গত ২৩ জানুয়ারি’১৬, শনিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে জাতীয় পত্রিকা ও অনলাইন সম্পাদকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমীমা হোসেন ইসলাম বিদ্বেষী বক্তব্যের মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানেন। ২৩ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আয়োজিত সভায় বক্তব্যে দৈনিক ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমীমা হোসেন বলেন, ‘ফার্মগেটে একটি পার্ক দখল করে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সাথে কয়েকজন মন্ত্রীরও সমর্থন রয়েছে। এভাবে শহরের মধ্যে যেকোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ওয়াজ মাহফিল, তাবলিগ বন্ধ করা উচিত। মসজিদ থেকে মাইকে উচ্চ শব্দে আজান দিয়ে শব্দ দূষণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, যাদের আজান শোনা দরকার তারা প্রয়োজনে মসজিদের সাথে ইলেট্রনিক মাধ্যমে নিজেদের কানে লাগিয়ে শুনতে পারে’।
ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতহানা তার এ বক্তব্য শনিবার ও রবিবার জাতীয় বেশ কয়েকটি দৈনিক ও অনলাইনপোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বৃহত্তম মুসলিম দেশে একজন মুসলিম মহিলা হয়েও তিনি নাস্তিক-মুরতাদদের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্যে প্রদান করলেন যা খুব দু:খজনক। এ বক্তব্য নিয়ে চুলছেড়া বিশ্লেষণ চলছে আলেম-ওলামা, দ্বীনদার বুদ্ধিজীবি, ইসলামী মহল, অফলাইন-অনলাইনে। বিশেষত সোশ্যালমিডিয়ায় (ফেসবুকে) প্রতিবাদ-ক্ষোভের ঝড় ওঠেছে।
অথচ প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন স্থানে নাচ-হিন্দুদের পূজানুষ্ঠানের নামে দিনে-রাতে বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে ঢোল-তবলা। দেশের বিভিন্ন স্থানে পিকআপ- ট্রাকে করে সাউন্ড সিস্টেমের উচ্চ শব্দে ইংলিশ-হিন্দি গানের তালে-তালে নিত্য প্রদর্শন, বিয়ে-শাদি, গায়ে হলুদ, পহেলা বৈশাখ, থার্টিফাস্ট নাইটসহ নানা অনুষ্ঠানে রাতে-দিনে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে গান-বাজনার আয়োজন করা হয়, জনজীবন যখন অতিষ্ঠ করে তুলে তখন তা শব্দ দূষণ হয় না! তা হয় ধর্মীয় উৎসব! তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যখন গানবাজনার মাধ্যমে বিভিন্ন সময় রাজপথ কাঁপিয়ে তুলে, তখন তা শব্দ দূষণ হয় না! শুধু ইসলামী সভা-সমাবেশ, আজান, দাওয়াত-তাবলিগের অনুষ্ঠানের মাইকের আওয়াজই শব্দদূষণ! আজান,ওয়াজ মাহফিল এবং তাবলিগ নিয়ে এমন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্যের নিন্দা জানানোর ভাষা অভিধানে পরাজিত! মন্ত্রীর স্ত্রীর ধর্মবিদ্বেষী বক্তব্য দেশের কোটি কোটি মুমিন মুসলমানদের ঈমানী চেতনায় কঠিন কুঠারাঘাত করেছে! দেশের ধর্মপ্রাণ তাওহিদী জনতা তার অযৌক্তিক নাস্তিক্যবাদী বক্তব্য ঘৃণ্যাভরে প্রত্যাখান করত; ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানায় দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবিতে ফুঁসে ওঠেছেন। রবিবার সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে ইত্তেফাক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদে রাজপথে নামেন তাওহিদী জনতা। ইসলামী নেতৃবৃন্দ, আলেম-ওলামাসহ ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ তার এ বক্তব্য প্রত্যাহার করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহব্বান জানান। সাথে ইসলামের বিভিন্ন পরিভাষা তথা অনুষঙ্গ নিয়ে কটুক্তি করায় পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক পথ থেকে অপসারণের দাবি তুলেন শাস্তিসহ।
বড় চিন্তার বিষয়! একটি মুসলিম রাষ্ট্রে একের পর এক ইসলাম, নবী, মাদরাসা, মসজিদ. আলেম-ওলামা নিয়ে কটুক্তি-ব্যাঙ্গ, অপপ্রচার এটা যেন বিরতি নেই! অথচ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যে বারবার বলেছেন যার যার ধর্মকর্ম পালনে স্বাধিকার রয়েছে। কারো ধর্ম নিয়ে কটুক্তি, ধর্মীয় অনুভূতির উপর আঘাত সহ্য করা হবে না। ধর্মীয় অনুভুতির উপর আঘাত হানার কারণে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নিশ্চিত করবে সরকার! তাহলে প্রধানমন্ত্রীর এ বুলি কার্যকর হলো কোথায়? সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা একের পর একসজিদ-মাদরাসা নিয়ে অপপ্রচার করে চলেছেন! গত ২১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে খাদ্যমন্ত্রী এ্যাড. কামরুল ইসলাম, ২২ জানুয়ারি নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান মিথ্যা ও বানোয়াট বক্তব্য দিয়ে কওমী মাদরাসার অপপ্রচার ও সুনাম ক্ষুণœ করছেন। পরদিন পত্র-পত্রিকায় এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ আলেম ও ইসলামী নেতৃবৃন্দ। বৃহত্তম মুসলমানদের বাংলাদেশে যদি এভাবে ইসলাম-মুসলমান, মাদরাসা-মসজিদ, আলেম-ওলামা নিয়ে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত, অপপ্রচার চলতে থাকে তাহলে এদেশে ইসলাম থাকবে কিনা এমন প্রশ্নের নিশ্চিত জবাব দেয়া দুরূহ ব্যাপার!
সর্বশেষ তাসমিমা হোসেন কর্তৃক ইসলামের বিভিন্ন পরিভাষা নিয়ে মন্তব্য! ইসলামের অন্যতমও অনুষঙ্গ পবিত্র আজান, দাওয়াত-তাবলিগ, ওয়াজ মাহফিলকে বন্ধ করার ঘোষণার এতো বড় স্পর্ধা একজন মহিলার; এটা ভাবিয়ে তুলেছে মুসলিম উম্মাহকে! বৃহত্তম মুসলিম দেশে মহান আল্লাহর বড়ত্বের আওয়াজ আজান নিয়ে মন্তব্য সরাসরি কুরআন-হাদিস বিরোধী।
আজান অল্প কয়েকটি বাক্য হলেও এর মাঝে রয়েছে মুসলমানদের ঈমান-আকিদা সংক্রান্ত একাধিক বিষয়। ‘আল্লাহু আকবার’ আল্লাহর বড়ত্বের বর্ণনার মধ্য দিয়ে আজানের সূচনা হয়। আজানের মাঝ রয়েছে আল্লাহর একত্ববাদের, তাঁর পরিপূর্ণতার এবং সেইসঙ্গে তাঁর শরিকের অস্তিত্বহীনতা, রাসূল সা.’র রিসালাতের স্বীকারোক্তি, নামাজের প্রতি আহবান এবং পরকালীন নাজাতের ঘোষণা। আজানের মাধ্যমে যুগপৎভাবে অর্জিত হয় নামাজের সময়ের ঘোষণা, জামাতের প্রতি আহবান এবং ইসলামের প্রতীকের প্রচার। প্রতিমুহূর্তে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ধ্বনিত হচ্ছে মহান আল্লাহর বড়ত্বের আহবান। লাখো মসজিদের মিনারে ভেসে আসা কিছু নির্ধারিত শব্দগুচ্ছ। আজান নিয়ে কবি-সাহিত্যিকগণ রচনা করেছেন কবিতা-প্রবন্ধ। বাংলা কবিতা আর ইসলামী গানে নানাভাবে এসেছে আজানের কথা। বিশেষত মহাকবি কবি কায়কোবাদ এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক্ষেত্রে বেশি স্মরণীয়। কবি কায়কোবাদ ‘আজান’ নামক কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন আজানের আজমত।
‘কে ওই শোনাল মোরে
আজানের ধ্বনি
মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী
কি মধুর আজানের ধ্বনি’
কবিতায় স্পষ্ট তিনি বুঝিয়েছেন তাঁর হৃদয়ে আজানে ভাবাবেগ তৈরির কথা। কবি নজরুল ইসলামও ‘মসজিদেও পাশে আমার কবর দিও ভাই’ নামক কবিতায় আজানের মাহাত্মের কথা উপস্থাপন করেছেন।
‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।
আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে
পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে
গোর-জাব থেকে এ গুণাহগার পাইবে রেহাই’।
ইসলামে আজানের ফজিলত অপরিসীম। হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সা. বলেছেন, “যখন মোয়াজ্জিন আজান শুরু করেন, তখন শয়তান পালাতে পালাতে রাওহা নামক স্থানে পৌঁছে’। (মুসলিম শরিফ)।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘তুমি যখনই এই পল্লীগুলোতে থাকবে, তখন আজান দেবে। আর আজানে কণ্ঠকে উঁচু করবে। কারণ, আমি নবী করিম সা. কে বলতে শুনেছি, মোয়াজ্জিনের আজানের আওয়াজ গাছ, পাথর, মাটি, মানুষ, জিন যেই শুনবে, সেই কেয়ামত দিবসে তার জন্য আল্লাহর কাছে সাক্ষ্য দেবে’। (সহি বোখারি)
শেষ কথা, ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য বন্ধ হোক, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী ব্যক্তিদের দৃষ্ঠান্তমুলক শাস্তি কার্যকর হাক।
লেখক: সাংবাদিক, আলেম ও কলামিস্ট