বছরখানেক ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের পরোক্ষ মদদে হিন্দুত্ববাদী সংন্ত্রাসী সংগঠন শিবসেনা, আরএসএস এবং বজরঙ্গী দলের উগ্র নেতাকর্মী ও সমর্থকদের হাতে নিরীহ মুসলমানদের নির্মম প্রাণহানী এবং ধর্মীয় বিধিবিধান পালনে প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে কিছু নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের সংবাদ জেনেছি নিউজ মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে৷
রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত কয়েকজন লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি এই অসহিষ্ণুতা মোকাবেলায় মোদী সরকারের নির্লিপ্ততার প্রতিবাদে নিজেদের পদক ফিরিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন৷ তাতেও সরকার খুব একটা গা করেনি৷ কিন্তু তাদের দিক থেকে অসহিষ্ণুতার ব্যাপারে মদদ স্পষ্ট হয় দিলওয়ালে সুপারস্টার শাহরুখ খান যখন বলেন, “এই ভারত তার নিকট অপরিচিত মনে হচ্ছে৷ তিনি যে হিন্দুস্তানের সাথে পরিচিত, বর্তমান অসহিষ্ণু হিন্দুস্তান তার সাথে মিলছে না৷”
ব্যস হিন্দুত্ববাদী শিবসেনা, মিডিয়া, সরকারের অনুগত সংস্কৃতিসেবী সবাই সমস্বরে শাহরুখের বিরুদ্ধে তোপ দাগলেন৷ কেউ কেউ তো তাকে সোজা পাকিস্তানেও চলে যেতে বললেন৷ বিভিন্ন রাজ্যে তার আপকামিং মুভি নিষিদ্ধ করা হলো৷
কিন্তু ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়ার’ মুখোশ চূড়ান্তভাবে খসে পড়লো মিস্টার পারফেকশনিস্ট আমির খানের মন্তব্যের জেরে৷ একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সামনে আমির খান তার হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী স্ত্রী কিরণ রাওয়ের আতংকিত কথার উদ্ধৃতিতে বলেন “তবে কি আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে৷” কিরণ রাও বর্তমান অসহিষ্ণু হিন্দুস্তানকে তার সন্তানের জন্য নিরাপদ ভাবছেন না৷ এর প্রতিক্রিয়ায় আগুনে ঘি পড়ার মতো অবস্থা তৈরী হলো৷ এবং তাকেও পাকিস্তান চলে যেতে বলা হলো৷ এই পাকিস্তান কার্ডটি ভারত এবং বাংলাদেশের রাজনীতিকরা ভিন্নমতাবলম্বিদের ব্যাপারে নিয়মিত প্রয়োগ করে থাকেন৷ কিন্তু পরদিন আমির খান স্ট্রংলি তার পূর্বের বক্তব্যে অটল থেকে ব্যাখ্যা দিলেন, বললেন তার পুরো বক্তব্য না জেনেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হচ্ছে৷ সর্বশেষ বললেন, “আমার কথার নোতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে অনেকে আমার আগের দিন বলা কথার যথার্থতা প্রমাণ দিয়ে দিয়েছেন৷”
ফেসবুক বন্ধুরা আমির কিংবা শাহরুখকে চলমান বিপদে নিপতিত হওয়া নিয়ে নানা ফতোয়া দিচ্ছেন৷ নিঃসন্দেহে আপনাদের ফতোয়া দেয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে এবং আপনারা অবশ্যই ফতোয়া প্রদানের অধিকার রাখেনও আর বলিউডের খান পদবীধারীরা প্রকৃতপক্ষে কতোটুকু মুসলমান তা নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের যথেষ্ট কারণও রয়েছে৷
তবু আমি শাহরুখ, আমিরকে সশ্রদ্ধ এবং সংগ্রামী সালাম জানাবো৷ কারণ আপনাকে মানতেই হবে যে, বাংলাদেশ এবং ভারতের সামাজিকতায় বিস্তর ফারাক রয়েছে৷ বলিউড স্টার বিশেষত খানদের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে হিন্দুস্তানীরা বিনোদন পেয়ে আসছেন, ভারত সরকার হাজারো কোটি রুপী কর পাচ্ছে, বহির্বিশ্বে ভারতের সেক্যুলার এবং আকর্ষণীয় ভাবমূর্তি তৈরীতে ঐ খানরাই বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন৷ তাদের একেকটি ফিল্ম চারশ থেকে ছয়শ কোটি রুপী প্রফিট এনে দিচ্ছে৷
তারমানে দেশবিদেশে তাদের ফেসভ্যালু অনেক এবং তারা যখন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অন্যায় এবং রাষ্ট্রীয় বৈষম্য নিয়ে কথা বলেন, নানা বিপদের হুমকি এবং সমূহ ক্ষতির ঝুঁকি সামনে নিয়েই কথা বলেন৷ ঠিক যেমনটা এবার শুরু হয়েছে, শাহরুখের বাড়িঘর ঘেরাওয়ের পর এখন লুধিয়ানায় আমীরের শ্যুটিং স্পট অবরোধ করা হয়েছে৷
তাকে একেকটি চড় মারার বিপরীতে লাখো রুপী নগদ এনাম ঘোষণা করা হয়েছে৷ সংসদে ক্ষমতাসীন বিজেপি এমপি মন্ত্রীরা খানদের বিরুদ্ধে কথা বলে ইন্ডিয়ায় অসহিষ্ণুতা নেই দাবী করছে৷ তো কংগ্রেস এবং আমআদমী পার্টি খানদের পক্ষে দাড়িয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের বিশাল সমাবেশে দিদি মমতাব্যানার্জি জোরালোকণ্ঠে তাদের পক্ষে কথা বলেছেন৷(আমরা জানি কংগ্রেস, আমআদমী পার্টি কিংবা তৃণমূলের অবস্থান মুসলিম প্রেম থেকে নয় বরং রাজনৈতিক ফায়েদা হাসিলের জন্য)
কিন্তু একটি কথা মানতেই হবে যে, আমাদের ভাষায় খানেরা মোনাফেক কিংবা তারচেয়েও যতো খারাপই হোকনা কেনো, তারা কিন্তু চলমান সময়ে মুখ খুলে বিশাল সাহসী ভূমিকাই নিয়েছেন৷ বড় বড় প্রডিউসার কিংবা বিখ্যাত নির্মাতা তাদেরকে ভবিষ্যতে তাদের ফিল্মে কাস্ট নাও করতে পারেন, প্রদর্শকেরা নিজ নিজ থিয়েটারে তাদের মুভি নাও চালাতে পারেন, তারপরেও তারা কিন্তু আশি/পঁচাশি কোটি হিন্দুর দেশে(যাদের অধিকাংশই কট্টর হিন্দু) উগ্রবাদী হিন্দুত্ববাদীদের মোকাবেলায় মুসলিম নিগ্রহের বিরুদ্ধে চরম দুঃসাহসী কথাই বলেছেন৷ তারা কেবল নিজ নয় বরং গোটা সমাজ বিশেষত মুসলমানদের কথা ভেবেই মুখ খুলেছেন৷
সর্বশেষ ভারতের গত বছরের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে দারুল উলূম দেওবন্দের ছাদে বসে টিভি সাক্ষাতকারে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ সভাপতি আওলাদে রাসূল হজরত মাওলানা সায়্যেদ আরশাদ মাদানী সাহেবের সেই কথাটির বাস্তবতা পুরোপুরি সঠিক প্রমাণ হওয়ায় তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, আস্থা বহুগূণে বৃদ্ধি পেয়েছে৷ তিনি বলেছিলেন, “মোদী নির্বাচনে জিতলে ভারত আরেকবার বিভক্ত হতে পারে৷”
নিতান্ত পরিতাপের সাথে অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, হায়! হোক না বয়োবৃদ্ধ, তবু তার ন্যায় সাহসী, দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ একজন নেতা যদি বাংলাদেশের আলেম-ওলামারা পেতেন!!
লেখক : ইসলামি রাজনীতিবিদ ও অনলাইন এক্টিভিস্ট