রশীদ জামীল ::
২৭ ডিসেম্বর,২০১৫ রোববার
-ডাক্তার সাব! আপনার ঋণ তো জীন্দেগীতেও শোধ করতারতাম না।
-কিছুই লাগবে না। খালি কিয়ামতের দিন ‘চিনি না’ কইয়েন না !
…………… কথা বলছিলেন মাওলানা যুবায়ের আহমদ আনসারী এবং ডাক্তার আব্দুল মালিক সাহেব। আনসারীকে দেয়া ডাক্তার আব্দুল মালিকের অসাসধারণ এই জবাব আমাকে মনে করিয়ে দিল আমার উস্তাদ, লেখালেখিতে আমার নির্বারতার উৎস, আমার নির্ভরতার অনুপ্রেরক প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমানকে, যার সংষ্পর্শে মানুষ হওয়া। তিনি প্রায়ই একটি ঘটনা বলেন। যেভাবে সুন্দর করে উপস্থাপন করেন তিনি, আমি সেভাবে বলতে পারব না।
-মদখোর মহাজন তার গোলামকে চার দিনার দিয়ে বাজারে পাঠালো মদ কিনে আনার জন্য। তার হাতে এখন শেষ বোতল। স্টক শেষ হয়ে গেছে।
গোলাম মদ কেনার জন্য বেরিয়ে রাস্তায় একটি জটলা দেখে এগিয়ে গেল সেদিকে। শুনল এক মাওলানা সাহেব একলোককে দেখিয়ে বলছেন, এই লোক চারটি দিনারের জন্য খুব বিপদে পড়েছে। কেউ যদি তাকে চারটি দিনার দিয়ে সাহায্য করেন, আমি তার জন্য বিশেষ চারটি দোয়া করব আর দোয়া করব আল্লাহপাক যেনো চার দিনারের বিনিময়ে তাকে চার হাজার দিনার দান করেন।
গোলাম দেখল কেউ এগিয়ে আসছে না। ভাবল যা আছে কপালে। সে মদ কেনার জন্য নিয়ে যাওয়া চার দিনার তুলে দিল মাওলানার হাতে। তিনি লোকটিকে টাকা দিয়ে বিদায় করলেন। তারপর হাত তুললেন দোয়া করার জন্য। গোলাম বলল,
-হুজুর একটু রাখেন। পাইকারী দোয়া করলে হবে না। কত রিস্ক নিয়ে টাকা দিয়েছি সেটা আমি জানি।
-রিস্ক নিয়া মানে?
-মানে হচ্ছে, এই টাকার মালিক আমি ছিলাম না!
-বলো কী! তাহলে তুমি অন্যের টাকা দিলে কেনো?
-আমি দিয়ে দিয়েছি আপনিও নিয়ে ফেলেছেন। আর আপনিও তো নেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করেননি। এখন কী আর করা! আমিও বিপদে আপনিও বিপদে।
মাওলানা সাহেব পড়লেন চিন্তায়। ভালোই মসিবতে পড়েছেন তিনি। ও আচ্ছা বলা হয়নি, যে মাওলানার কথা বলা হচ্ছে, তিনি ছিলেন বিশ্বখ্যাত ওলি হযরত মালিক ইবনে দিনার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।
-হযরত মালিক ইবনে দিনার বললেন, আচ্ছা বাবা বলো আমাকে এখন কী করতে হবে?
-দোয়াটা করতে হবে আমার অর্ডার অনুযায়ী।
-বলো কী দোয়া করব?
দোয়া নাম্বার ওয়ানঃ
আমি একজনের গোলাম। গোলামী করতে করতে আর ভাল লাগে না। দোয়া করেন আল্লাহ যেনো আমাকে আযাদ করে দেন। মালিক ইবনে দিনার হাত তুললেন।
”ইয়া আল্লাহ! তুমি চাইলে এই গোলামকে আযাদ করে দিতে পারো।
সে বললো, আমিন।
দোয়া নাম্বার টুঃ
‘আপনি বলেছেন, চার টাকার বিনিময়ে আল্লাহ চার হাজার দেবেন। আমি বাকিসিকি মানি না। নগদ চার হাজার চাই’। মালিক ইবনে দিনার হাত তুললেন। ”ইয়া আল্লাহ! তুমি ইচ্ছা করলে তোমার বান্দাকে দুনিয়াতেই চার হাজার দিয়ে দিতে পারো”।
গোলাম বলল, হুজুর আপনার দোয়ায় কবুল কবুল গন্ধ পাচ্ছি।
-তিনি বললেন, তিন নাম্বার বলো।
সে বললো-
নাম্বার তিনঃ
-আমার মালিক মদখোর। তার জন্য একটু দোয়া করুন যেনো আর কখনো মদ না খায়।
-”হে আল্লাহ! এই গোলামের মহাজনকে মদ পান করা থেকে বিরত করে দাও”।
নাম্বার চারঃ
আমার চেহারা ভাল করে চিনে রাখুন। কিয়ামতের দিন ‘চিনি না’ বলতে পারবেন না। কিয়ামতের দিন আমি আমার মালিকের হাত ধরে থাকবো। আপনি যে জান্নাতে যাবেন, আমাকে আর আমার মালিককেও সাথে নিতে হবে।
হযরত মালিক ইবনে দিনার বললেন, ”বাবারে! আমার কোন দশা হবে, আল্লাহপাক আমাকে মাফ করে দেবেন কিনা, সেটাই জানি না, তোমাদের কথা কী বলব”?
-এসব কথায় কাজ হবে না হুজুর। টাকা নিয়েছেন। দোয়া করার কথা। হাত উঠান।
হযরত মালিক ইবনে দিনার হাত তুললেন, ”ইয়া আল্লাহ! তুমি তো জানো, আমি কতবড় গোনাহগার কিন্তু তোমার বান্দার ধারণা আমি জান্নাতে যাব। হে আল্লাহ। তুমি যদি আমাকে জান্নাতে দাও তাহলে তোমার এই দুই বান্দাকেও জান্নাতে দিয়ে দিও”।
গোলাম বলল, আস-সালামু আলাইকুম হুজুর। আল্লাহ্ হাফিজ।
মহাজন অপেক্ষা করছে মদের জন্য। অনেক্ষণ পরে যখন দেখল গোলাম আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে আসছে তাও আবার খালি হাতে, স্বাভাবিক কারণেই মেজাজ ঠিক থাকার কথা না। হুংকার দিয়ে বললো,
-এই ব্যাটা ফাজিলের ফাজিল! কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
-চু-উ-উ-উ-উপ্পপ্পপ্পপ! আস্তে কথা বলো!
যত জুরে ধমকটা দিয়েছিল, তার কয়েকগুণ শক্ত করে জবাব দিল গোলাম। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠল মহাজন! সে ভাবলো, ব্যাটা নিশ্চই মাল কিনে নিজেই খেয়ে ফেলেছে। তা নাহলে আমি মালিকের সাথে এভাবে কথা বলার সাহস দেখাতো না। সুতরাং নেশা কাটার আগ পর্যন্ত একে কিছু বলে লাভ হবে না। গলার স্বর মোটামুটি স্বাভাবিক করে বললো-
-এতো দেরি করলি কেনো? আমি তো ভাবছিলাম কোনো বিপদে পড়লি কিনা!
-একটা জরুরি কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম তাই দেরি হয়ে গেছে। মাফ করে দেন।
– আচ্ছা দিলাম মাফ করে কিন্তু আমার মাল কই?
-মাল কিনতে পারিনি। আপনার দেওয়া টাকা ব্যবসায় লাগিয়ে দিয়েছি!
-ব্যবসায়ীর ঘরের ব্যবসায়ী। এক থাপ্পড় দিয়ে দাঁত …
-‘আগে শুনেন না কোন ব্যবসায় টাকা লাগিয়েছি। তারপর যা যা ফেলার ফেলবেননে। কোনো অসুবিধা নাই। কথা শেষ করার আগেই জবাব দিলো সে।
– মহাজন দাঁত কিড়মিড় করে বললো, আচ্ছা বল।
-চার দিনার দিয়ে চারটি দোয়া করিয়ে এসেছি।
-কী করিয়ে এসেছিস?
-দোয়া।
-ফাইজলামী করার আর জায়গা পাস নাই তুই? টাকা দিয়ে তুই দোয়া কিনে এনেছিস?
-রাগেন কেনো মালিক। যেহেতু টাকাটা আপনার ছিল, তাই দোয়াটা ফিফটি ফিফটি করিয়েছি। অর্ধেক আমার জন্য আর অর্ধেক আপনার জন্য।
মহাজন ভাবলো, যা করার তো করেই ফেলেছে। এখন আর বকাঝকা করেইবা কী হবে। সেইসাথে কিছুটা কৌতূহলি হয়ে উঠল সে। বলল, আচ্ছা কী ঘটনা খুলে বল দেখি। কোথা থেকে কী দোয়া কিনে আনলি তুই?
গোলাম ঘটনা বর্ণনা করে বলল, কিছু মনে করবেন না মালিক। প্রথম দোয়াটি আমি আমার নিজের জন্যই করিয়েছি। আমি দোয়া করিয়েছি, আল্লাহপাক যেনো আমাকে গোলামী থেকে মুক্তি দান করেন।
কথাটি বলার পরই মহাজনের মনে কী যেনো হল। সে বলে উঠল ‘আচ্ছা যা, এই মুহূর্তে তোকে আযাদ করে দিলাম। এবার বল, দ্বিতীয় দোয়া কী করিয়েছিস?
-হুজুর বলেছেন, ‘চার টাকার বিনিময়ে আল্লাহ চার হাজার দেবেন। আমি বলেছি আমি বাকি মানি না। নগদ চাই’। মহাজন অন্য জগতে চলে গেছে। কীভাবে কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না। আল্লাহর ওলির দোয়া বলে কথা। সে ঘরের ভেতরে গিয়ে নগদ চার হাজার দিনার এনে গোলামকে দিয়ে বললো, ‘এই নে। এই তাকা আমি তোকে দিলাম। ফেরত দিতে হবে না। তিন নাম্বার বল।
-এটা আপনার জন্য করিয়েছি মালিক।
-বল আমার জন্য কী দোয়া করিয়েছিস?
-শুনে আবার মার-ধর করবেন না তো?
-না, তুই বল।
-আমি দোয়া করিয়েছি ‘আপনি যেনো মদ ছেড়ে দেন’। হাতে থাকা মদের বোতল ছুড়ে ফেলে দিয়ে মহাজন বললো, ‘কসম আল্লাহর, জীবনে আর কোনোদিন মদের বোতলে মুখ লাগাব না। এবার বল চতুর্থ দোয়া কী ?
-গোলাম বলল, হুজুরকে বলেছি কিয়ামতের দিন আপনাকে আর আমাকে না নিয়ে জান্নাতে যেতে পারবেন না, তিনি রাজি হয়েছেন।
মহাজনের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে আরম্ভ করল। কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো, ‘বাবারে! আমার হাতে যে তিনটি ছিল, আমি তোকে দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এটি তো আমার হাতে নাই। থাকলে আজ আমি এটাও তোকে দিতাম। সাথে সাথে গায়েব থেকে আওয়াজ এলো, ”এই আমার বান্দা! তুই সামান্য একজন বান্দা হয়ে তোর হাতে থাকা তিনটি পূরণ করে দিতে পারলি আর আল্লাহকে কি তুই তোরচে’ও বখিল মনে করিস? যা, তোকে, তোর আযাদ করা এই গোলামকে আর ওই হুজুরকে, তিনজনকেই আমি মাফির ঘোষণা দিয়ে দিলাম।
আনসারীনামায় আনসারীকে রেখে মালিক ইবনে দিনারের গল্প, কারণ, আনসারীকে নিয়ে বিশেষভাবে নতুন কিছু বলার নাই। একটি তথ্য দেয়া যায়। প্রায় দেড়মাস পর গত পরশু বাইরে বেরিয়ে মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ আদায় করে আসলেন তিনি। শারীরিক উন্নতি আশাব্যাঞ্জক। ৬ জানুয়ারি, ২০১৬ ডাক্তার দেখবেন আবার। তখন রেডিয়েশন/কেমো কখন দিতে হবে, সিদ্ধান্ত দেবেন। হয়্তো বলবেন, যান, দেশ থেকে ঘুরে আসেন গিয়ে, মাস খানেক পরে দিলেও হবে। হয়তো বলবেন, একেবারে দিয়েই যান। খামাখা দেরি করার কোনো মানে হয় না।
গতকাল আনসারীকে দেখতে গিয়েছিলেন মাওলানা রফিক আহমদ সাহেব, ছোটখাটো একটা কাফেলা নিয়ে। ফিরলেন রাতে। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে আবার কথাহল অনলাইনে। এদিকে আমরা তিনজন, মাওলানা রফিক সাহেব, হাফিজ আহমাদ আবু সুফিয়ান এবং আমি অন্য প্রান্তে উনি। আমার খুবই আফসোস হচ্ছে ফোনালাপের কথাগুলো লিখতে না পারায়! পার্সোনাল ‘গফসফ’ তো আর বাইরে বলা যায় না। অবশ্য আনসারীকে যারা একান্তভাবে জানেন, তারা বুঝতে পারছেন কথাবার্তার ধরণ কী হয়ে থাকতে পারে! আচ্ছা, একটি কথা বরং বলেই দেই। এটা অতি গোপনীয় ক্যাটাগরিতে পড়ে না।
উনাকে বলাহল, আপনার যখন কিছু দরকার হয় বা তারা আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করে, তখন আপনি কী করেন?
বললেন, কী আর করুম, ইয়েস-নো, যেইটা মুখ দিয়া আয়, একটা কইয়া দেই!
যখন মুখ দিয়ে কথা বলতে পারতেন না, তখন …?
তখন…(সেন্সরড)
নামাজ-বন্দেগির সময় ছাড়া এখন উনার সময় কাটে অনলাইনে। এখন আর ফোনে কথা বলতে বারণও করা হয় না। কথায় আছে, ‘আল ইনসানু হারিসুম-মিম্মা মুনি’আ’, মানুষকে যা নিষেধ করা হয়, সেটার প্রতিই তার বেশি ঝোঁক থাকে। এখানকার সবাই মোটামুটি ইজমায় মত্তফিক হয়ে গেছেন যে, উনাকে যতই বলা হোক, কাজ হবে না। কথা তিনি বলবেনই। কিছু মানুষের জন্মই হয়েছে কথাবলার জন্য! শুধু অনুরোধ করা হয়েছে, ফোনটা কানে লাগিয়ে কথা বলবেন না। হেডফোন ব্যবহার করবেন। এই পরামর্শে অবশ্য আমল করছেন, আলহামদুলিল্লাহ। না করলেইবা কী করার ছিল!