মঙ্গলবার, ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১১:৫০
Home / অনুসন্ধান / কেন এই বাহাস!

কেন এই বাহাস!

3422_b6ওয়েছ খছরু :: ‘বাহাস’ নিয়ে চ্যালেঞ্জ-পালটা চ্যালেঞ্জ চলছে সিলেটের বিশ্বনাথে। এতে করে আলীয়া ও কওমিপন্থি আলেম-উলামাদের দীর্ঘদিনের বিরোধ নতুন করে শুরু হয়েছে। মুখোমুখিও অবস্থানে রয়েছেন তারা। বিষয়টির দিকে নজর পড়েছে বৃহত্তর সিলেটের আলেম উলামাদের। এই অবস্থায় অস্বস্তিতেও পড়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এদিকে, বাহাস-এর প্রস্তুতি জানিয়ে ইতিমধ্যে উভয়পক্ষ সংবাদ সম্মেলন পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার আলিয়াপন্থি শিক্ষকরা সংবাদ সম্মেলনে করে বাহাস’র প্রস্তুতি কথা জানিয়েছে। এর আগে কওমিপন্থি শিক্ষকরাও একই আহ্বান জানিয়েছিলেন। সিলেটে আলিয়া ও কওমিপন্থি আলেম-উলামাদের বিরোধ অনেক পুরনো। স্বাধীনতার পর থেকে দু’টি মতাদর্শ নিয়ে একাধিকবার বিভিন্নস্থানে মুখোমুখি হয়েছিলেন দুই পক্ষের উলামারা। হয়েছে সংঘর্ষও। আর এই বিরোধের অন্যতম তীর্থস্থান হচ্ছেন সিলেটের বিশ্বনাথ।
বিশ্বনাথের বাসিয়ানদীর দক্ষিণপাড় আলিয়াপন্থি আলেম-উলামাদের নিয়ন্ত্রণে আর উত্তরপাড় হচ্ছে কওমিপন্থি উলামাদের নিয়ন্ত্রণে। বিরোধের কারণে উভয়পক্ষ যে যার অবস্থানে মতাদর্শ মতো ধর্মীয় কার্যাদি সম্পাদন করে আসছিলেন। এক দশক ধরে দুই অংশের আলেম-উলামাদের মধ্যে বিরোধ থাকা সত্ত্বেও সম্পর্ক ভালোই ছিল। দুই মতাদর্শ প্রতিষ্ঠাতা করা নিয়ে বিরোধও দেখা দেয়নি। কিন্তু গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি নরসিংদী থেকে ওয়াজ-মাহফিলে আসা মাওলানা আনোয়ার হোসেন চিশ্‌তির এক বক্তব্যকে ঘিরে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়। ওইদিন আল-বালাগ তাফসিরুল কোরআন পরিষদ-এর উদ্যোগে আয়োজিত এক মাহফিলে ওই আলেম ক্বিয়াম, মিলাদসহ ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে মন্তব্য করেন। বাগিছাবাজার-দশঘর এলাকায় আয়োজিত ওই তাফসিরুল মাহফিলে এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরবর্তীতে এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছালিক মিয়া ও রুহুল আমিন রাজি মধ্যস্থতায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এবং মধ্যস্থতাকারীরা বাহাস-এর মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করা হবে বলে জানিয়ে দেন। এদিকে, গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে বাহাস’র আয়োজন করা হয়েছিল স্থানীয় বাগিছাবাজারে। আর এ বাহাসের বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসনসহ আওয়ামী লীগ নেতারা কৌশলী শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে বাহাস’র আয়োজন না করেই বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা চালান। কিন্তু এরপরও বিবদমান দুইপক্ষ একে-অপরের মুখোমুখি অবস্থান ছাড়েননি।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত সোমবার বিশ্বনাথে সংবাদ সম্মেলন করেন কওমিপন্থি আলেম-উলামারা। ওই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মাওলানা আশরাফুল হক। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি বাগিচাবাজারে আল-বালাগ তাফসিরুল কোরআন পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত মাহফিলে দেয়া বক্তব্যকে বিকৃত করে তথা কথিত সুন্নি নামধারীরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করেন। একপর্যায়ে ওই বক্তব্যের জের ধরে তাফসিরের সভাপতি ছালিক মিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করে মাফিলের মাইকে ১৯শে ফেব্রুয়ারি ‘বাহাস’র ঘোষণা দেয়া হয়। পরে তাফসির কমিটির পক্ষ থেকে বাহাস’র নিরাপত্তার জন্য থানায় আবেদন করা হলে পুলিশ প্রশাসন অনুমতি দেয়নি। কিন্তু সুন্নিদের পক্ষ থেকে লিফলেটের মাধ্যমে বাহাস’র দাওয়াত দেয়া হয়। খবর পেয়ে স্থানীয় কওমি আলেমদের পক্ষ থেকে মাওলানা মুফতি রশীদ আহমদ ও মাওলানা আনহার উদ্দিন’র আহ্বানে বাগিচাবাজারে একই দিন একই সময়ে প্রতিবাদ সভার ডাক দেয়া হয়। পাল্টাপাল্টি সমাবেশের সংবাদ পেয়ে সকাল ১১টায় সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পংকী খান, সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার, বিশ্বনাথ থানার ওসি আবদুল হাই ময়নাগঞ্জ বাজারে গিয়ে কওমি ওলামাদের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে বাগিছাবাজারে না যাওয়ার অনুরোধ করে বলেন, সেখানে কোন বাহাস নেই প্রশাসরে পক্ষ থেকে কোনো অনুমতি দেয়া হয়নি।
শুধু আলিয়াপন্থি মিলাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে। প্রশাসন ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের আশ্বাসে উলামায়ে ক্বেরামগণ কর্মসূচি স্থগিত করেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, মাওলানা নুরুল ইসলাম, মাওলানা রশীদ আহমদ, মাওলানা ফয়জুর রহমান, মাওলানা নুরুল হক, মাওলানা খবীর উদ্দিনসহ অর্ধশত আলেম-উলামা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে, শুক্রবার এই বিষয় নিয়ে পাল্টা সংবাদ করেছেন মুসলিম সুন্নি জনতা ও আলিয়াপন্থি আলেমরা। এতে লিখিত বক্তব্য দেন মাওলানা হাবিবুর রহমান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বাহাসের পরের দিন সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে মুসলিম জনতার মাঝে যে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল, তাদের সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ বিভ্রান্তিরও নিরসন হয়ে গেল। প্রমাণিত হলো আমরা সেদিন বাহাস অনুষ্ঠানস্থলেই ছিলাম কিন্তু তারাই আসেননি।’ সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, কওমিপন্থিরা ১৯শে ফেব্রুয়ারি বাগিছাবাজারে কোনো বাহাস ছিল না বলে দাবি করলেও তারাই আবার সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেছেন, ১৫ই ফেব্রুয়ারি আল-বালাগ তাফসিরুল কোরআন পরিষদের মাহফিলে তারা বাহাসের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং এজন্য থানায় অনুমতিও চেয়েছিলেন। এরপর ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাতে তৌহিদী জনতার উদ্যোগে দেওবন্দি উলামায়ে ক্বেরামের পক্ষে মাইকিংও করা হয়। যদিও তাদের সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন ‘বাগিছাবাজার সংলগ্নমাঠে ১৯শে ফেব্রুয়ারি ঈমান আকিদা বিনষ্টকারী এবং সমাজে চরম উত্তেজনা ও হানাহানি অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এক জরুরি প্রতিবাদ সভার আহ্বান করা হয়। কিন্তু তাদের এ বক্তব্য ও মাইকিংয়ের ঘোষণার সঙ্গে যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান, তা মাইকিংয়ে ঘোষণা শুনেছেন এমন হাজার হাজার মানুষই তার জলন্ত সাক্ষী।
সংবাদ সম্মেলনে মাওলানা হাবিবুর রহমান বলেন, বাহাস’র তারিখ দিয়ে মাইকিং করে যথাসময়ে যথাস্থানে উপস্থিত হতে না পারলে মধ্যস্থতায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছেতো অপারগতার কারণ সংবলিত সংবাদ পৌঁছানো উচিত ছিল। তা না করে ঘটনার ৩দিন পর সংবাদ সম্মেলন করে যে কোনো অজুহাত উপস্থাপন কি অনুপস্থিতির উপযুক্ত জবাব হতে পারে? তাছাড়া ১৯শে ফেব্রুয়ারি বাগিছাবাজার সংলগ্ন মাঠে উপস্থিতির মাইকিং করে বাগিছা বাজারে জড়ো না হয়ে একইদিন প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে ময়নাগঞ্জ বাজারে পরামর্শ সভার জন্য জমায়েত হওয়ার কি যৌক্তিকতা থাকতে পারে? সংবাদ সম্মেলনে তারা ঘোষণা দেন, ‘পুনরায় যদি তাদের বাহাস’র করার ইচ্ছা জাগে তাহলে তাদের উপস্থাপিত নীতিমালা অনুযায়ী বাহাস’র মাধ্যমে সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য বিগত দিনের মতো অপেক্ষায় থাকবো।’
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা লুৎফুর রহমান, মাওলানা মঞ্জুর আহমদ, মাওলানা রফীকুল ইসলাম মুবীন, আলী আনহার শাহান, ফয়জুল ইসলাম, মাওলানা আখতার আলী, মাওলানা আকমল হোসেন শাকুর, ফয়জুল ইসলাম ফয়েজ, নুরুল ইসলাম, আহসান মাহমুদ শিপন, আবদুর রহিম শিকদার, মালেক মিয়া, সাইফুল আলম, সমছু মিয়া প্রমুখ। এদিকে, সিলেটের কয়েকজন বিশিষ্ট আলেম-উলামা গতকাল জানিয়েছেন, বাহাস অর্থ হচ্ছে বিতর্ক। আর বিতর্কের জন্য বিচারকের প্রয়োজন পড়ে। যদি বিচারক ছাড়া বিতর্ক হয় তাহলে সেটি সংঘাতে রূপ নেবে। শান্তিপূর্ণভাবে বিতর্ক বা বাহাস শেষ হবে না। আর ধর্মীয় কোনো বাহাসে অবশ্যই বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন প্রবীণ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম-উলামারা। কিন্তু প্রবীণ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় উলামারা বিভক্ত থাকলে সেখানে বাহাস’র কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে দাবি করেন তারা।
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, সোমবার দৈনিক মানব জমিনে নিউজটি প্রকাশিত হয়।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...