হাকীম সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ ::
উলামায়ে কেররামদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন শায়খুল হিন্দ পছন্দ করেন নি। কেন গনমূখি বিপ্লব ছিল শায়খুল হিন্দ দর্শনের মূলমন্ত্র। তা জানতে হলে তার গ্রেপ্তার ও গ্রেপ্তার পূর্ববর্তি সময়টাকে আরো বিশ্লেষণ করা এবং প্রর্যালোচনা করা প্রযোজন। তাহলে ইতিহাসের ফাঁক-ফোঁকর থেকে বেরিয়ে আসবে কিছু অজানা কাহিনী। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ যারা প্রতিষ্ঠা করেন তাদের সিংহভাগই শায়খুল হিন্দের ছাত্র। কিন্তু তারা এমন একটি মুহূর্তে উপমহাদেশের প্রথম ইসলামী রাজনৈতিক দল করেন, যখন স্বাধীন ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা ও আযাদী আন্দোলনের বীরসেনানী শায়খুল হিন্দ বৃটিশদের কারাগারে বন্দি। আর তখন “শায়খুল হিন্দ মুক্তি আন্দোলন” ভারতের আকাশ-বাতাস কম্পিত। আলেমদের বড় একটি অংশ একদফা এক দাবীতে শায়খুল হিন্দের মুক্তির লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। জমিয়তের মতাদর্শি নেতারা ভাবলেন, এভাবে কোন কিছুর সমাধান হবে না। রাজনৈতিকভাবে সবকিছুর সমাধান করতে হবে। তারা বিকল্প ফ্লাটফর্মের চিন্তা করলেন। শায়খুল হিন্দের গেপ্তার ভারতের রাজনীতির সবচেয়ে বড় টানিং পয়েন্ট।
১৯১৬ সালের ১০ জুন তিনি গেপ্তারের পরই ভারতবর্ষের আলেমরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। ভারতের সব এলাকা থেকে একযোগে শায়খুল হিন্দ ও শায়খুল ইসলাম মাদানীর মুক্তির গণদাবী উত্থাপিত হতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে তাদের মুক্তির দাবীতে সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে থাকে। জায়গায় জায়গায় হাজার হাজার জনগণ তার মুক্তির জন্য সরকারের কাছে লিখিত আবেদন করতে থাকে।
এ দিকে ডাক্তার মুখতার আহমদ আনসারী শায়খুল হিন্দের শিষ্যদের নিয়ে শায়খুল হিন্দের মুক্তি গণদাবী পরিষদ গঠন করেন “আন্জুমানে ই’আনাতে নযরবন্দানে ইসলাম” নামে একটি আন্জুমান প্রতিষ্ঠা করেন। (সূত্র,তাযকীরাযে শায়খুল হিন্দ, মুফতি আজিজুর রহমান বিজনৌরী পৃষ্টা২০৫-২০৬)
শায়খুল হিন্দ মুক্তি আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশ ছিলেন সাধারণ শিক্ষিত ও তার দর্শনের পতাকাবাহী। যাদেরকে শায়খুল হিন্দ গণসশস্ত্র বিপ্লবের জন্য কাছে টেনে এনেছিলেন। তিনটি মূলনীতির উপর শায়খুল হিন্দের বিপ্লবিক দর্শন ছিল। তৎকালীন অবস্থা ও পরিবেশের প্রেক্ষাপটে শায়খুল হিন্দ রাহ. সর্বাত্মকভাবে আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য তিনটি প্রধান মুলনীতি নির্ধারণ করেন। এক. উপমহাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ। দুই. সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ। তিন. প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর জন্য নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার পরিপূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা। এই তিনটি মুলনীতির ওপর আস্থা নিয়ে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আন্দোলনের প্রতি হযরতের নিষ্ঠা ও অবিচলতা এতো বেশি ছিল যে, তিনি বলতেন- ‘ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করাকে আমি আমার ঈমানের অংশ মনে করি।’
শায়খুল হিন্দের বিপ্লবিক দর্শন সম্পর্কে জানতে হলে তার শিষ্যবৃন্দ ও খেলাফত আন্দোলন ও জমিয়তের নীতি দর্শন ও আদর্শ জানতে হবে। তাদের সাথে শায়খুল হিনন্দের গ্রেপ্তারের আগে-পরে সম্পর্ক এবং তাদের বিপ্লবিক নানান কর্মকৌশল ও তার প্রভাব পর্যালোচনা প্রয়োজন। শায়খুল হিন্দের বিপ্লবিক দর্শনের শিষ্যদের অন্যতম ১। আজাদী আন্দোলনের বীরসেনানী মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী (মুহাদ্দিস ও হেড মুদাররিস দারুল উলুম দেওবন্দ, সভাপতি জমইয়তে ওলামায়ে হিন্দ)। ২। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী ৩। মাওলানা সাইয়েদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরি ৪। মাওলানা মুফতি কেফায়াতুল্লাহ (সভাপতি জমইয়তে ওলাময়ে হিন্দ) ৫। মাওলানা মুহাম্মদ মিঞা ওরফে (মাওলানা মনসুর আনসারী) ৬। মাওলানা হাবীবুর রহমান (সাবেক মুহতামিম দারুল উলূম দেওবন্দ) ৭। আল্লামা শাব্বীর আহমদ ওসমানী (শায়খুল আদব ওয়াল ফিকহ ও হেড মুদাররিস দারুল উলুম দেওবন্দ, শায়খুল ইসলাম পাকিস্তান ও সভাপতি জমইয়তে ওলাময়ে ইসলাম।) ৮। শায়খুল আদব ওয়াল ফিকহ, মাওলানা মুহাম্মদ ইযায আলী, দারুল উলূম দেওবন্দ। ৯। মাওলানা ফখরুদ্দীন আহমদ (শায়খুল হাদীস জামেয়া কাসেমিয়া, মুরাদাবাদ)। ১০। মাওলানা ইবরাহীন বিলইয়াবী (অধ্যাপক দারুল উলুম দেওবন্দ) ১১। মাওলানা আবদুস সামী (অধ্যাপক দারুল উলুম দেওবন্দ) ১২। মাওলানা আহমদ আলী (মুহতামিম আঞ্জুমানে খুদ্দামুদ্দীন শীরিনওয়ালা, লাহোর। ১৩। মাওলানা মুহাম্মদ সাদে। ১৫। আলী ভ্রাতৃদ্বয মাওলানা মুহম্মদ আলী ১৬। মাওলানা শওকত আলী, ১৭। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, ১৮। ড. এম.এ আনসারী ১৯। হসরত মোহানীর ২০। মাওলানা আযাদ সোবহানী ২১। হাকীম আজমল খান ২৩। নওয়াব ওকারুল মিলুক ২৪।পণ্ডিত মতিলাল নেহারু ২৫। রাজেন্দ্র প্রসাদ ২৬। করম চান্দ মহাত্না গান্ধি ২৭। রাজা সরদার মুহাম্মদ ২৮। ডা. আব্দুর রহমান প্রমূখ।
শায়খুল হিন্দ মুক্তি আন্দোলনের সময় যে আন্দোলনটি তার কতিপয় শিষ্যদের মাধ্যমে সবচেয়ে ব্যপক হয়ে উঠে তা হল খিলাফত আন্দোলন (১৯১৯-১৯২৪)
এ আন্দোলনের পটভুমি ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রভাবে উদ্ভূত একটি প্যান-ইসলামি আন্দোলন। ওসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ (১৮৭৬-১৯০৯) প্যান-ইসলামি কর্মসূচি শুরু করেছিলেন। নিজ দেশে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন নির্মূল করার লক্ষ্যে এবং বিদেশি শক্তির আক্রমণ থেকে তাঁর ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যকে রক্ষা করে বিশ্ব-মুসলিম সম্প্রদায়ের সুলতান-খলিফা’ মর্যাদায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে তিনি এ আন্দোলনের সূচনা করেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে তাঁর দূত জামালউদ্দীন আফগানি প্যান-ইসলামবাদ প্রচারের জন্য ভারত সফর করার পর এ মতবাদের প্রতি কিছু ভারতীয় মুসলমানের মধ্যে অনুকূল সাড়া জাগে।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১), তুরস্কের ওপর ইতালীয় (১৯১১) ও বলকান আক্রমণ (১৯১১-১৯১২) এবং তুরস্কের বিপক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৮) গ্রেট ব্রিটেনের অংশগ্রহণের ফলে বিশ শতকের শুরুতে প্যান-ইসলামি আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয় এবং সেভার্স চুক্তির (আগস্ট ১০, ১৯২০) অধীনে তুরস্কের ভূখণ্ড ইউরোপীয় শক্তিগুলির মধ্যে ভাগ- বাটোয়ারা হওয়ায় ইসলামের পবিত্র স্থানসমূহের ওপর খলিফার অভিভাবকত্ব নিয়ে ভারতে আশংকা দেখা দেয়। এ কারণে তুর্কি খিলাফত রক্ষা এবং গ্রেট ব্রিটেন ও ইউরোপীয় শক্তিগুলির তুরস্ক সাম্রাজ্যকে বাঁচানোর জন্য ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি গোঁড়া সাম্প্রদায়িক আন্দোলন হিসেবে খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়।
আলী ভ্রাতৃদ্বয় মুহম্মদ আলী ও শওকত আলী, আবুল কালাম আজাদ, ড. এম.এ আনসারী ও হসরত মোহানীর নেতৃত্বে এ আন্দোলন সূচিত হয়। উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটি শহরে খিলাফত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রাদেশিক শাখার বিধানসহ বোম্বাই শহরে একটি কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটি গঠিত হয়। শেঠ ছোটানী নামীয় এক ধনী ব্যবসায়ীকে এ কমিটির সভাপতি ও মাওলানা শওকত আলীকে সম্পাদক করা হয়। ১৯২০ সালে আলী ভ্রাতৃদ্বয় খিলাফত ইশতেহার ঘোষণা করেন। কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটি তুরস্কে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সহায়তা দান এবং দেশে খিলাফত আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য একটি তহবিল গঠন করে। এসময়ে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৯১৯ সালের এপ্রিলে সংঘটিত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড এবং ১৯১৯ সালের রাওলাট অ্যাক্টকে সরকারি নির্যাতনের প্রমাণরূপে চিহ্নিত করে এর প্রতিবাদে অহিংস জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ‘সত্যাগ্রহ’ শুরু করেন।
১৯২০ সালের ১২ মার্চ শায়খুল হিন্দ মুক্ত হয়ে খেলাফতের উদ্যোগে আযোজিত, খেলাফত সম্মেলনে যোগ দেন। মাওলানা আযাদ পূর্ব থেকেই কংগ্রেস করতেন। কংগ্রেসে থেকেই তিনি খেলাফতের জন্য কাজ করেছেন। শায়খুল হিন্দ এ সম্মেলনে এলে তাঁর আন্দোলনের প্রতি মুসলমানদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য গান্ধী খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করেন এবং কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটির সদস্য হন। সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নাগপুর সম্মেলনে (১৯২০) গান্ধী ‘স্বরাজ’ কর্মসূচিকে খিলাফত আন্দোলনের দাবির সঙ্গে যুক্ত করেন এবং উভয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য শায়খুল হিন্দ অসহযোগ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
১৯২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে খিলাফত আন্দোলনের প্রতি গান্ধীর সমর্থনের বিনিময়ে খিলাফত নেতৃবৃন্দ গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এভাবে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় একটি সম্মিলিত ফ্রন্ট গড়ে তোলে। জামিয়াতুল উলামা-ই-হিন্দের নেতারা তখন জমিয়তের কাযর্ক্রম স্থগিত করে শায়খুল হিন্দ ও আযাদের সাথে খেলাফত-অসহযোগ সমর্থনও করে কাজ শুরু করেন। জমিয়ত নেতা আযাদ সোবহানী ও ফিরিঙ্গী মহল্লী খেলাফতের কেন্দ্রীয় নিবার্হী কমিটিতে স্থান পান। এতে করে কিছুদিনের জন্য হলেও শায়খুল হিন্দের গণবিপ্লব খেলাফতের ব্যনারে পুরো ভারতে এক স্রোতে মিশে যায়। ঐ কমিটির কেন্দ্রীয নির্বাহি ও সাংবিধানিক কমিটিতে বাংলার মওলানা আকরম খাঁ একজন সদস্য ছিলেন। অবশ্য কিছু বড় ধরনের ঘটনা এ আন্দোলনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অহিংস উদ্দেশ্য সাধনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এসব ঘটনার মধ্যে ছিল ১৯২০ সালে ১৮ হাজার মুসলিম কৃষকের হিজরত, এদের অধিকাংশই ছিল সিন্ধু ও উত্তর পশ্চিম প্রদেশসমূহের অধিবাসী; ভারতকে ‘দারুল হারব’ বিবেচনা করে এ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বাড়াবাড়ি; ১৯২১ সালে দক্ষিণ ভারতে মোপলা বিদ্রোহ; ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মধ্য প্রদেশের চৌরি- চৌরাতে উশৃঙ্খল জনতা একটি থানাতে আগুন দিলে ২২ জন পুলিশের মৃত্যু। এর পরপরই গান্ধি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। এ নিয়ে খেলাফত নেতাদের সাথে গান্ধির ভুল ভূঝাবুঝি ও দূরত্ব তৈরি হয়। খেলাফত নেতারা এটাকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করেন।
১৯১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের একাদশতম অধিবেশনে সর্বপ্রথম খেলাফত আন্দোলনের উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। বাংলা থেকে আগত এ.কে ফজলুল হক সভাপতির ভাষণে পরাজিত ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ভূখণ্ড ভাগবাটোয়ারা করার জন্য ব্রিটেন ও তার মিত্রশক্তিগুলি যে মনোভাব গ্রহণ করে তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্যারিস শান্তি সম্মেলনে (১৯১৯) এ সম্ভাবনা ও উদ্বেগ অনুমোদন লাভ করলে বাঙালি খিলাফত নেতৃবৃন্দ মওলানা আকরম খাঁ, আবুল কাশেম, মুজিবুর রহমান খান কলকাতায় ১৯১৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে এক জনসভার আয়োজন করেন। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা এবং খিলাফতকে রক্ষা করার স্বপক্ষে জনসমর্থন আদায় করাই ছিল এর লক্ষ্য। বাংলায় খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলন (১৯১৮-১৯২৪) একটি গণআন্দোলনে পরিণত হয় এবং এতে হিন্দু ও মুসলমানরা অংশ নেয়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নেতৃবৃন্দের সমন্বিত পদক্ষেপের কারণে বাংলায় আন্দোলন প্রসার লাভ করে। গ্রাম-বাংলায় খিলাফত মতাদর্শ প্রচার করেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। প্রাথমিক পর্যায়ে এ আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলেন বাঙালি নেতৃবৃন্দ মওলানা আকরম খাঁ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মুজিবুর রহমান খান, মুহাম্মদ আবদুল্লাহ-হিল কাফী, মুহম্মদ আবদুল্লাহিল বাকী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, আবুল কাশেম ও এ.কে ফজলুল হক। মাওলানা আকরম খাঁ ও মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী বাংলা সফর করেন এবং বিশেষভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে খিলাফত সভা সংগঠিত করেন। ‘অসহযোগিতা ও আমাদের কর্তব্য’ শীর্ষক নিবন্ধে মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ঘোষণা করেন যে, খিলাফত রক্ষা করা ও স্বরাজ অর্জন করা আমাদের আন্দোলনের দু’টি উদ্দেশ্য এবং এ আন্দোলনকে সমর্থন করা প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের পবিত্র কর্তব্য।
১৯১৯ সালের ১৭ অক্টোবর প্রথম খিলাফত দিবস পালনের সময় কলকাতার অধিকাংশ ভারতীয় মালিকানাধীন দোকানপাট বন্ধ থাকে। বিভিন্ন মসজিদে প্রার্থনা করা হয় এবং সারা বাংলায় জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১৯ সালের ২৩-২৪ নভেম্বর দিল্লিতে বাংলা থেকে আগত এ.কে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে নিখিল ভারত খিলাফত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। খিলাফত সমস্যা ঝুলিয়ে রাখায় প্রস্তাবিত শান্তি সম্মেলনে অংশ না নেওয়া, ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা এবং সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার নীতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯২০ সালের প্রথম দিকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক খিলাফত কমিটি গঠিত হয়। মওলানা আবদুর রউফকে কমিটির সভাপতি, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীকে সহসভাপতি, মওলানা আকরম খাঁকে সাধারণ সম্পাদক এবং মুজিবুর রহমান ও মজিদ বখশকে যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। কলকাতার কলুটোলা স্ট্রীটের হিরণবাড়ি লেনে সংগঠনের কার্যালয় স্থাপিত হয়।
১৯২০ সালের ২৮-২৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতা টাউন হল এ প্রথম বঙ্গীয় প্রাদেশিক খিলাফত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটির কয়েকজন নেতৃত্বস্থানীয় নেতা এ সম্মেলনে যোগ দেন। সভায় উপস্থিত বিশিষ্ট বাঙালি খিলাফত নেতৃবৃন্দ এ.কে ফজলুল হক, আবুল কাশেম, মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যরা খিলাফত সমস্যা সম্পর্কিত দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ ও বয়কট অব্যাহত রাখার কর্মসূচি পুনর্ব্যক্ত করেন। সম্মেলনে ১৯২০ সালের ১৯ মার্চ দ্বিতীয় খিলাফত দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
শায়খিল হিন্দের সাথে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে মাওলানা হুসাইন আহমদ মদনী রহ জমিয়তে উলামায়ে হিন্দে না গিয়ে খেলাফতের ব্যনারে কাযর্ক্রম চালাতে থাকেন। ১৯২১ খৃষ্টাব্দের ৮, ৯ ও ১০ জুলাই তারিখে করাচিতে ‘নিখিল ভারত খেলাফত কমিটি’র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে মাওলানা মাদানী এই প্রস্তাব উত্থাপন করলেন যে,- “যে কোন মুসলমানের পক্ষে বৃটিশ সৈন্যবাহিনীতে চাকুরী করা বা চাকুরীকে উৎসাহিক করা সম্পূর্ণ হারাম। বৃটিশ সৈন্যবাহিনীতে কর্মরত সকল মুসলিম সৈনিকের নিকট একথা পৌঁছিয়ে দেয়া প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য”। সম্মেলনে মাওলানা মাদানীর এই বিপ্লবাত্মক প্রস্তাবটি বিপুল উত্তেজনাপূর্ণ সাড়ার মধ্য দিয়ে গৃহীত হয় এবং মুহূর্তের মধ্যে সারা ভারতে একথা ছড়িয়ে পড়ে। মাওলানা মাদানীর এ প্রস্তাবকে প্রকাশ্য রাষ্টদ্রোহিতা বলে বৃটিশ সরকার ঘোষণা করে এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০, ১৩১ ও ৫০৫ ধারা মতে মাওলানা মাদানী ও মাওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার, মাওলানা শওকত আলী, ডক্টর শায়ফুদ্দীন কিচলু, মাওলানা নিসার আহমদ কানপুরী, পীর গোলাম মুজাদ্দিদ সিন্ধী ও স্বামী শঙ্কর আচার্যের বিরুদ্ধে এক রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক মোকদ্দমা দায়ের করে।
মাওলানা মাদানীর গ্রেফতারী নিখিল ভারত খেলাফত কমিটির সম্মেলন সমাপ্ত হওয়ার পর মাওলানা মাদানী করাচি থেকে দেওবন্দ চলে যান। ১৯২১ খৃষ্টাব্দে ১৮ই সেপ্টেম্বর তাঁর নামে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী হয়। মাদানীর গ্রেফতারী পরওয়ানার কথা প্রচার হওয়া মাত্র সমগ্র দেওবন্দ শহরে স্বতঃস্ফুর্ত ধর্মঘট পালিত হয় এবং অল্পক্ষণের মধ্যে হাজার হাজার লোক তাঁর বাসভবনে এসে জমায়াত হয়। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতার সংঘর্ষের আশংকায় সরকার তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে, পরদিন শহরবাসী শোভাযাত্রা সহকারে মাওলানাকে স্টেশনে পৌছিয়ে দেবে। কিন্তু গভীর রাত্রে দেখা গেলো, একজন গুর্খা ও কতিপয় গোরা পুলিশ কর্মচারি এসে তাঁর বাসভবন ঘিরে ফেলে এবং রাত ৩টার সময় তাঁকে গ্রেফতার করে স্পেশাল ট্রেনে করে নিয়ে যায়। তাতে পরদিন আবার তার গ্রেফতারির প্রতিবাদে ও মুক্তির দাবিতে অন্যান্য শহর সমেত ক্ষুব্ধ জনতা স্বতঃস্ফুর্ত ধর্মঘট পালন করে। আসামীয় কাঠগড়ায় মাওলানা মাদানী ১৯১২ খৃঃ ২৬ শে ডিসেম্বর করাচির খালেকদিনা হলে এই ঐতিহাসিক মোকদ্দমার শুনানী শুরু হয়। আইনগত দিক থেকে এ মোকদ্দমায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ফাঁসি অথবা আজীবন নির্বাসন হবার কথা।
হলের গোটা পরিবেশকে বিভীষিকাময় করে তোলা হয়েছিল। দেড় শত সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী এবং হলের চার পাশে ছিল কাঁটাতারের বেড়া। করাচী শহরের সর্বত্র বৃহদাকারে দণ্ডধারী পুলিশের তৎপরতা। বেলা দশটার দিকে যে কোন ব্যক্তির মনে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। মাওলানা মাদানী প্রমুখ আলেমকে এই বিভীষিকাময় পরিবেশের মধ্য দিয়ে হলে আনা হলো। কিন্তু যাদের উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকার এই ভীতিপ্রদ পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলো তাঁরা এসবকে শিশুর ক্রীড়-কৌতুকের ন্যায় মনে করলেন। তাঁদের সংগ্রাম ছিল ন্যায় ও সত্যের। এসব সিংহদিল মোজাহিদ তার কিছুই পরওয়া করেননি। তাঁরা এটা স্পষ্টই জানতেন যে, যদি ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা তাঁদেরকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলায়, তাতে তাঁরা শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করবেন এবং জাতি পাবে সত্যনিষ্ঠার প্রেরণা; আর এমনিভাবে ভারতের আজাদীর পথ কাফের বিরোধী জেহাদে দ্রুত রূপান্তরিত হবে। নেতৃবৃন্দ মোকদ্দমায় কোন প্রকার আইনজীবী নিযুক্ত করেননি। মওলানা মাদানী ও তাঁর সহকর্মী মওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার ইংরেজ আদালনের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যেই নির্ভীক ও অনলবর্ষী ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে এই ষড়যন্ত্রমূলক মোকদ্দমার রহস্যই কেবল ফাঁস হয়ে যায়নি, এর দ্বারা পাক-ভারতে ইংরেজ সাম্রজ্যবাদের ভিত্তিমূলও কেঁপে উঠে। করাচীতে ইংরেজ কাঠ গড়ায় মওলানা মাদানী ও মওলানা জাোহারের সে-সব অনলবর্ষী ইংরেজ কাঠগড়ায় মওলানা মাদানী ও মওলানা জাওহারের সেসব অনলবর্ষী বক্তৃতা উপমহাদেশের আজাদী সংগ্রামের ইতিহাস চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। আদালতে মওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহারের ভাষণ “যে প্রস্তাবকে বৃটিশ সরকার রাজদ্রোহ বলে অভিযুক্ত করছে, এটা এমন এক মহাপুরুষের আনীত প্রস্তাব, যাঁকে আমি শ্রদ্ধেয় মুরব্বি হিসাবে গ্রহণ করতে গৌরব বোধ করি। তিনি হচ্ছেন হযরত মওলানা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী। ‘ইংরেজ সরকারের পুলিশ ও সৈন্য বিবাগে মুসলমানদের যোগদান হারাম এবং শরীয়ত নিষিদ্ধ’ বলে ফতওয়া ও বিজ্ঞপ্তি সামরিক অফিসার সিপাহীদের নিটক প্রচারিত হচ্ছে জেনে আমার অন্তর আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে”। মওলানা মাদানীর ভাষণ “অত্যাচারী শাসকের সামনে ন্যায় ও সত্য কথা বলাই উত্তম জেহাদ” –এই হাদীসের মর্ম বাণী দ্বারা অনুপ্রাণিত মওলানা মাদানী আদালতের সামনে যেই নির্ভীক ভাষণ দিয়েছিলেন তা হলোঃ “আমি একজন ধর্মানুরাগী ব্যক্তি হিসাবে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের হাদীসের প্রতি রয়েছে আমার অটল ঈমান ও পূর্ণ আস্থা। ‘কেউ ধর্মীয় কাজে বাধার সৃষ্টি করলে কোনোরূপ পরওয়া না করেই তা প্রতিহত করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ’। মহানবীর নির্দেশ হচ্ছে, কোনো শাসক বা রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার তখনই জায়েজ, যদি তাতে আল্লাহর অবাধ্যতা না থাকে। এমন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অধীনে থাকা বা তার আদেশ পালন করা অবৈধ, যারা বা যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশ বিরোধী শাসনকার্য চালায়। ধর্মীয় আলেম হিসাবে সাধারণ মানুষের তুলনায় আমার প্রতি আল্লাহ-রসূলের প্রত্যেকটি হুকুম তামিল করা এবং অন্যের নিকট প্রচার করা অধিকতর কর্তব্য। ধর্মীয় গ্রন্থে রয়েছে, যে ব্যক্তি সত্য গোপন করবে কেময়ামতের দিন তাকে দোযখের জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। কুরআন পাকে কাফের সম্পর্কে কঠোর আযাবের কথা উল্লেখ হয়েছে। কিন্তু যে মুসলমান অপর মুসলমানকে হত্যা করে, তার জন্যে পাঁচ প্রকারের শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে”। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইংরেজ সরকারের পুলিশ বা সৈন্য বিভাগে যোগদান করলে তাকে বাধ্য হয়ে অপর মুসলমানকে হত্যা করতে হয়। তাই আলেম সমাজ ইংরেজ সৈন্যবাহিনীতে কোনো মুসলমানের যোগদান করাকে হারাম বলে ফতওয়া জারী করেছেন। ইসলাম ধর্মমতে এটা হচ্ছে তাদের অপরিহার্য ধর্মীয় দায়িত্ব। সুতরাং করাচী সম্মেলনে যে প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে , সেটা নতুন কিছু নয় বরং তেরশো বছর পূর্বেকার একটি বিশেষ ধর্মীয় অনুশাসনেরই অভিব্যক্তি মাত্র”। “মিঃ লয়েড জর্জ ও মিঃ চার্চিল যখন এ ঘোষণা করেছেন যে, তুর্কী খেলাফতের সঙ্গে তাদের যেই যুদ্ধ, সেটা ক্রুসেডের ধর্ম যুদ্ধ, ইসলাম খৃষ্টধর্মের মধ্যে শেষ বুঝা- পড়ার যুদ্ধ, তখন মুসলমানদের পক্ষে ইসলাম বিরোধী সকল শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা প্রধান ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে”। “উল্লেখ্য যে, এই ধর্মীয় উত্তেজনার ফলেই ১৮৫৭ সালে সারা ভারতের সর্বত্র যখন বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠেছিল, তখন রানী ভিক্টোরিয়া অর্থাৎ ইংরেজ সরকার ভারতীয়দেরকে যে প্রতিশ্রুতি ও সরকারী ঘোষণা প্রচার করে তাদের সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, তাতে উল্লেখ ছিল যে, “কারও ধর্মের উপর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করা হবে না বরং ধর্মীয় বিষয়ে দেশবাসীর পূর্ণ আজাদী থাকবে”। বৃটিশ পার্লামেন্টেও তা স্বীকৃত হয়েছিল। এমনকি পরবর্তীকালে সপ্তম এডওয়ার্য এবং পঞ্চম জর্জও এ ঘোষণা সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সরকার যদি রানী ভিক্টোরিয়া, পরবর্তী সম্রাটগণ ও তাদের পার্লামেন্টের প্রতিশ্রুতি ও ঘোষণার কোনো মর্যাদা না দেন আর ভারতবাসীর ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপকে সঙ্গত মনে করেন, তা হলে এদেশের কোটি কোটি মুসলমানকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হবে যে, তারা মুসলমানকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যে, তারা মুসলমান হিসাবে বেঁচে থাকবে চায়, না নিরেট ইংরেজ বশংবদ প্রজা হিসাবে। ভারতের তেত্রিশ কোটি হিন্দুকেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অবশ্য আমি মুসলমানদের তরফ থেকে ইংরেজ সরকারকে সতর্ক করে দিতে চাই, যদি সরকার ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে, তাহলে মুসলমানরা নিজের ধর্ম রক্ষার খাতিরে জীবন উৎসর্গ করে দিতেও কিছুমাত্র ইতস্ততঃ করবে না। আর এ জন্য আমিই সর্বাগ্রে জীবন উৎসর্গ করতে এগিয়ে আসবো”। এ সময় মওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার শ্রদ্ধাভরে মওলানা মাদানীর পদচুম্বন করে তাঁর প্রতি অকৃত্রিম ভক্তি প্রদর্শন করেন। অতঃপর ১৯২১ সালের ১লা নভেম্বর এই ঐতিহাসিক মোকদ্দমার রায় প্রকাশিত হয়। মওলানা মাদানী ও তাঁর সহকর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ শেষ পর্যণ্ত তাদের ক্ষুরধার যুক্তির সামনে বাতিল হয়ে যায়। এসত্ত্বেও অপর কয়েকটি অভিযোগের অজুহাতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০৫ ও ১০৯ ধারা মতে হযরত মওলানা মাদানী ও তাঁর সহকর্মীদেরকে দু’বছর করে সশ্রম কারা দণ্ডের হুকুম দেয়া হয়। করাচীর মোকদ্দমা চলা কালে দেশব্যাপী উত্তেজনার আগুন প্রজ্জ্বলিত ছিল। যে সত্যের বাণী উচ্চারণ করে মুসলিম ভারতের সংগ্রামী নেতাগণ ইংরেজ নির্যাতনের লৌহ প্রাচীরের অন্তরালে নিষ্পেষিত হচ্ছিলেন, দেশবাসী তা অন্তর দিয়ে উলব্ধি করেছিল এবং প্রতিক্রিয়া হিসাবে সারা দেশে সভা, শোভাযাত্রা ও হরতার পালিত হয়। মূলতঃ এমনিভাবেই উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হতে থাকে। জেলে অবস্থান রত মওলানা মাদানীর কাছে তাঁর সহকর্মীদের পক্ষ থেকে অসংখ্য চিঠিপত্র যেতো, সে সব চিঠিপত্রের জবাব হিসাবে মওলানা সাহেব যে জ্ঞানগর্ভ ও জ্বালাময়ী কথাবার্তা লিখতেন, সেগুলোর সংকলন “করাচীর চিঠি” হিসাবে প্রসিদ্ধ। (হায়াতে মাদানী)
১৯২০ সালের মার্চ মাসে খিলাফত প্রশ্নে আলোচনার জন্য মওলানা মুহম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি খিলাফত প্রতিনিধি দল ইংল্যান্ড গমন করে। এ দলে আবুল কাশেম বাংলা থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন। স্থানীয় খিলাফত কমিটিও গঠিত হয়। কলকাতা খিলাফত কমিটিতে মওলানা আবুল কালাম আজাদ ও মৌলবি আবদুর রহমান যথাক্রমে সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর ঢাকার আহসান মঞ্জিল এ ঢাকা কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি হন খাজা হাবিবুল্লাহ , বিকল্প সভাপতি সৈয়দ আবদুল হাফিজ এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন গোলাম কুদ্দুস। ঢাকা শহরের নাগরিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটি ‘সদর খিলাফত কমিটি’ গঠিত হয়। খাজা সুলায়মান কাদের কমিটির সভাপতি, মওলানা আবদুল জব্বার আনসারী, হাফেজ আবদুর রাজ্জাক, হাফেজ আবদুল হাকিমকে সহ-সভাপতি এবং মৌলবি সামসুল হুদাকে সম্পাদক করা হয়।
১৯২০ সালের ১৯ মার্চ বাংলায় দ্বিতীয় খিলাফত দিবস পালিত হয়। এ দিনে কলকাতার জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে বহুসংখ্যক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সবচেয়ে বড় সভাটি অনুষ্ঠিত হয় টাঙ্গাইলে এবং এতে সভাপতিত্ব করেন উদার জাতীয়তাবাদী মুসলিম জমিদার আবদুল হালিম গজনবী। এ সভায় মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী খিলাফত আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে ‘সত্যাগ্রহ’ অনুশীলনের জন্য জনসাধারণের প্রতি আহবান জানান। কংগ্রেস কমিটিগুলির পাশাপাশি বাংলার অধিকাংশ জেলায় বহুসংখ্যক খিলাফত কমিটি গড়ে ওঠে। এসব কমিটিতে প্রায়শ একই সদস্যের পুনঃ পুনঃ অন্তর্ভুক্তি দেখা যেত। এটা ছিল ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম গণ-আন্দোলন যেখানে হিন্দু মুসলমান সমান উদ্দীপনা নিয়ে অংশগ্রহণ করে। হিন্দু-মুসলিম সংবাদপত্রগুলি আন্দোলনে গণসমর্থন লাভের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব পত্রিকার মধ্যে মোহাম্মদী, আল-ইসলাম, ও দি মুসলমান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মওলানা আজাদ, আকরম খাঁ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, বিপিনচন্দ্র পাল ও চিত্তরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন সারা বাংলায় একটি মুসলিম রাজনৈতিক চেতনাকে বিকশিত করে। খিলাফত আন্দোলন মূলত একটি গোঁড়াপন্থি আন্দোলন হলেও হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমঝোতার ফলে মুসলমানদের মধ্যে উদার মনোভাবের সৃষ্টি করে। কলকাতার কর্মসূচির অনুসরণে বিদেশি পণ্য বর্জন, আদালত ও সরকারি অফিস বয়কট কার্যক্রম জোরদার করার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দানের জন্য গ্রামবাংলায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এসব স্বেচ্ছাসেবকদের চরকায় সুতা কাটা, দেশিয় দ্রব্যাদি জনপ্রিয় করে তোলা এবং খিলাফত আন্দোলনের অনুদান সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করা হয়। ঢাকার কিছু কিছু এলাকায় মুসলিম জমিদারগণ নিজেদের তুর্কি সুলতানের প্রতিনিধি ঘোষণা করে মুসলিম প্রজাদের কাছ থেকে ‘খিলাফত সালামী’ আদায় করেন। জমিদারগণ খিলাফত অবলুপ্তির বহুকাল পরেও প্রজাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এ সালামী আদায় অব্যাহত রাখে।
আন্দোলনের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে বাংলা সরকার ১৯২১ সালের ১৯ নভেম্বর একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে খিলাফত ও কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের কার্যক্রম অবৈধ ঘোষণা করে। সরকারি কর্মকর্তারা খিলাফত অফিসসমূহে হানা দিয়ে দলিল দস্তাবেজ বাজেয়াপ্ত করে, সভা নিষিদ্ধ করে এবং সংগঠনের কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করে। ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর কলকাতায় মওলানা আজাদ, চিত্তরঞ্জন দাস, আকরম খান ও অম্বিকা প্রসাদ বাজপেয়ীসহ প্রায় দেড়শ’ নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এ সঙ্কটময় সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আইন পরিষদ বর্জন প্রশ্লে খিলাফত ও অসহযোগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো মুসলিম নেতা এ ধরনের বর্জনকে মুসলমানদের জন্য আত্মঘাতী বলে মনে করেন।
১৯১৯ সালের ইন্ডিয়া অ্যাক্টে ভারতে স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠানের যে প্রতিশ্রুতি ছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে তারা ওই আইনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। এ গ্রুপের স্বরাজ নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস, বিপিনচন্দ্র পাল, মতিলাল নেহরু, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, আশুতোষ চৌধুরী, আশুতোষ মুখার্জী ও শরৎচক্টদন্ড বস। একই মতাদর্শী বিশিষ্ট মুসলিম নেতৃবৃন্দ ছিলেন এ.কে ফজলুল হক, আবুল কাশেম, খাজা মুহম্মদ আজম, খাজা আফজাল, নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহ, হাকিম হাবিবুর রহমান , সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী , স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, স্যার আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবুবকর সিদ্দিকী, (ফুরফুরার পীর), শাহ আহসান উল্লাহ, কাজেম আলী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা আইন পরিষদে যোগদানের তীব্র বিরোধিতা করেন। খিলাফত আন্দোলন সমর্থক বিশিষ্ট হিন্দু ব্যক্তিত্ব হলেন বিপিনচন্দ্র পাল, শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কামিনী কুমার বন্দোপাধ্যায়, ড. রায় কুমার চক্রবর্তী, পি.সি ঘোষ, বসন্ত কুমার মজুমদার, অশ্বিনীকুমার দত্ত, পিয়ারী লাল রায়, গুরুচরণ আইচ, শরৎকুমার গুপ্ত, কবি মুকুন্দ দাশ, হরনাথ ঘোষ, নগেন্দ্র ভট্টাচার্য, সতীন্দ্র সেন, ড. তারিনী গুপ্ত, সরল কুমার দত্ত, নিশিকান্ত গাঙ্গুলি, মনোরনজন গুপ্ত, শরৎকুমার ঘোষ, নগেন্দ্র বিজয় ভট্টাচার্য, নলিনী দাস, শৈলেন্দ্র নাথ দাস, ক্ষিতিশচন্দ্র রায় চৌধুরী প্রমুখ।
আকস্মিকভাবে খিলাফত আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটলেও এ আন্দোলনের ফলে যে রাজনৈতিক তৎপরতার সৃষ্টি এবং অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় তা ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির পর বাঙালি মুসলমানদের নিকট খুবই মূল্যবান বিবেচিত হয়। বাংলা থেকে খিলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অসংখ্য ব্যক্তিদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (যাঁর আদি নিবাস ছিল পাবনা, পরে টাঙ্গাইল জেলার কাগমারিতে বসতি করেন), জহিরুদ্দীন তরফদার (ময়মনসিংহ), আবুল মনসুর আহমদ (ময়মনসিংহ), আবুল কালাম শামসুদ্দীন (ময়মনসিংহ), হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (কলকাতা), মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ (পাবনা), হাবিবুর রহমান চৌধুরী (কুমিল্লা), আশরাফ উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী (কুমিল্লা), শাহ বদরুল আলম (চট্টগ্রাম), মৌলবি আমান আলী (চট্টগ্রাম), নূরুল হক চৌধুরী (চট্টগ্রাম), মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ (চট্টগ্রাম), কাজেম আলী মিয়া (চট্টগ্রাম), তমিজউদ্দীন খান (ফরিদপুর), পীর বাদশা মিয়া (ফরিদপুর), মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী ওরফে লাল মিয়া (ফরিদপুর), বিচারপতি মোহাম্মদ ইবরাহিম (ফরিদপুর), মজিদ বখশ (বরিশাল), আবুল কাশেম (বরিশাল), খান বাহাদুর হেমায়েত উদ্দীন আহমেদ (বরিশাল), কবি মোজাম্মেল হক (ভোলা), হাশেম আলী খান (বরিশাল), ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী (উলানিয়া, বরিশাল), সুলতান আহমেদ চৌধুরী (বরিশাল), মাজেদ কাজী (কসবা, বরিশাল), খান সাহেব হাতেম আলী জমাদার (বরিশাল), সৈয়দ মুহম্মদ আফজল (পিরোজপুর), ইসমাইল খান চৌধুরী (বরিশাল), মৌলবি মুহম্মদ ইবরাহিম (নোয়াখালী), আবদুল জববার খদ্দর (নোয়াখালী), আবদুল গোফরান (নোয়াখালী), সৈয়দ আহমদ খান (নোয়াখালী), নাসির আহমদ ভূইয়া (নোয়াখালী), সুরেনচন্দ্র দাসগুপ্ত (বগুড়া), হোসেন আহমদ (গাইবান্ধা), রাজিব উদ্দীন তরফদার (বগুড়া), কবিরাজ শেখ আবদুল আজিজ (বগুড়া), ইসহাক গোকুলী (বগুড়া), মওলানা মনিরউদ্দীন আনওয়ারী (দিনাজপুর), সোমেশ্বর প্রসাদ চৌধুরী (বর্ধমান), শাহ আবদুল হামিদ (রংপুর), আফসার উদ্দীন আহমেদ (খুলনা), সুকুমার বন্দোপাধ্যায় (কুষ্টিয়া), মৌলবি শামসুদ্দীন আহমেদ (কুষ্টিয়া), সৈয়দ মজিদ বখ্শ (যশোর) এবং মওলানা আহমদ আলী (খুলনা)। খিলাফত আন্দোলনের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ ছাড়াও এ সময়ে শহর এলাকা এবং প্রধানত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি নতুন মুসলিম নেতৃশ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। জনগণকে সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাঁরা অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। খিলাফত আন্দোলন মফস্বল ভিত্তিক এক নতুন নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি করে। এ নেতৃত্ব বাঙালি মুসলমানদের একটি সমন্বিত আত্মসচেতন রাজনৈতিক পরিচিতি তুলে ধরার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।”
সুত্র, সফরনামায়ে আসসীরে মাল্টা, শায়খুল ইসলাম সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী। সররগুজশতে মুজাহিদ, গোলাম রসুল, কিতাব মন্জিল, লাহোর। তাহরিকে রেশমী রুমেল, মাওলানা আব্দুর রহমান, ক্লাসিক, লোহার। মুসলিম মনীষা, সৈয়দ আবদুল্লাহ।
আরও পড়ুন
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত (১ম পর্ব)
আমাদের স্বাধীনতার লড়াই, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত (২য় পর্ব)
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত। (৩য় পর্ব)