যমে। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরী ও নবায়নের মতই আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করা যেত। আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহের পর সেগুলো সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে সংরক্ষিত রাখা যেত সরকারের কাছে। সেটা এমনকি আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতেও থাকবে না। পুলিশ অপরাধের ঘটনাস্থল থেকে ফিংগারপ্রিন্ট নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠাবে। তারা ফিঙ্গারপ্রিন্টের মালিকের নাম পুলিশকে জানাবে। আপনার আঙ্গুলের ছাপ যে পরবর্তীতে আপনাকেই ফাঁসানোর কাজে ব্যবহার করা হবেনা, তার গ্যারান্টি কী? আমার আঙ্গুলের ছাপ একমাত্র রাষ্ট্রই সংগ্রহ করতে পারবে, কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়। আর রেজিষ্ট্রেশন না করলে এত লোকের সীম বন্ধ করে দেয়াও কি সম্ভব?
জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষনার অনুচ্ছেদ-৩ এ বলা হয়েছে ‘প্রত্যেকেরই জীবন-ধারণ, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে।’ তাহলে একটা সাধারণ মোবাইল সিম কেনা আমার অধিকার। আর  এই অধিকারের জন্য আমার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্গন করার কোন অধিকার আছে কি? উল্লেখ্য বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের সাক্ষরকারী একটি দেশ।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে প্রাইভেসি রাইটস বা ব্যক্তির তথ্য সুরক্ষা ও গোপনীয়তা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের যোগাযোগের উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে। তাহলে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে কি সংবিধান লঙ্গন করা হচ্ছে না? ২০১২ সালে প্রায় ১৭০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয় গুগলকে, যারা অ্যাপলের সাফারি ব্রাউজারের প্রাইভেসি সেটিংস এড়িয়ে ব্যবহারকারীদের ওপর গোপনে নজরদারি করার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল।
অবস্থা যখন এই, সোস্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার ঝড় বইছে, তখন এর পক্ষে সাফাই গেয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে একটি স্টাটাস দিয়ে ‘ভয়’ ভাঙ্গিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ওই আশঙ্কা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। দেশ ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতিতে সিম/রিম নিবন্ধন পদ্ধতি ও কিছু কথা-
১। আঙুলের ছাপ ঘওউ তেও আছে, ছিলো আগের সিম/রিম রেজিস্ট্রেশন ফর্মেও এবং এইগুলো সব অপারেটরদের কাছেও ছিলো। তখন যদি বিদেশি এইসব অপারেটরদের হাতে আপনার আঙুলের ছাপ তুলে দিতে পারেন তবে এখন কোনো সিম কার সেই নিয়ম মেনে বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতিতে আঙুলের ছাপ ভেরিফিকেশন করতে আপনাদের ভয় কিসের? সন্ত্রাসী এবং অপরাধী ছাড়া এ পদ্ধতিতে ভয় পাবার কথা না।
২। আপনার সিমের মালিক যে আপনি, সেই জন্যই এনআইডি’র ডাটাবেইসের সঙ্গে এখন বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে শুধুমাত্র আপনার আঙুলের ছাপটি মিলিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সিম কিনলে আপনি সিমের মালিকানা কেন স্বীকার করবেন না?
৩। এই পদ্ধতি বাংলাদশের সব নাগরিকের জন্যই প্রযোজ্য। সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ সব নাগরিকদের জন্যই প্রযোজ্য। সরকারের অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে এটা সবার জন্য প্রযোজ্য হতো না।
৪। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন এই ডাটাবেইসে প্রবেশ করতে পারবে। যা ইতোমধ্যে আপনার এনআইডিতেও আছে। এখন শুধু এই আঙুলের ছাপের সঙ্গে আপনারটা মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। একটি এনআইডি’র বিপরীতে পূর্বে যেমন ৬০ হাজার বা এর অধিক সিম পাওয়া গেছে সেটা এড়াতেই এখনকার এই বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতিতে সিম রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছে। ‘সুতরাং দেশ ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে আপনারা সকলে এই পদ্ধতিতে সিম/রিম রেজিস্ট্রেশন করুন। কোনো মিথ্যা সংবাদে বিভ্রান্ত হবেন না।’
প্রতিমন্ত্রী আরো লিখেছেন- আমরা আপনাদের জন প্রতিনিধি, আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব।
আমরা সরকারের প্রতি অনুরোধ করছি- বিষয়টির তাৎপর্য গভীরভাবে ভেবে দেখার জন্য। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে জাতীয় পরিচয়পত্র দিন। সেটা দিয়ে আমরা যাতে সব ধরণের নিবন্ধন সম্পন্ন করতে পারি। পরিশেষে আরেকবার বলতে চাই, সিম রেজিষ্ট্রেশনের নামে সারা দেশের মানুষের আঙ্গুলের ছাপ বিদেশি কোম্পানির কাছে না দিলেই কি হতো না?
গ্রামীণ, বাংলালিংক, সিটিসেল, এয়ারটেল, রবির মত বিদেশী সিমের কয়েক কোটি গ্রাহক এখন যদি সিম নিবন্ধনের আওতার বাইরে থেকে যায়, তখন কী এসব কোম্পানী অনিবন্ধিত এই সিমগুলো বন্ধ করে দেবে? প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকা লোকসান দেয়ার দুঃসাহস দেখাবে?

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...