আল্লাহ প্রদত্ত্ব আইন: যেহেতু জীবন জিজ্ঞাসার সত্যিকার কোন জবাব মানব মস্তিস্কপ্রসূত আইনে অনুপস্থিত অথচ এর মাধ্যমেই মানবিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। আর যেখানে মূল্যবোধ নেই, সেখানে আইনাদর্শ নেই। যেখানে আইনাদর্শ নেই, সেখানে কোন আইন থাকতে পারে না। আইন সেখানে প্রহসনে পর্যবসিত হতে বাধ্য। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে প্রয়োগের গুণে যদিও আইন সচল, কিন্তু তা মানবজীবনের কোন সন্তুষজনক পরিণতি নির্দেশ করতে পারছে না। অপরদিকে তৃতীয় বিশ্বে আইনাদর্শের সংঘাত আইনের শাসনের সৃষ্ট বিকাশ বিঘ্নিত করেছে এবং আইনের নামে জারি করেছে এমন কর প্রহসনমূলক আইনের হাট, যেখানে বিচারের রায় বেচা-কেনা থেকে নিয়ে বিবিধ ধরণের জালিয়াতি চলতে থাকে।
ইসলাম এজন্যই বলে যে, মানবজাতির জীবনযাত্রার বিধিব্যবস্থা নির্দেশ করবেন সৃষ্টিকর্তা। যিনি প্রত্যেক মানুষের স্বভাব চরিত্র, অতীত বর্তমান ভবিষ্যত এবং পৃথিবীর প্রতিটি পরিবর্তনের ধরণ ও মাত্রা আর এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত। তার প্রবর্তিত আইন হবে, তার বড়ত্ব, প্রজ্ঞা ও পূর্বাপর সকল বিষয়ের জ্ঞানের প্রতিচ্ছবি। সেটা হবে প্রকৃতির অন্যসব নিয়মের মতো, দিন রাত্রির বিবর্তনের শৃঙ্খলার মতো, চন্দ্র-সূর্যের শাশ্বত আইনের হতো, পৃথিবীর সব পরিবর্তনকে স্বীকার করেও যা নিত্যনতুন , চির আধুনিক, প্রত্যহ অপরিহার্য এবং সতত চিরন্তন। পৃথিবী যতই পাল্টাক, গ্রহ- নক্ষত্রের নিয়ম পাল্টাবে না। বৃষ্টির যে কানুন, মানবসন্তান জন্মের যে নীতি, এগুলো প্রাকৃতিক আইন, জীবনযাত্রার মান ও মাত্রায় শত পরিবর্তনেও এগুলোতে পরিবর্তনের কিছু নেই। মানবস্বভাবের স্বাভাবিকতার সাথে সঙ্গতিশীল, মানুষের সহজাত চেতনা ও গতিশীলতার ধারক, জীবনীসত্যের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যবস্থা হলো ইসলাম। প্রকৃতির অন্য দশটি আইনের সাথে ইসলামের এই প্রতিতুলনা আবেগের তাড়নাবশত নয়; বরং এটা বুঝাতে যে, ইসলামের মূলনীতিমালা মানবজীবনে অন্তরাত্মা ও সৃষ্টিগত স্বাভাবিকতার ধারক, একান্তই বাস্তবভিত্তিক। এগুলো সরাসরি আল্লাহকতৃক প্রদত্ত।
আল্লাহ স্বয়ং এই নীতিমালা দান করলেন এবং ঘোষণা করলেন- ‘এই নীতির কোন পরিবর্তন নেই’। এটাই ছিল স্বাভাবিক। কেননা যেহেতু তিনি রব বা পালনকর্তা, তাই তার রবুবিয়্যাতের শর্ত হলো তিনি তার মারবুব তথা যাদেরকে লালান পালন করবেন, তাদেরকে শুধু সৃষ্টি করার দ্বারাই রবুবিয়্যাতের দায়িত্ব শেষ করবেন না বরং দুনিয়ার বুকে তাদেরকে লালন- পালনের পাশাপাশি জীবনযাপনের জন্য আত্মিক ও ব্যবহারিক প্রতিটি ক্ষেত্রে কি কি নীতিমালা ও চিন্তা চেতনার অনুবর্তিতা তারা করবে- তার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবেন। সেখানে অতি অবশ্যই মানুষের জীবনজিজ্ঞাসার জবাব থাকবে, আইনাদর্শ থাকবে, থাকবে মানবস্বভাবের স্বাভাবিকতার ধারক এক উন্নত মূল্যবোধ। ইসলামে এর সবটাই পরিপূর্ণতার সাথে নিশ্চিত রয়েছে। জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বান্দা কি কি আইন-কানুন মেনে চলবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তা নির্দেশ করেছেন। যেহেতু তিনি রব তাই তার ঘোষণা- ‘আইনদানের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর’।
রাসূলের সা. দায়িত্ব: জীবনযাপনের জন্য আল্লাহ প্রবর্তিত এই বিধিব্যবস্থার বাস্তব প্রয়োগ ও মানুষকে এর অনুবর্তি করে তোলার কর্মসূচী নিয়ে পুতঃপবিত্র সত্ত্বা, প্রজ্ঞার আধার ও ইনসানিয়াতের পরিপূর্ণ রূপরেখা জীবনে ধারণকারী এক জামাতের আবির্ভাব পৃথিবীতে ঘটেছে। যে জামাতের পূর্ণতাসাধনকারী হলেন হযরত মুহাম্মদ সা.। তার মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত বিধিব্যবস্থার পূর্ণতা সাধিত হয় এবং এর প্রায়োগিক অবয়ব ও সম্পূর্ণতা লাভ করে। কিতাবুল্লাহর মাধ্যমে আগত যে আহকাম, সেগুলোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত ছিল নবীজির জীবন ও সাধনা। সেই বিধিব্যবস্থার শিক্ষাদান, প্রচার ও প্রতিষ্ঠার গুরুদায়িত্ব ছিল তার উপর ন্যস্ত। কুরআন বলছে- ‘আল্লাহপাক তিনিই যিনি উম্মতের মধ্যে তাদেরই একজনকে পাঠিয়েছেন রাসূলরূপে, যে তাদের নিকট আবৃত্তি করে তার আয়াত, তাদেরকে মন্দ চরিত্র থেকে পবিত্র করে উত্তম চরিত্র দ্বারা সুসজ্জিত করে, তাদেরকে আল্লাহর কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়, ইতোমধ্যে তো এরা ছিল ঘোরবিভ্রান্তিতে’। আলোচ্য আয়াতে রাসূলের সা. চারটি দায়িত্ব নির্দেশ করা হয়েছে।
১. আল্লাহ প্রেরিত ওহী হৃদয়ে ধারণপূর্বক অন্যদের পাঠ করে শুনানো এবং প্রয়োজনীয় বিষয়ে আমলী দৃষ্টান্তসহকারে অন্যদের শিখানো। (‘এয়াতলু আলাইহিম আয়াতিহ’ এর মর্মার্থ এটাই )।
২. আত্মার পরিশুদ্ধি তথা তাযকিয়ায়ে নফস। মানবিক মনগঠন তথা উৎকর্ষ সংস্কৃতির বুনিয়াদ তৈবী করা। চারিত্রিক কদর্যতা দূরীভূত করে মানুষের জীবনাচারকে মহোত্তম গুণাবলী দ্বারা সুশোভিত করা মানুষকে মানবীয় মহিমার শ্রেষ্ঠত্বে উপনীত করা।
৩.আল্লাহর কিতাব শিক্ষা দেয়া তথা মানবিক জীবনযাপনে খোদাপ্রদত্ত নীতিমালা ও বিধিবিধান মানুষের হৃদয়ঙ্গম করানো এবং এর উপর আরোপিত সংশয়, সন্দেহ ও অভিযোগসমূহের অপনোদনপূর্বক এর তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক প্রতিষ্ঠার ভিত্তিগঠন।
৪. হিকমাত শিক্ষা দেয়া। অর্থাৎ কিতাবুল্লাহর আয়াতসমূহ থেকে যে সকল বিধিবিধান নির্গত হয়, সেগুলোর উল্লত তথা কার্যকারণ বুঝিয়ে দেয়া।
জীবনযাপনের নীতিমালার ভিতরগত কারণ সম্পর্কে শরীয়ত মানুষকে অন্ধকারে রাখতে চায় না। এ কারণে হুজুর সা. এর দায়িত্ব এটাও ছিল যে, তিনি বিধিবিধান সমূহের ইল্লত জানিয়ে দিবেন। এছাড়া এই ইল্লতসমূহ অনুধাবন করতে পারার উপর নির্ভর করছে শরীয়তের নস থেকে আহকামাত উন্মোচন ও মাসআলা নির্গত করা।
মূলনীতি ও কার্যকারণ : কুরআন-হাদীস কেবলই মূলনীতি বর্ণনা করে। হয়তো সেটা ক্ষুদ্র কোন হুকুমের অবয়বে কিংবা ক্ষুদ্র বা বিশেষ কোন পরিপ্রেক্ষিতকে উপলক্ষ্য করে। বাহ্যত তাকে ক্ষুদ্রজলাশয় মনে হলেও তার মধ্যে নিহিত থাকে সুবিশাল এক সমুদ্র। সংক্ষিপ্ত আয়াত বা হাদীসের মধ্যে সংগুপ্ত থাকে এমন কার্যকারণ, যা জীবনের বিশাল বিশাল দিগন্তকে নিজের আওতায় নিয়ে নেয়। এরকম কার্যকারণ থেকে শরীয়তের কোন নসই শূণ্য নয়। কার্যকারণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকুক বা নাই থাকুক, কিংবা সেটা উদঘাটিত হোক বা এখন পর্যন্ত অনুদঘাটিত থাকুক। নসের মধ্যে ইল্লত যে আছে, আছেই। এ বিষয়ে শায়খুল ইসলাম কাসিম নানুতাবী রাহ. তার ‘আবে হায়াত’ গ্রন্থের শুরুতে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে কুরআন-হাদীসের প্রতিটি হুকুমই কার্যকারণ সমৃদ্ধ। প্রত্যেকটির মধ্যেই ইল্লত বিদ্যমান। ফলে প্রতিটি ক্ষুদ্র একক পরিণত হয়েছে বৃহতে, সংক্ষিপ্ত বিষয়েও ঢুকে পড়েছে ব্যাপক সারাসার। তবে সিয়াম অবস্থায় ভুলবশত পানাহার জাতীয় ব্যতিক্রম কিংবা কোন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বস্তুর সাথে সংশ্লিষ্টতা ছাড়া অন্যান্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই ব্যাপকতা প্রযোজ্য হবে। যেমন কুরআনে কারীমে ওযু ভঙ্গের কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে- ‘আওজা-আ আহাদুম মিনকুম মিনাল গা-ইথ্’ এই আয়াত ছোট্ট একটি বিধান বলে মনে হলেও এর মধ্যে যে ইল্লত আছে, তা ব্যাপক, বিস্তীর্ণ পরিসরের ধারক।
এই আয়াতে ওযু ভঙ্গের কারণ উল্লেখ করা হলেও ইমাম আবু হানিফা রাহ. এর মতে আয়াতের মূল ইল্লত হচ্ছে শরীর থেকে নাপাকী নির্গত হয়ে গড়িয়ে পড়া। ইমাম শাফেয়ী রাহ. এর মতে মূল ইল্লত হচ্ছে সাবীলাইন (প্রস্রাব পায়খানা রাস্তা) দিয়ে কোন নাপাকী বের হওয়া । এ ভিত্তিতেই ওযু ভঙ্গের কারণসমূহ তারা নির্ণয় করেছেন। হাদীস শরীফে গম, যব ইত্যাদির উল্লেখ করে বলা হয়েছে এ সমস্ত লেনদেনের সময় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সমানে সমানে আদান-প্রদান করতে হবে। আদন-প্রদান করতে হবে হাতে হাতে। বেশকম বা বাকি হলেই সুদ হয়ে যাবে। ফুকাহায়ে কেরাম এই নির্দেশের ইল্লত অনুসন্ধান করেছেন। ইমাম মালিক রাহ. খাদ্য বানানো ও প্রয়োজনের সময় গচ্ছিত রাখাকে ইল্লত সাব্যস্ত করেছেন। ইমাম শাফেয়ী রাহ. সাব্যস্ত করেছেন আহার্য ও মূল্যবান হওয়াকে। ইমাম আবু হানিফা রাহ. ওজন ও পরিমাপের বস্তু হওয়া এবং একই প্রকারের বস্তু হওয়াকে ইল্লত সাব্যস্ত করেছেন । ইল্লত অনুধাবনের পর হুকুম ব্যাপক হয়ে যায়। তা আর এ ছয়টিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং যত জিনিষের মধ্যেই এই ইল্লতের উপস্থিতি থাকবে , প্রত্যেকটির উপরই উপরোক্ত হুকুম প্রযোজ্য হবে। (চলবে)
আরও পড়ুন :