আযাদ আবুল কালাম ::
বসন্ত বিকেল, চারদিকে আধাঁর আধাঁর ভাব, বাতাসে মিঠে মিঠে দুষ্টুমি। এই একটু আগে দু-পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল, অকাল বৃষ্টি নয়। লাগছে অকাল অকাল। ধূলোবালিরাও ঠিকমতোন ভিজতে পারেনি। প্রখর রৌদ্রোত্তাপে মাটি পোঁড়ে খা খা করছিল, মাটির গায়ে বৃষ্টির হালকা মিশোলে এক প্রকার ভেজা মোলায়েম গন্ধ বেরুচ্ছে। এ গন্ধ ভারি মজার, মাটির গন্ধ। মাটি আমাদের শরীর, এ আমার নিজ-শরীরের গন্ধ! আহা কত মধুর। কত নিখাদ। কত পুরোনো আবেগের খোয়াবী গন্ধ।
মাটিয়াল গন্ধ শুঁকে শুঁকে হাটছে মেহেদী। এ যেন এক অচেনা পথিকের নিগ্রিত পদচারনা। পায়ে স্পঞ্জের সেন্ডেল। গায়ে কফি রং একটা গেঞ্জি। পরনে সাদা ট্রাউজার। চাদরে গেঞ্জি দেখা যাচ্ছে না। খালি পায়ে হাটার স্বাদ ই আলাদা। আনমনে সেন্ডেলটা খুলে পথের ধারে রেখে দেয়, কোথাও ঝরঝরে ভেজা ধূলো, কোথাও মসৃন ঘাসে আর ঘাসফুলে দলাদলি। অবিশ্রান্ত হেটে যাচ্ছে পথিক। পথিকের হাতে একটি ছেঁড়া চিঠি। চিঠির প্রথমে দু’লাইন দরদী কথা। মধ্যখানে চার-পাঁচ লাইনের একটি সাদা-মাটা কবিতা। শেষে আরো দু’লাইনে ভয়ংকর একটা খবর লেখা আছে। এই ভয়ংকর দুটি লাইন পড়তে পারলেই সবকিছু সহজভাবে বুঝে উঠতে পারবে মেহেদী। টানাটানি করে চিঠিখানার অনেকাংশই ছিঁড়ে গেছে। ভাঁজ ধরেছে। ছেঁড়া চিঠি হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে পথ চলছে মেহেদী। চোখ থেকে টলটল করে পানি ছেড়ে দিয়েছে সে। অবিরাম কাঁদছে। তার কাঁন্না হেনাকে নিয়ে। তার কান্না হেনার পবিত্র আত্নার রোদনে ভেজা এক রিকশাওয়ালাকে নিয়ে।
চিঠিটা পড়ার পর থেকে হাটতে হাটতে শহরে উঠে আসে মেহেদী। সারা শহর ঘুরে ঘুরে ঐ রিকশাওয়ালাকে ফেরি করে ফিরছে সে। চিঠির ভাষা আর বর্ণনার মত একটা রিকশাওয়ালাকেও কোথাও পাওয়া গেল না। হেনা চিঠিখানি মেহেদীকে তুলে দিয়ে বলেছে “ভাইয়া যেভাবেই হোক ওকে খুঁজে দেন ভাইয়া, ওর জিবনটা এভাবে আর নষ্ট হতে দিয়েন না ভাইয়া, আফনে আমার ধর্মের ভাই লাগেন”
হ্যাঁ আমরা কারো ধর্মের ভাই হই। আমাদের ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধই আমাদের চোখ থেকে পানি ঝরায়। রাস্তায় নামায়। রাত বিরাতে কোনো রিকশাওয়ালাকে খুঁজে ফিরে। দুঃখিনী হেনার ছেঁড়া চিঠি পড়তে পড়তে গভীর রাতের দিকে ঠেলে দেয়।
.
রাত প্রায় পৌনে ন’টা বাজে। আকাশে হালকা একটা মেঘের আঁচ দেখা যাচ্ছে। আঁড়াআঁড়ি করে এক পোঁচ জোছনা পেখম মেলেছে। জোছনার পাংশুটে সাদা রংগুলো মেঘের সাথে দোল খাচ্ছে। যেমনি দোল খাচ্ছে রিকশাওয়ালা ফিরোজ মিয়ার জিবনের সাথে হেনার সমস্ত নারী সত্ত্বা।
কে সেই ফিরোজ মিয়া? তার সাথে কিসের এতো নিবিড় দুঃখবোধ মেহেদীর? হেনা মেয়েটা আসলে কে হয় ফিরোজের? সবগুলো প্রশ্নের উত্তর এখন পাঠকের কাছে তুলে ধরি অভিযোগ হিসেবে। বিচার আপনারা ই করবেন!
সারাদিনের ক্লান্তিতে চেহারাখানা কেমন জ্বর জ্বর হয়ে উঠেছে মেহেদীর। গায়ে একটা কালো চাদর, কালোর উপর কড়া হলুদ রংয়ের সুতোয় কাজ করা ছোট ছোট ফুল আঁকা। চাদরখানা ঠিকমতো পরা হয়নি, টেনে টেনে তুলতে হয়, আবার খসে পড়ে। হাটতে হাটতে রাত বারোটার দিকে ষ্টেষনের দিকে ছুটে আসে মেহেদী। দেখে ইষ্টিশনের শেষ মাথায় পুরোনো শীলকড়ই গাছের তলায় একটা মাত্র রিকশা দাড় করানো। পাশে এক মাঝ বয়সী, আসলে মাঝ বয়সী নয়। যুবক। শরীরে একটা ভাঙন আছে। পরিশ্রমের ভাঙন। গ্যাটাপটা পুরো যুবকদের। দূর থেকে দেখা যায় পুরোনো এক ছবি যেন।
রিকশার পাশে ছাঁয়ামূর্তির মত ফিরোজ মিয়া দাঁড়ানো, চারদিক থেকে কূয়াশারা ভিড় করেছে। জোছনা আর আধাঁরের ধুম্র ছাঁয়াতলে একটা জিবন্ত মানুষের কঙ্কাল যেন চোখ রাঙায়ে পৃথিবীকে অভিশাপ দিচ্ছে। একটা কুকুর দূর থেকে হু হু করে উঠছে।
মেহেদী কাছে যায়, দেখে এই সেই চিঠির ছেলে।
“তুমি !!
সত্যি তুমি ফিরোজ মিয়া? আমি তোমাকে খোঁজছিলাম সারা দিনভর, সত্যি কি তুমি ফিরোজ? মানে মাস্টার্স কমপ্লিটেড এ গ্রেজুয়েট পারসন ফিরোজ খাঁন। তোমার তো অনেক ঐতিহ্য আছে। তুমি এক সম্ভ্রান্ত খাঁন পরিবারের ছেলে হও। শুনেছি তুমি মাস্টার্স করেছ? ফিন্যান্সে অনার্স। মানে অর্থনীতিতে অনার্স মাস্টার্স। তারপর রিকশা(?)
ফিরোজ মিয়া গাবড়ে যায়। ভাইজান এসব কি হেনা বলেছে। আর বুঝি কিছু বলেনি। ঘুষের কথা বলেনি? ঘুষ লাগে ঘুষ বুচ্ছেন ভাইজান (!)
তারচে কি রিকশা ভাল না। আমার যে লভিং নেই, ঘুষের জন্য চার-পাঁচ লাখ টাকা নেই। তারপর থেমে যায় ফিরোজ।
রোদ্ধশ্বাসে চেয়ে থাকে একজন কবি, কবিতার লাইন এ্যবড়ে থেবড়ে হয়ে উঠে বেচারার। হেনা স্বপ্ন দেখেছিল ফিরোজকে নিয়ে। ফিরোজ একদিন সোনার হরিণ ধরবে। হরিণের পিঠে চড়ে দু’জন উড়তে উড়তে অনেক দূরে চলে যাবে।
না ফিরোজের মতে সোণার হরিণের চেয়ে রিকশার দৌড় ই বেশ ভাল। কিন্তু হেনা তাতে পুষিয়ে উঠতে পারছে না।
শত শত ফিরোজ আর হেনার এই “না পুষানো” নিয়ে ই মেহেদীর সব দুংখ।
তাই বলে বিচার তো থামিয়ে রাখা ঠিক না। বিচার কর সমাজ!