শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৩:৪৪
Home / খোলা জানালা / আবাসন খাতে অভাব মানে ইঞ্জিনিয়ারদের পকেট ফাকা !

আবাসন খাতে অভাব মানে ইঞ্জিনিয়ারদের পকেট ফাকা !

সাইমুম সাদী

ক্রেতার অভাবে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমেছে দেশের আবাসন খাতে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের প্রাণপণ চেষ্টার পরও গত ১ বছরে ঘুরে দাঁড়ায়নি আবাসন শিল্প। ফলে আবাসনের সহযোগী বা লিঙ্কেজ ২৬৯টি শিল্প এখন ধ্বংসের মুখে পতিত। সরকারের বিভিন্ন দফতর ঘুরে হতাশ আবাসন ও সহযোগী শিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, তাদের পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকিতে পড়েছে। সংকট উত্তরণে সরকারকে বারবার বলার পরও ক্রেতাদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ সরবরাহের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে ক্রেতা নেই, বিক্রিও নেই। জানা গেছে, আবাসন ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শিল্প খাতে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের পরিমাণ এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এ খাতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ হাজার কোটি টাকা। আবাসন প্রতিষ্ঠান গুলো গত ২০ বছরে এক লাখ ৬৪ হাজার ফ্ল্যাট হস্তান্তর করলেও এখন তাদের হাজার হাজার ফ্ল্যাট পড়ে আছে ক্রেতার অভাবে। আবাসন খাতে এ সংকটের মূলে রয়েছে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনায় ক্রেতাদের জন্য অর্থায়নের উৎসগুলোতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের আবাসন চাহিদা পূরণের জন্য ঋণের জোগান দিতে ২০০৭ সালের ১৮ জুলাই একটি পুনঃ অর্থায়ন তহবিল চালু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ তহবিলের আওতায় যাদের মাসিক আয় ৫০ হাজার টাকার কম তাদের ফ্ল্যাট কেনার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা হতো।

আবাসন খাতকে ‘অনুৎপাদনশীল’ হিসেবে চিহ্নিত করে ২০১০ সালের ২৬ এপ্রিল তহবিলটি বন্ধ করা হয়। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠান হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন বাড়ি নির্মাণে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১২ শতাংশ এবং এর বাইরে ১০ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে সংস্থাটি এখন খুব বেশি ঋণ দিতে পারছে না। আবাসনশিল্পের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতের অসহযোগিতাই আবাসন খাতের প্রধান সংকট। এ খাতে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি না থাকলেও ব্যাংকগুলো ঋণ দেয় না। দেশের স্বল্প আয়ের মানুষদের সিঙ্গেল ডিজিট হারে ঋণ দেওয়া হলে আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াবে। এ প্রসঙ্গে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, আবাসন খাতের অবস্থা ছয় মাস বা এক বছর আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। এ খাতের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। সংকট উত্তরণে সরকারকে বারবার বলার পরও ক্রেতাদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। ক্রেতারা স্বল্প সুদে ঋণ না পেলে কোনো দিনও ফ্ল্যাট কিনতে পারবেন না। বিশ্বের সব দেশেই ক্রেতাদের জন্য এ সুবিধা আছে বলেও দাবি করেন তিনি।

এদিকে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওয়েবসাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মালয়েশিয়ায় গৃহঋণের সুদের হার গড়পড়তা ৬ শতাংশ। ওই দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৪ দশমিক ৩৯ থেকে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ হার সুদে গ্রাহকদের গৃহঋণের অফার দিচ্ছে। জাপানে ২ থেকে ৩ শতাংশ সুদে আবাসন ঋণ পাওয়া যায়। এমনকি প্রতিবেশী ভারতে ঋণের সুদ হার ১০ শতাংশ বা এর নিচে। বিশ্বে আবাসন খাতে সুদের হারের এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে উচ্চ সুদহার এবং প্রকাশ্য ও গোপন নানা চার্জ ও প্রসেসিং ফির কারণে আবাসন ঋণ মধ্যবিত্ত গ্রাহকদের জন্য সহনীয় নয়। আবাসন ঋণে ব্যাংকগুলোর ঘোষিত সুদের হার ১২ থেকে সাড়ে ১৯ শতাংশ। কিন্তু বিভিন্ন চার্জ ও প্রসেসিং ফি মিলিয়ে এ হার বাস্তবে ১৬ থেকে ২২ শতাংশ পর্যন্ত। এমন উচ্চ সুদের ব্যাংকঋণ নিয়ে বিপাকে ব্যবসায়ীরা। সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ঋণ না পাওয়ায় ক্রেতাদেরও আগ্রহ অনেক কম। ফ্ল্যাট ও জমির রেজিস্ট্রেশন ব্যয় বেশি হওয়ার হতাশা তো আছেই। সব মিলিয়ে দেশে আবাসনের সহযোগী বা লিঙ্কেজ ২৬৯টি শিল্পেও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যবসার অবস্থা খুবই নাজুক হওয়ায় আবাসন খাতে নিয়োজিত প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন যাপন করছেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। রিহ্যাবের হিসাব অনুযায়ী, আবাসন কোম্পানি গুলোতে ২০ হাজার নির্মাণকাজ ব্যবস্থাপক, ১০ হাজার ডিপ্লোমা প্রকৌশলী, তিন হাজার স্নাতক প্রকৌশলী এবং প্রায় ৫০০ স্থপতি নিয়োজিত আছেন। আবাসন খাত ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল এক সহযোগী শিল্প ও ব্যবসায়িক কর্মযজ্ঞ। এ খাতের ওপর নির্ভর করছে ছোট-বড় ২৬৯টি শিল্প খাত। এসব খাতে দুই হাজারেরও বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট, স্টিল ও রি-রোলিং মিলস, ইট, বালু, রং, টাইলস ও সিরামিকের বিভিন্ন পণ্য,বিভিন্ন ধরনের পাইপ, ফিটিংস, কেবলস, কাচ ও কাচজাতীয় অন্যান্য পণ্য, পাথর ও পাথরজাত পণ্য, পেইন্ট, লোহাজাতীয় বিভিন্ন পণ্য, আসবাবপত্র ও কাঠজাত বিভিন্ন পণ্য, প্লাইউড, কেব্ল্, বৈদ্যুতিক ফিটিংস ও অন্যান্য সামগ্রী, নির্মাণকাজের যন্ত্রপাতি, আঠাজাতীয় বিভিন্ন পণ্য, স্টিলজাত পণ্য, অ্যালুমিনিয়াম পণ্য ইত্যাদি। এর মধ্যে অনেকগুলো শিল্পই আবাসন খাতের ওপর শতভাগ নির্ভরশীল। এর সঙ্গে নির্মাণশ্রমিক ও দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থানের গুরুত্বের দিকও অপরিসীম। আবাসন খাতে জড়িতদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, আবাসন শিল্পের বর্তমান সংকট দূর করতে হলে সরকারের দিক থেকে বেশ কিছু নীতিগত ও আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলোঃ-
১.অর্থায়ন সংকট কাটাতে ব্যাংকঋণের সুদের হার অবশ্যই যৌক্তিকভাবে সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগী হয়ে সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিতে হবে অতিরিক্ত সুদ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অযৌক্তিক ও অতিরিক্ত চার্জ দূর করতে হবে।
২.সুদহারের পাশাপাশি ঋণ পরিশোধের সময়কাল বা মেয়াদ যৌক্তিক করতে হবে। মাসিক কিস্তি মধ্যবিত্ত ও নির্ধারিত আয়ের মানুষের জন্য সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। আবাসন খাতে অর্থায়ন সমস্যা দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃ অর্থায়ন তহবিলটি পুনরায় চালু করা জরুরি।
৩.আবাসন শিল্প চাঙ্গা করতে রিহ্যাব সরকারের কাছে ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের যে দাবি করেছে, তা ক্রেতাদের এক অঙ্কের সুদে দীর্ঘ মেয়াদে দিতে হবে। পূর্তমন্ত্রী নিজেও এ দাবির পক্ষে মত দিয়েছেন। এখন প্রয়োজন সরকারের বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। পাশাপাশি-
৪.আবাসন খাতকে ‘অনুৎপাদনশীল’ খাত হিসেবে চিহ্নিত করার মতো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দূর করতে হবে।
৫.আবাসন প্রকল্পে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ প্রদানের প্রক্রিয়া সহজ এবং দ্রুততর করতে হবে। এসব বিষয়ে সরকারের নীতিগত পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। রিহ্যাব জানিয়েছে, স্বাভাবিক অবস্থায় আবাসন কোম্পানিগুলো প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার ফ্ল্যাট ও পাঁচ হাজার প্লট হস্তান্তর করেছে। সেখানে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিন বছরে হস্তান্তর করেছে মাত্র পাঁচ হাজার ৬৩৩টি। অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকঋণ সুবিধা না বাড়ায় ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে না। সমস্যা সমাধানে সরকারের দিক থেকে নীতিগত সহায়তা জরুরি হলেও উল্টো ফ্ল্যাট নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) ফি আট গুণ করা হয়েছে। প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি আগে ছিল ২৫০ টাকা, বর্তমানে তা দুই হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে একটি ফ্ল্যাট নিবন্ধন করতেই এলাকাভেদে তিন থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের জন্য নিজের ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন আরও ফিকে হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে উৎসে আয়কর বৃদ্ধি করায় বর্তমানে নিবন্ধন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশ। অথচ ভারতে ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি মাত্র ৬ শতাংশ। দেশে ভোক্তা অধিকার নিয়ে আন্দোলনরত কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্যমতে, ঢাকা নগরীর ৭০ শতাংশ মানুষ তাদের আয়ের ৬৫ শতাংশ বাড়িভাড়ায় ব্যয় করেন। বছর দশেক আগে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার ছিল ১৫ থেকে ২০ ভাগের মধ্যে। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৪০-৪৫ ভাগে। জমির স্বল্পতা, আইনি জটিলতা, দুর্বল পরিকল্পনা, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সর্বোপরি নীতিগত সমর্থনের অভাবে এখানে অপরিকল্পিত নগরায়ণও বাড়ছে। সংকুচিত হচ্ছে নগরবাসীর সুবিধা।

লেখক : গবেষক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

বিকৃত যৌনতায় দিশেহারা জাতি: সমাধান কোন পথে?

শাইখ মিজানুর রাহমান আজহারী: বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ধর্ষণ হচ্ছে। নারীকে বিবস্ত্র করা ...