মওলানা রুমির মসনবি শরিফের প্রথম গল্প এক দাসীর প্রতি এক বাদশাহর প্রেমাসক্তির আলেখ্য। আগেকার দিনে এক বাদশাহ ছিলেন। দ্বীন ও দুনিয়ার বাদশাহী ছিল তার করায়ত্তে। একদিন বাদশাহ শিকারে গেলেন লোক-লস্কর সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু পথিমধ্যে শিকারি বাদশাহ নিজেই শিকার হয়ে গেলেন। পথের ধারে এক রূপসী দাসী দেখে তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লেন। অনেক অর্থকড়ি দিয়ে দাসীকে খরিদ করে আনলেন। কিন্তু হঠাৎ দাসী অসুস্থ হয়ে পড়ল। বাদশাহর হুকুমে দেশের সেরা ডাক্তাররা চিকিৎসা করতে নিজেদের অহঙ্কার দেখালেন। রোগীকে সুস্থ করার ব্যাপারে বাদশাহকে নিশ্চয়তা দিলেন। বললেন না যে, আল্লাহ চাহেন তো রোগী ভালো হবে। ফলে চিকিৎসায় ফল উলটো হতে লাগল। বাদশাহ বুঝতে পারলেন, আল্লাহ নারাজ হয়েছেন তাই এ বিপত্তি। তিনি মসজিদে দৌড়ে গিয়ে মেহরাবে সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। কান্না-আহাজারির ক্লান্তিতে তার ঘুম এসে গেল। এদিকে আল্লাহর রহমতের দরিয়ায় বান ডাকল। তিনি স্বপ্নে দেখেন, এক আগন্তুক বলল, বাদশাহ! আপনার দোয়া কবুল। কাল ভোরে একজন হেকিম আসবেন রাজপ্রাসাদে, তার হাতেই আপনার রোগীর আরোগ্য হবে। সেই হেকিম আল্লাহর এক কামিল অলি।
আনন্দে বাদশাহর ঘুম ভেঙে যায়। রাজপ্রাসাদে ফিরে তিনি অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন গায়েবি হেকিমের আগমনের অপেক্ষায়। মওলানা রুমি (রহ.) এখানে আল্লাহর অলিদের একটি চিত্র এঁকেছেন তাদের বাহ্যিক অবয়ব আর আত্মিক প্রসারতা নিয়ে। গায়েবি হেকিম অলি যখন আসছিলেন, তখন তাকে মনে হচ্ছিল আবছা আলো-অাঁধারির ভেতর দিয়ে যেন ক্ষীণকায় আলোকিত এক মহাপুরুষ এগিয়ে আসছেন। তার সম্মুখ দিয়ে যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে নূরের ঝলক। মেঘের কোলে প্রথম তিথির রুপালি ক্ষীণ একফালি চাঁদ যেন এগিয়ে আসছে ধীর পদক্ষেপে। তখন বাদশাহ আত্মমর্যাদার কথা ভুলে গিয়ে ছুটে গেলেন রাজকীয় নিয়ম ভেঙে। বাদশাহ তখন বললেন, আমার মাশুক তো তুমিই ছিলে, এই (দাসী) নয়,/তবে জগতে এক কাজে লেগে আরেক কাজ জাগে (এটিই হয়)। তুমিই আমার প্রাণের মানুষ, আপনজন। আসলে আমি তোমাকেই চেয়েছিলাম। দাসীর প্রেম উপলক্ষ হয়ে ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে এখন আমি তোমাকে খুঁজে পেয়েছি। ওমর (রা.) যেমন জাহেলি যুগের সবকিছু ছেড়ে মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে নিজকে উজাড় করে দিয়েছিলেন, তেমনি আমিও আপনার খেদমতে উৎসর্গিত হতে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে জানি যে, এ কাজে প্রথম শর্ত আদব। আদব রক্ষা করে যেন চলতে পারি।
বেয়াদবরা আবারও ত্যাগ করল আদব লেহাজ,/ ভিক্ষুকের মতো তুলে রাখা শুরু করল উদ্বৃত্ত খাবার। তাদের প্রতি হুকুম ছিল, তৃপ্তি সহকারে আহার করার পর উদ্বৃত্ত খাদ্য গরিবদের বিলিয়ে দিতে হবে। আসমানি খাবার যেহেতু অব্যাহতভাবে আসতে থাকবে, সেহেতু লোভী ভিক্ষুকদের মতো আচরণ করতে পারবে না, সামনের বেলার জন্য জমা রাখতে পারবে না। কিন্তু তারা আল্লাহর নেয়ামত ও আশ্বাসের সম্মান বজায় রাখেনি। ঈসা (আ.) তাদের খুব নরম হয়ে বুঝালেন যে,/এটা আসতে থাকবে, পৃথিবীতে কমতি হবে না তাতে। বেয়াদবরা আল্লাহর নেয়ামত ও আশ্বাসের বেলায় এতটুকু আস্থা, ভদ্রতা দেখাল না; বরং আল্লাহর নাফরমানি ও কুফরি করল। লোভে অন্ধ সেই ভিক্ষুক স্বভাবের লোকদের কারণে,/রহমতের সেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল তাদের জন্য।
পৃথিবীতে যত বিপর্যয় ঘটে, তার পেছনে প্রাকৃতিক কারণ থাকে, আর প্রাকৃতিক কারণের পেছনে থাকে নৈতিক কারণ। মওলানা এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, জাকাত দেয়া বন্ধ হলে মেঘ বাদল ওঠে না (আকাশে)/ জেনা-ব্যাভিচারের ফলে ছড়িয়ে পড়ে মহামারী চারদিকে, যা কিছু আপতিত হয় তোমার ওপর অাঁধারি দুশ্চিন্তা,/ তাও সেই বেয়াদবি ও ধৃষ্টতার সাক্ষাৎ ফলশ্রুতি।
বেয়াদবির কুফল বর্ণনার পর এখন আদব ও বিনয়ী স্বভাবের সুফল আলোচনা করছেন মওলানা রুমি (রহ.)। আদবের কারণেই নূরে নূর আলোকময় এ নভোম-ল,/ আদবের কারণেই ফেরেশতারা পূতঃপবিত্র নিষ্পাপ। ‘অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন, যা ছিল ধূম্রকু-, অতঃপর তিনি তাকে (আকাশকে) ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে আস ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা এলাম স্বেচ্ছায় অনুগত হয়ে।’ (সূরা ফুসসিলাত : ১১)।
এরই পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ তায়ালা তাতে চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্ররাজি সৃষ্টি করে আলোকময় ও সুশোভিত করেছেন। আদম (আ.) কে সৃষ্টির পর আল্লাহ তায়ালা আদমকে সিজদা করার জন্য হুকুম দিয়েছিলেন ফেরেশতাদের প্রতি। ফেরেশতারা সে হুকুমের সামনে মাথানত করে আদবের পরিচয় দিয়েছিলেন। ফলে তারা সম্মানিত, নিষ্পাপ, মাসুম। বেয়াদবির কারণে সূর্যের গ্রহণ হয়/ বেয়াদবির কারণে আজাজিল বিতাড়িত হয়। আদমকে সিজদা করার হুকুম দেয়ার পর ফেরেশতাদের সর্দার আজাজিল আল্লাহর সঙ্গে যুক্তিতর্কে লিপ্ত হলো। ‘সে বলল, আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ। তুমি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছ আর তাকে সৃষ্টি করেছ, মাটি দ্বারা।’ (সূরা আরাফ ৭ : ১২)।
প্রাচীন সৌরবিজ্ঞানে বিশ্বাস করা হতো যে, সূর্য যখনই তার স্বাভাবিক কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে, তখন গ্রহণের কবলে পড়ে যায়। মওলানা সূর্যের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হওয়াকে বেয়াদবির সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমাদের জীবনে মওলানা রুমির মসনবির এ অধ্যায়টির প্রভাব অনস্বীকার্য।
সূত্র : মসনবি শরিফ, ১খ. বয়েত নং-৬৮, ৬৯, ৭৫, ৭৬, ৭৮-৮৫, ৮৭-৮৯, ৯১, ৯২।
সংগৃহীত পোস্ট