মঙ্গলবার, ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১১:০১
Home / অনুসন্ধান / মাদ্রাসা শিক্ষার অগ্রগতি ও ইসলামী সমাজ বিপ্লব : একটি কৌশল

মাদ্রাসা শিক্ষার অগ্রগতি ও ইসলামী সমাজ বিপ্লব : একটি কৌশল

মুশতাক আহমদমুশতাক আহমদ ::

বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ইসলামী বা দ্বীনি শিক্ষা প্রাচীনতম। হাজারো বছরের ঐতিহ্যে লালিত এই শিক্ষা ব্যবস্থা, পারস্য-ইসলামী সংস্কৃতি বা কালচার থেকে উৎপত্তিত। উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষার রয়েছে আলাদা বিশিষ্ট ও ইতিহাস। পারস্য-ইসলামিক এই শিক্ষা ব্যবস্থার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয় মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে। ইসলামী শিক্ষার প্রসার, উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য ফিরিঙ্গি মহল নামে বিশাল এস্টেট (Estate) ওয়াকফ করেন, তৎকালীন এই দ্বীনদার মোগল সম্রাট। এই ফিরিঙ্গি মহল থেকে সৃষ্টি হয় একদল ইসলামিক স্কলারদের, যারা এখনও ফিরিঙ্গি মহলি নামে পরিচিত। তারা গোড়াপত্তন করেন, দারসে নিজামী নামে উন্নত একটি সিলেবাসের। ১৭ শতকে ইংরেজরা তা গ্রহণ করে কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসার জন্য। ১৯৪৭ সালে এই মাদ্রাসাকে বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। যা বর্তমান মাদ্রসায়ে-আলীয়া ঢাকা নামে পরিচিত।

দারসে নিজামীর রয়েছে প্রধানত: দুটি দিক। একটি মানকুলাত বা ইলমে ওহি অন্যটি মা’কুুলাত বা হিউম্যান সায়েন্স (Human Science) । এই দুটি দিকের সমন্বয়ে দারসে নিজামী উদ্ভাবন করেন ফিরিঙ্গি মহলি স্কলাররা, প্রায় পাঁচশত বৎসর আগে। ১৭৮০ খৃষ্টাব্দে কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রায় ১০০ বৎসর পরে প্রতিষ্ঠিত হয় দারুল উলুম দেওবন্দ্ব, সেখানে দারসে নিজামীর মানকুলাত দিকটি গ্রহণ করা হয়। এই আঁচলে কওমি মাদ্রাসাগুলো এখনো চলে আসছে। আর আলীয়া মাদ্রাসাগুলো গ্রহণ করে মানকুলাত এবং মা’কুলাত, অর্থাৎ উভয় দিকটি। আর এই আদলে গড়ে উঠেছে দেশের আলীয়া মাদ্রাসাগুলো। সময়ের ব্যবধানে আলীয়া মাদ্রসার শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে এক বিপ্লবত্তক পরিবর্তন।

সম্প্রতি ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকার শীর্ষে থাকার পরও নিজস্ব পছন্দের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে পেরে মাদ্রাসার দুজন ছাত্র সরাপন্ন হন দেশের সর্বউচ্চ আদালতের। দায়েরকৃত মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেতে হাইকোর্ট নির্দেশ করে দাখিল ও আলীম স্তরে বাংলা ও ইংলিশ বিষয়ে সিলেবাস পরিবর্তন করনের জন্য। অর্থাৎ উভয় বিষয়ে ২০০ মার্কের পরিক্ষার। হাইকোর্টের নির্দেশে বাধ্য হয়ে সিলেবাসে পরিবর্তন আনতে হয় মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডকে। ২০১৫ সাল থেকে শুরু হবে এই পরিবর্তিত সিলেবাসের আলোকে দাখিল ও আলীমের পাবলিক পরীক্ষা। উল্লেখ্য যে, শুধু বাংলা এবং ইংলিশে নয়, বিজ্ঞান শাখায়ও এসেছে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। বিজ্ঞান শাখায় বিজ্ঞানের প্রতিটি বিষয় (রসায়ন, পদার্থ ও জীববিজ্ঞান) এবং অংক সহ পড়ার সুযোগ রেখে, মানবিক ও বিজ্ঞান শাখায় আইটি (IT) কে আবশ্যিক করে আলিম স্তরে আনা হয়েছে এক সুদূর প্রসারী পরিবর্তন। অবশ্য এই পরিবর্তন সহজে লাভ হয়নি, বহু কাল থেকে এই ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য দাবি চলে আসছিল দেশের বিভিন্ন মহল থেকে। এ নিয়ে বহু আন্দোলন ও সংগ্রাম করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ আদালতের শরনাপন্ন হতে হয়েছে।

যুগান্তকারী এই পদক্ষেপের ফলে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা এখন শুধু স্কুল ও কলেজের সমকক্ষ সিলেবাসের পড়াশুনো করবে না, ইসলামী বিষয়গুলোর সমন্বয়ের কারণে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা এখন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে থাকবে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা এখন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীর ন্যায় দেশের যে কোন প্রতিষ্ঠানে যে কোন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে পারবে। ২০১৫ সাল থেকে  মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের চেয়েও বেশী যোগ্যতা সম্পন্ন হবে। বাংলা এবং ইংলিশে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা স্কুল ও কলেরেজর শিক্ষার্থীর চেয়ে কম পড়েছে, ২০১৫ সাল থেকে আর এই ওযুহাত দেখিয়ে তাদের প্রতি কোন রকম বৈসম্য করা যাবে না। অন্তত : এর আর কোন নৈতিক বা আইনগত ভিত্তি থাকবে না কোন  প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বা অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে।

ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শিক্ষার মূখ্য উদ্দেশ্য হল দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ। কোরআনের ভাষায় “আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাছানা ওয়াফিল আখিরাতে হাছানা”। তাই ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানকুলাত ও মা’কুলাত অর্থাৎ ইলমে ওহি ও হিউম্যান সায়েন্সের সমন্বয়েই গঠিত হয় ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা। আর এই দুয়ের সংমিশ্রণে ইনসানে কামেল সৃষ্টি হয়।

ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা যার মাধ্যমে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকামীদের সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করা সম্ভব। যাতে করে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গনে তারা শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি করতে পারে। তাদের থাকবে একদিকে জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় পারদর্শিতা, অন্যদিকে রাষ্ট্রের মূলযন্ত্র সিভিল সার্ভিসে প্রবেশেরও থাকবে পূর্ণ যোগ্যতা। যার ফলে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের হৃদপিন্ডে তারা গড়ে তুলবে একটি শক্তিশালী অবস্থান। ইসলামী সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব গড়ার জন্য তারা হবে যোগ্যতা-সম্পন্ন। দ্বীনের প্রতিষ্ঠা ও প্রচার, ইসলামী আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিায় এবং ইসলামী সভ্যতার বিকাশ সাধনে তারা হবে অগ্রগামী। এর জন্য প্রয়োজনে এক সূদূর প্রসারী ইসলামী সমাজ বিপ্লবের। আর এই ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ভিত্তি হতে হবে এমন একটি শক্তিশালী শিক্ষা ব্যবস্থার উপর। যার মাধ্যমে সূদূর প্রসারী ইসলামী সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দাখিল ও আলিমের যে পরিবর্তন এসেছে এবং ২০১৫ সাল থেকে সাল থেকে যার বাস্তবায়ন শুরু হবে। এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব একটি ইসলামী সমাজ বিপ্লব সাধন। মানকুলাত ও মা’কুলাত তথা ইলমে ওহি ও জাগতিক জ্ঞানের সমন্বয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার যে উৎকর্ষতা সাধিত হয়েছে এর মাধ্যমেই ইসলামী সমাজ বিপ্লবের স্বপ্নকে একটি মজবুত, শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করানো যেতে পারে। এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইসলামী সমাজ বিপ্লবের কৌশল হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : সংগঠক ও গবেষক, ইউকে প্রবাসী 

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...