“সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থায় বিবাহ সর্ম্পকিত কোন সাবজেক্ট নেই। আছে নিরাপদ স্যাক্স ভোগের দিকনির্দেশনা। তাই কু-পাত্র আর সু-পাত্র খোঁজার আগে আমাদের সুপাত্র/পাত্রি বানানোর কারখানা তৈরি করতে হবে। মাদরাসা শিক্ষার গণ্ডিকে আরো প্রসারিত করতে হবে। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির গণ্ডির ভিতর যাতে সু-শিক্ষার আওয়াজ পৌঁছে, সেই ব্যবস্থা এখন আমরা চাই।”
খতিব তাজুল ইসলাম::
নিজ ছেলে-মেয়েকে নিয়ে অভিভাবকরা আজ চিন্তিত। ছেলে বিয়ে করতে পারছে না বলে তাদের যতটুকু ভাবায়, তারচে’ হাজারো গুণ বেশি মাথাব্যাথা মেয়েকে সময়মত বিয়ে দিতে না পারার কারণে। উপযুক্ত মেয়েকে উপযুক্ত পাত্রের হাতে তুলে দেয়া একজন অভিভাবকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর এটা তাদের ঐকান্তিক কামনাও বটে। কিন্তু তা যে ঠিকমতো হয়ে উঠছে না। সম্ভব হচ্ছে না। নানান পরিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে চাইলেও পারাযাচ্ছে না। কারণ, একেক দেশ এবং সমাজের একেক রকম সমস্যা। একেক রকম রেওয়াজ। আরব, আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। অর্থই সমস্যার মূল; যদি আমরা অর্থকেই সমস্যার সমাধান মনে করি, এভাবে যদি চিন্তা করি, তাহলে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশে বিবাহ জটিলতা থাকার কথা ছিল না। অথচ বাস্তবে সেসব দেশে অবস্থা আরো প্রকট।
খান্দান সমস্যা
মেয়ে বুড়িয়ে যাক তবুও খান্দানী বড়াই রক্ষা করা পাক! ছেলে-মেয়ে বিয়ে দিতে জাত-পাতের বালাই থাকা চাই। বে-নামাযি, অধার্মিক, অসৎ হোক- তাতে কিছু যায় আসে না। খান্দানী কাঙ্গালীপনায় চিড় ধরে না। কালের বিবর্তনে এই বোকামী দূর হলেও কোনো কোনো ফ্যামেলিতে জগদ্দল পাথরের মতো তা এখনো রয়ে গেছে। খান্দান ভালো হোক, এটা মন্দ নয় কিন্তু কাটায় কাটায় মিলতে হবে- এ কেমন কথা? শেখ, তালুকদার, তফাদার, জমাদার, মজুমদার, চৌকিদার, চৌধুরী, ভুঁইয়া, মির্জা, চাষী, কৃষাণ, জালিয়া, মাইমল, গোলাম, নাপিত আরো কত কিছু! বিলেতে থাকেন এমন কয়েক ফ্যামিলিকে জানি, তারা লন্ডনে এসে নামের শেষে চৌধুরী লেজ লাগিয়েছেন। কারণ, ধনের সাথে জাতের বড়ত্ব না থাকলে কি হয়! আপনি আপনার খান্দানকে গুরুত্ব দিন, তাতে অসুবিধা নেই কিন্তু তা যদি দ্বীনের গণ্ডি পেরিয়ে করতে হয়, বংশীয় কৌলিন্যতাকে এক্ষেত্রে মাপকাঠি মনে করেন, তবে তা নিতান্তই অহমিকার কাজ। সেই খান্দানীপনা শান্তি-সুনাম না হয়ে দোযখের আযাব হয়ে দেখা দিবে। আপনি কবরে, আখেরাতে, দোযখের আগুন চান, না মেয়েটাকে একটু এদিক সেদিক করে বিয়ে দিতে চান কিংবা উপযুক্ত ছেলের জন্য একজন পাত্রি যোগাড় করতে চান? কোনটা করবেন; সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে।
সুন্দর সমস্যা
সুন্দর আকর্ষণীয় হতে হবে। আজকাল গুণের চেয়ে চামড়ার মূল্যই বেশি। এই চামড়া কে বানিয়েছেন? যাকে বানানো হয়েছে তার দোষ, নাকি যিনি বানিয়েছেন তার দোষ? কোনো মানুষ তো সে নিজ থেকে চয়েজ করে সুন্দর হয়ে পয়দা হয় না। স্রষ্টার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপনার কিছু করার আছে? চামড়ার কারণে কাউকে অপমান করা, হেয় করা, ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ আছে? শুধু চামড়াই আমাদের নজরে আসে অথচ একজন মানুষ তার জ্ঞানে-গুণে, আমল-আখলাকের জোরে কত উপরে পৌঁছতে পারে, তার অসংখ্য নজির রয়েছে। বিখ্যাত সাহাবী রাসূলের মুয়াজ্জিন হযরত বিলালে হাবশি রাযি.’র কথা আমরা কে না জানি! অন্তত: মানবতার ধর্ম মুসলিম সমাজে চামড়া নিয়ে মাঠ গরম করার কথা ছিলো না, কিন্তু তাই হচ্ছে।
সাম্প্রদায়িক সমস্যা
জাত-পাত ছাড়াও এলাকাভিত্তিক একটা সাম্প্রদায়িকতা আমাদের মাঝে খুব কাজ করে। সিলেটী, নন সিলেটী, নোয়াখালি, কুমিল্লা, ঢাকা, চিটাগাঙ, শহর-গ্রাম ইত্যাদির ফারাক তো আছেই, সাথে আছে ভাষার তারতম্য। বিভিন্ন এলাকার ছোটখাটো বিভিন্ন ফারাক আছে, সামাজিক আচার-ব্যবহারে কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে। এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে গেলে হয়তো কুলিয়ে উঠা বা মানিয়ে নেয়া কষ্টকর, তাই বলে কারো যদি মিলে যায়, তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়, তখন কেন আমরা তার পিছু নেব? কেন তিরস্কার করবো? পিছনে পিছনে গীবত গেয়ে বেড়াবো?
বিলেতে এসে দেখলাম ১০/১৫ বছর আগে সিলেটী অভিভাবকগণ মেয়ে দিয়ে ভাতিজা, ছেলে দিয়ে ভাতিজিকে নিয়ে আসা কিংবা স্ত্রী ভাবতেন চলো একটা ভাইপুত-বোনজিকে কেন নিয়ে আসি না? এমন সব ঝামেলায় অনেক পরিবার বিরাণ হয়েছে। মেয়েকে জোর করে দেশে নিয়ে বিয়ে দিতেন। ছেলেকে ফুসলিয়ে-ফাসলিয়ে বিয়ে করিয়ে তারপর উধাও। সরকার এখন যেমন কড়াকড়ি করেছে, তেমনি ছেলে-মেয়েরাও হয়েছে সচেতন। তারপরও আছে সমস্যা। বিয়ানীবাজারী নাকি সুনাজগঞ্জী? মৌলভীবাজারী নাকি সিলেটী- এমন আরো কত সাম্প্রদায়িক ঘ্রাণ। যাক, বর্তমানে প্রশ্ন এসেছে- দেখো, মেয়েটা বাংলাদেশি, না পাকিস্তানি না ভারতীয়। অথচ কেউ মুসলমান খুঁজে না। আপনি একটি দেশে বসবাস করলে সেই দেশের সকল নাগরিকদের সম্মান দেখানো উচিত। প্রবাসে কে কোন দেশের, সেটা না দেখে বা দেশে কে কোন জেলার, সেটাও না দেখে পাত্র-পাত্রি মানুষ হিসেবে স্বীকৃত কিনা, সেটা অনুসন্ধান করা দরকার। আমল-আখলাক, চরিত্র-আদর্শের ক্ষেত্রে সে একজন মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ কিনা, সেটা আগে দেখা জরুরি।
একটি মজার ঘটনা
বিলেতের মেয়েকে বাবা তার পছন্দের বাহিরে গিয়ে দেশে নিয়ে ভাতিজার কাছে বিয়ে দিছেন। যাবার আগে বলেছিলেন যে, ওখানে বা কোন খানে বিয়ে দেবার জন্য দেশে যাওয়া নয় নিছক বেড়াতে যাওয়া। কিন্তু দেশে গিয়ে ঘটলো বিপরীত। মেয়ে নিরুপায় হয়ে রাজি হলো তবে বাহিরে ভিতরে নয়। আক্বদের সময় মেয়েটি কাপড়ের নীচে লুকিয়ে রাখলো টেইপ রেকর্ডার। ওখানে অন্য এক মেয়ের কন্ঠে কবুল কবুল রেকর্ড করা। যখন তাকে কবুল বলার জন্য তাকীদ দেয়া হলে সে কেসেটটি প্লে কেবল করলো। সবাই্ খুশীতে আত্মহারা ! কোনরকম মেয়েটি ছেলেটাকে ফাঁকি দিয়ে লন্ডন ফেরত এসে বাবার হাতে কেসেট দিয়ে বললো এই নাও তোমার কবুল আমি বিয়ে করি নাই। বাবা মায়ের কপালে যেন আসমান ভেঙ্গে পড়লো।
মোল্লা মৌলভীর কাছে শুরু হলো দৌড়। এক পর্যায়ে ইমিগ্রেশন লয়ার শাইখ সালেহ হামিদীর কাছে কেইস আসে। আমরা শোনে অবাক হলাম এই সমস্ত কান্ড কারখানা দেখে। হ্যাঁ জোর করলো তো তাই হবে। বাবা আসলে মেয়েকে বিয়ে দেননি; দিয়েছেন বাড়ির সম্পদের কাছে। বিলেতে বসে ইনকাম সাপোর্ট আর নানান কিসিম কিসিম সরকারি খয়রাত আর বেনিফিট এপ্লাই করে দেশে গড়েছেন অট্টালিকা। এসবের মায়া কেমনে ত্যাগ করা যায় বলুন। আমার পরিচিত এমন অনেক আছেন যারা লন্ডনে সরকারি ঝুপড়িতে থাকেন। আর দেশের বাড়ির কোটি টাকার বিল্ডিংগের ছবি পকেটে নিয়ে ঘুরেন। এই হলো অবস্থা।
উচ্চবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত সমস্যা
ধনীর ধন আছে তাই ‘জানাইয়া, হাজাইয়া, সাজাইয়া, বাজাইয়া’ মেয়েকে বিয়ে দেন, ছেলেকে বিয়ে করান। মানুষের বিবেক যে আজ বিক্রি হয়ে গেছে। বিবেক আর কাজ করে না। যে মুসলমানদের নবী বলেন- “তোমার যদি সুযোগ হয়, তাহলে তরকারীতে একটু ঝুল বাড়িয়ে দাও, যাতে প্রতিবেশীর সাথে শেয়ার করা যায়”। নবী সা. আরো বলেন, “তোমার যদি দেয়ার সামর্থ্য না থাকে, তাহলে ফল খেয়ে তার বিচি যেন গরীবের উঠানে ফেলে না দাও, যা দেখে তারা মনোকষ্টে ভোগে।” সেই মুসলমানরা আজ নিজে করে সাজ সাজ রব, পাশে গরীবের যুবতী মেয়ে কুড়ি পেরিয়ে আজ বুড়ি হচ্ছে কিন্তু কারো নজর পড়ে না। ইদানিং অনেক সামাজিক সংগঠন এগিয়ে আসছে। একত্রে গণবিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে অসহায় ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেয়া হচ্ছে। ‘সর্বোত্তম বিবাহ তাই, যাতে খরচ কম হয়।’ তাই এই সামাজিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা পেতে হলে ধনীদের নুংরামী আর গরীবদের গুঙ্গানী দূর করতে হলে আপামর সকলকে এবিষয়ে এগিয়ে আসার বিকল্প নেই।
শিক্ষা সমস্যা
শিক্ষা সমস্যা হওয়ার কথা ছিলনা, কিন্তু আমাদের জন্য যেন শাপেভর করেছে। ছেলে পড়বে মেয়েও পড়েব; পড়ুক- তাতে সমস্যা কি? হ্যাঁ, সমস্যা আমাদের মন-মানসিকতায়। একজন পিএইচডিধারী ডক্টর প্রাইমারী পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে বৈবাহিক জীবন সুখেই কাটাতে পারে, কিন্তু পারে না একজন গ্রাজুয়েট মহিলা ননগ্রাজুয়েট কোনো ছেলেকে নিয়ে সুখে থাকতে। নারী পুরুষের চেয়ে একটু বেশি লেখাপড়া করলেই সেই পুরুষের জীবন যেন বিষিয়ে তুলে এই নারী। তারতম্য আছে স্বীকার করি, কিন্তু সাধারণত: উচ্চশিক্ষিত মেয়েরা স্বামীর নিম্ন শিক্ষার কারণে পদে পদে তাকে অপমানিত করে। অপরদিকে উচ্চশিক্ষিত ছেলের জন্য যত সহজ হয়, মেয়ে যোগাড় করতে তার চেয়ে সত্তরগুণ বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় উচ্চ শিক্ষিত একটি মেয়ের জন্য একটা মানানসই ছেলে যোগাড় করতে। উচ্চ শিক্ষিতা মেয়েকে পুরুষরা বিয়ে করতে ভয় পায় এ কারণে যে, তাকে সামলানো যাবে তো?
আজকাল আবার সেক্যুলার শিক্ষায় গড়ে ওঠা ছেলে-মেয়েরা বিয়ে নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে চায় না। মা-বাবা সন্তানের বিয়ে নিয়ে ভাবলেও তারা বলে যে, আমার এখনো সময় হয়ে ওঠেনি। ২০০৫ সালে বিলেতে আমার এক পরিচিতজনের শিক্ষিত দু’টি মেয়ের জন্য আমার কাছে বরের খোঁজ নিলেন। আমি শুরুতে কয়েকটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু সরলতা বশত: দেখা যায়, প্রতিটি প্র্স্তাবই রিজেক্ট হয় ঘর থেকে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে। পরে জানা গেল, মেয়েরা কাজ করে কামাই করে। মেয়েদের মায়ের হাতেই তাদেও চাবিকাঠি। তিনি বিয়েতে সায় দিলে মেয়েরা চলে যাবে, তখন মাসে মাসে মোটভরা পাউন্ড কে এনে হাতে তুলে দিবে? এভাবে অনেক অভিভাবক সামান্য জাগতিক লিপ্সায় মেয়েদের জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছেন।
২০১৫ শেষ হওয়ার পথে। আমার ঐ পরিচিতজন এখনো আগের মতো বর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আলামত এমন, যেন কবরের টিকেট প্রায় কাটা হয়ে গেছে, তবু বেচারার এই অবস্থা। অভিভাবক এবং শিক্ষিত সন্তানদের যদি ইসলামের বিধি-বিধানের ব্যাপারে সচেতনতা না থাকে, তাহলে এমনটা তো হবেই। সমাজে যিনা-ব্যাভিচারের প্রাদুর্ভাব যত বাড়বে, বিবাহের প্রতি যুবক-যুবতীদের আকর্ষণ ততই শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।
কু-পাত্র/পাত্রি আর সু-পাত্র/পাত্রি বলতে কি বুঝায়?
ইসলামে পার্সোনাল লাইফ বলতে কি বুঝায়- তা শেখার এবং জানার বিষয় আছে। দেখা গেছে, অনেক ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করে ঠিকই, কিন্তু নিজের ধর্ম বিশ্বাসে কিভাবে লাইফকে পরিচালনা করতে হবে, তা জানে না বা জানার সুযোগ হয়ে ওঠে না। ধর্মীয় শিক্ষাগার মাদরাসাকে আমরা স্রেফে কবর আর হাশরের কারখানা রূপে গড়ে তুলেছি। যেখানে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির যুবক-যুবতিদের প্রবেশের সুযোগ নেই। তেমনিভাবে আজকাল দেখা যায় কলেজ ভার্সিটিতে মাদরাসা পড়ুয়াদের ঢুকতে বাঁধা দেয়া হচ্ছে। কিভাবে জীবনটা পুত:পবিত্ররূপে চলবে, চালাবে তাকে তা জানার সুযোগ দেওয়া লাগবে না? সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থায় বিবাহ সর্ম্পকিত কানো সাবজেক্ট নেই। আছে নিরাপদ স্যাক্স ভোগের দিকনির্দেশনা। তাই কু-পাত্র আর সু-পাত্র খোঁজার আগে আমাদের সুপাত্র/পাত্রি বানানোর কারখানা তৈরি করতে হবে। মাদরাসা শিক্ষার গণ্ডিকে আরো প্রসারিত করতে হবে। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির গণ্ডির ভিতর যাতে সু-শিক্ষার আওয়াজ পৌঁছে, সেই ব্যবস্থা এখন আমরা চাই।
আরও পড়ুন- যৌনশিক্ষা ও আমাদের করণীয় (পর্ব- ৭)