বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সন্ধ্যা ৭:৪২
Home / অনুসন্ধান / প্রিয় উস্তাদ ! মুহাদ্দিসে কাবীর হযরত নোমান আহমদ: কিছু স্মৃতি কিছু কথা

প্রিয় উস্তাদ ! মুহাদ্দিসে কাবীর হযরত নোমান আহমদ: কিছু স্মৃতি কিছু কথা

মামুনুল হক

মুহাম্মদ মামুনুল হক্ব::

১৯৮৮সালের কথা ৷ আমরা হযরত শায়খুল হাদীস রহঃ এর নেতৃত্বে জামিয়া রাহমানিয়ার স্থায়ী নিজস্ব ভূমির সন্ধানে মোহাম্মদী হাউজিং থেকে সাত মসজিদ এলাকায় স্থানান্তর হই ৷ ঐতিহাসিক সাত মসজিদ লাগোয়া জমিটি জামিয়ার জন্য কেনার উদ্যোগ নেয়া হয় ৷ আর অস্থায়ীভাবে নূর হোসেন সাহেবের নির্মাণাধীন বিল্ডিং এবং সাত মসজিদ সংলগ্ন টিনসেড ঘর তৈরি করে মাদরাসার কার্যক্রম চালানো হয় ৷ ঐ সময়ে আমরা নাহবেমীর জামাতে পড়ি ৷ টিনসেডের ঘরে বেড়ার পার্টিশন দিয়ে একেক জামাতের জন্য আলাদা আলাদা ঘর তৈরি করা হয় ৷ আমাদের বেড়ার অপর প্রান্তেই ছিল জালালাইন জামাতের অবস্থান ৷ জামিয়ার জন্য তখন নতুন শিক্ষকের প্রয়োজন ৷ রাহমানিয়া মাদরাসায় তখন শিক্ষক রাখার পদ্ধতি ছিল প্রাথমিক তথ্য যাচাই ও মৌখিক ইন্টারভিউয়ের পর মূল পর্ব হলো পরীক্ষামূলক সবক পড়ানো ৷ আমরা নিচের জামাতের ছাত্র হিসাবে তত কিছু বুঝতাম না ৷ শুধু শুনলাম দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে ফারেগ অনেক যোগ্য একজন নতুন শিক্ষক নিয়োগের আলোচনা চলছে ৷ তাঁর সবক জালালাইনে ৷ আমরা নাহবেমীর জামাতের ছাত্ররা তত কিছু না বুঝলেও জালালাইনের সেই সবকের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতাম ৷ আর চমৎকার উপস্থাপনার ভঙ্গি তন্ময় হয়ে উপভোগ করতাম ৷ কখনো কখনো এমন সাধও মনে জাগতো, আহা যদি এই উস্তাদের কাছে আমাদের দরস হতো! কিন্তু আমাদের নিচের জামাতে এত বড় উস্তাদের সবক হবে না মনে করে হতাশ হতাম ৷ আর অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকতাম, আমরা যখন উপরের জামাতে উঠব তখন হুজুরের কাছে পড়ব ৷
এভাবেই হযরত নোমান সাহেব হুজুরের প্রতি ভিন্ন এক ভালো লাগার অনুভূতি মনে স্থান করে নিয়েছিল ৷ হুজুরের পড়ানোর স্টাইল ভালো লাগত তখন থেকেই ৷ এরপর তো এক সময় হুজুরের কাছে পড়ার স্বপ্ন পুরন হলো ৷ নূরুল আনোয়ার, সুল্লামুল উলূম, শরহে আকাইদ আর সর্বশেষে তিরমিযী শরীফ ২য় খণ্ডের সবক পড়ার সৌভাগ্য হাসিল হলো আলহামদুলিল্লাহ ৷

হুজুর লেখালেখি করতেন ৷ নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে নতুন প্রজন্মের যে সকল আলেম লেখালেখির জন্য কলম হাতে তুলে নিয়েছিলেন, নোমান সাহেব ছিলেন তাদের অন্যতম ৷ বাংলা ইসলামী সাহিত্যের কিংবদন্তি মাওলানা মহিউদ্দিন খান সাহেব এই নবীন প্রজন্মকে লেখালেখির পথ দেখাতেন ৷ শিখিয়ে দিতেন লেখালেখির কৌশল ৷ নোমান সাহেব ছিলেন সেই কাফেলার এক উজ্বল নক্ষত্র ৷ বাংলা ভাষায় ইলমে দ্বীনের খেদমত করার অদম্য স্পৃহা নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন এ পথে ৷

হুজুর আমাদেরকে স্বপ্নের কথা শোনাতেন, ওলামায়ে কেরাম যেন বাংলা লেখালেখিতে এমন এগিয়ে আসে যে, বাংলা কোনো বইয়ে হাত দিলেই যেন কোনো আলেমের লিখিত বই হাতে উঠে আসে ৷ কোনো ছাত্র লিখতে চেষ্টা করলে হুজুর খুব উৎসাহ দিতেন ৷ সহযোগিতা করতেন ৷ নিজেও প্রচুর লিখতেন ৷ এমন একটা সময় ছিল যে, মাদরাসার কোনো ছুটি মানেই নোমান সাহেব হুজুরের নতুন কোনো বই প্রকাশ হওয়া ৷ একটা পর্যায়ে এসে হুজুর মাদরাসার পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত কিতাব সমূহের ব্যখ্যাগ্রন্থ রচনা ও অনুবাদের কাজে হাত দেন ৷ এই কাজে হুজুরের পারঙ্গমতা এতটাই বেশি ছিল যা এক কথায় বিস্ময়কর ৷ আশ্চর্য দ্রুততার সাথে বিশেষত অনুবাদের কাজ করেছেন হুজুর ৷ হুজুরের দক্ষতা এমন পর্যায়ে পৌছেছিল যে, উর্দূ-আরবী কিতাব হাতে নিয়ে অনর্গল অনুবাদ বলে যেতেন আর দ্রুতগতির কম্পোজার তা কম্পোজ করে দিত ৷ ব্যস এরপর শুধু প্রুফ চেক করে দিলেই পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে ছাপার উপযুক্ত হয়ে যেত ৷ হুজুর দাওরা হাদীসের ছয় কিতাবেরও ব্যখ্যার কাজ করেছেন ৷ এত দ্রুত এই কাজগুলো করেছেন, দেখে মনে হত হুজুরের কোনো তাড়া আছে ৷ আসলেই তো তাড়া ছিল মালিকের দরবারে চলে যাওয়ার! কিন্তু আমরা তখন বুঝতে পারিনি ৷

সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙ্গে হুজুরের চলার গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে গিয়েছিল ৷ অন্যথায় বেশ দ্রুতগতিতে চলতে অভ্যস্ত ছিলেন হুজুর ৷ হুজুরের সেই চলার ভঙ্গিমাও ছিল চমৎকার ৷ আজও চোখে ভাসে, সাত মসজিদের পাশ দিয়ে বিদ্যুৎবেগে ছুটে চলছেন তিনি ৷ হয়তো যাচ্ছেন কোথায় কিংবা ফিরছেন কোনো জরূরী কাজ সেরে ৷

আরবী সাহিত্যে উচ্চাঙ্গের দক্ষ ছিলেন হুজুর ৷ আমাদের জামিয়ায় কোনো বড় আলেম মেহমান বিদেশ থেকে তাশরীফ আনলে হুজুর তার জন্য মানপত্র রচনা করতেন ৷ দেওবন্দের শাইখুল হাদীস হযরত সাঈদ আহমদ পালনপুরীর শুভাগমনে হুজুর যে মানপত্র উপস্থাপন করেছিলেন তার শব্দমালা এখনও যেন আমার কানে গুঞ্জরিত হয় ৷

আব্বাজান হযরত শায়খুল হাদীস রহঃও হুজুরকে খুব ভালোবাসতেন ৷ অনেক সময় নিজে কোনো মাহফিলে যেতে না পারলে স্থলাভিষিক্ত হিসাবে নোমান সাহেব হুজুরকে পাঠিয়ে দিতেন ৷ হুজুরের আলোচনার ভঙ্গিও ছিল ব্যতিক্রম ও আকর্ষনীয় ৷

বহুগুণের অধিকারী আমার প্রিয় উস্তাদে মুহতারাম হযরত নোমান সাহেব মাত্র ত্রিশ বছরের মত সময়ে এত অবদান রেখে গেছেন যা বিস্ময়কর ৷ অবশেষে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন ৷ তখনও তিনি আপন গতিতে চালিয়ে গেছেন কাজ ৷ একাধিক মাদরাসায় সিনিয়র মুহাদ্দিস বা শায়খুল হাদীস হিসাবে দরস দানের পাশাপাশি লিখে গেছেন বহু দরসী ও গায়রে দরসী গ্রন্থ ৷
জীবনের শেষ সময়গুলো কেটেছে অসুস্থতার মাঝে ৷ দীর্ঘ দীর্ঘ সময় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে থেকেছেন ৷ জীবন সায়াহ্নে স্মৃতিও অনেকটা বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল ৷ আমি ১৪ই অক্টোবর হজ্বসফর থেকে ফিরে দেখতে গিয়েছিলাম হুজুরকে ৷ দুচারটি অপরিচিতের মত কথা হয়েছিল তখন ৷ সেটাই ছিল হুজুরের সাথে আমার আখেরী সাক্ষাত ৷ আজ আমি যখন মাহফিলের উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহের পথে রওয়ানা হয়ে অনেক দূর পথ চলে এসেছি, মোবাইল ফোনে পেলাম হুজুরের মৃত্যুর শোকসংবাদ ৷ রাত সাড়ে দশটায় সাত মসজিদে জানাযার এন্তেজাম, সেটাও জানলাম ৷ কিন্তু এতদূর থেকে মাহফিল শেষ করে ফেরাও সম্ভব হলো না ৷ অগত্যা ভগ্নহৃদয়ে মুক্তাগাছার মাহফিলে উপস্থিত শত শত ইসলামপ্রিয় আলেমদের মুহিব্বীন মানুষদেরকে নিয়ে সূরা ফাতেহা আর সূরা এখলাস তেলাওয়াত করে হাদিয়া পৌঁছে দিলাম ৷ দোয়াও করলাম হুজুরের মাগফিরাত ও দরজাবুলন্দীর জন্য ৷ কবূল কর মালিক ইয়া আরহামাররাহিমীন ৷ আমীন ৷

লেখক: শাইখুল হাদিস তনয়, বিশিষ্ঠ্য ইসলামি চিন্তাবিদ,মুহাদ্দিস ও সুলেখক।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

আল্লামা আহমদ শফীকে কি আসলেই তিলে তিলে হত্যা করা হয়ছে?

আল্লামা শফী সাহেবের মৃত্যু নিয়ে ওনার খাদেম  শফীর সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০। ...