ইলিয়াস মশহুদ ::
আজ ৫ ডিসেম্বর ২০১৫। একাত্তরের এই দিনে বীর বাঙালিরা বিজয়ের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। বাংলার আকাশে বাতাসে পাওয়া যাচ্ছিল যুদ্ধ জয়ের সুবাতাস। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মহান বিজয়েরে অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছিল। মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। আখাউড়ায় পাক বাহিনী আত্মসমর্পন করে। ঢাকার আশপাশে গেরিলা বাহিনীর আক্রমণে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী পরাজয়ের দিন গুনতে শুরু করে।
২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত শহীদ হয়েছেন লাখ লাখ বীর বাঙালী। তাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে এদেশের মাটি। রঞ্জিত হয়েছে গ্রামগঞ্জ, শহর-বন্দর, অলিগলি এবং রাজপথ। রক্তরঞ্জিত দিন মাস পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের আজ ৪৪ তম বছরের ৫ ডিসেম্বর।
১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকার আকাশে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথবাহিনীর সাথে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর শেষ মরণপন লড়াই চলে। বিধ্বস্ত হয় পাকবাহিনীর প্রায় সব বিমান। দুপুরের মধ্যেই পাকিস্তান বিমানবাহিনীর শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। বাংলাদেশে আগে থেকে মজুদ করা পাকিস্তানের সব জঙ্গি বিমান ধ্বংস হয়। হত্যা ও ধ্বংসের বিভীষিকায় বিজয়ের দ্বারপ্রান্ত মুক্তিপাগল বাঙালী। চারদিকে বিজয়ের রণধ্বনী। ভারতীয় জঙ্গী বিমানগুলো সারাদিন ধরে অবাধে আকাশে উড়ে পাক সামরিক ঘাঁটিগুলোতে প্রচ- আক্রমণ চালায়, অকেজো করে দেয় বিমানবন্দরগুলো। ভারতের বিমানবাহিনীর হিসাব মতে বারো ঘণ্টায় ২৩২ বারে তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে পঞ্চাশ টনের মত বোমা ফেলা হয়।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দখলমুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দিকে আসতে থাকেন। সম্মুখযুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধেও হারতে থাকে পাকিস্তান। এ সময় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চোখে রাজনীতির এক নতুন প্রেক্ষাপট হয়ে ওঠে যুদ্ধরত বাংলাদেশ। কামান গোলাসহ মারণাস্ত্রের সামনে যার যা কিছু ছিল, তাই নিয়ে বাংলার মুক্তিসেনাদের সম্মুখযুদ্ধ দেখে বিস্মিত হয়ে যায় গোটা বিশ্ববাসী।
সাবমেরিন ‘গাজী’ ছিল পাকিস্তানি নৌবহরের গর্বের বস্তু। বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডের সফল আক্রমণে তা ধ্বংস হয়। সাবমেরিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে পাকিস্তান ধার হিশেবে পেয়েছিল। একাত্তরের এই দিনে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের সকল নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে বন্দর ত্যাগের পরামর্শ দেয়। তারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতেও তাদের অপারগতা প্রকাশ করে। বিশ্বের সব দেশ বুঝতে পারে, বাংলাদেশের বন্দরগুলো রক্ষা করার ক্ষমতা আর পাকিস্তানি বাহিনীর নেই। এদিকে লে. আরেফিনের নেতৃত্বে চালনা নৌ বন্দরে বড় ধরনের আক্রমণ পরিচালিত হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীসহ সকল সৈন্য বন্দর ত্যাগ করে। কোস্টাল গানসহ প্রচুর গোলাবারুদ হস্তগত হয় মুক্তিবাহিনীর।
৭১-এর আজকের দিনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করে পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক রাজনৈতিক নিষ্পত্তি প্রয়োজন, যার অবশ্যম্ভাবী ফল হিশেবে বর্তমান সংঘাতের অবসান ঘটবে। নিরাপত্তা পরিষদের ১১টি দেশের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক পোল্যান্ড এই প্রস্তাবে সমর্থন জানায় কিন্তু চীন তাতে ভেটো দেয়। বাকিরা ভোটদানে বিরত ছিল। ফলে প্রস্তাবটি পাশ হয়নি।
লাখো শহীদের আত্মদান, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী অবদান, ত্যাগ এবং অসংখ্য মা-বোনের মহামূল্যবান সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ নিজের স্থায়ী আসন অর্জন করে নেয় বিশ্বমানচিত্রে।
স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালি জাতি আজ নতুন আশায় বুক বেঁধেছে। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতাকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে দীর্ঘ পথচলায় দুর্নীতি-অপশাসন ও স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির মতো হাজারও জঞ্জালে ভরে যাওয়া স্বপ্নের জাল ঝেড়ে পরিষ্কার করার সময় এসেছে।
তথ্য সহায়তা. উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই।