সাম্প্রতিককালে একটা বিষয় তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের মুখে বেশ উচ্চারিত হচ্ছে। আর তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানবকল্যাণে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে হবে। এটা বামপন্থি একটা দলের অবিরাম শ্লোগান। আর এখানে দেশপ্রেমিক বলা হচ্ছে একমাত্র সেই একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা এবং এদেরই সন্তানেরা। বাকিরা নয়।
পক্ষান্তরে বর্তমানকালে দলীয় কারণে মুক্তিযোদ্ধা নয় বা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান নয় অথবা আলিম-ওলামা কিংবা আরো যারা ইসলামপ্রিয় সরলমনা এমন লোকদের বলা হচ্ছে দেশদ্রোহী বা মুক্তিযুদ্ধ চেতনায় অবিশ্বাসী প্রকৃতির লোক। এরাই আজ দেশদ্রোহী, দেশদ্রোহীদের সন্তান। এরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিশ্বাসী। এরা বাংলার স্বাধীনতাকামি নয়। ওদের এদেশে থাকার কোনো অধিকার নেই এ কথা পর্যন্ত বলা হচ্ছে।
অথচ, এ বাংলার প্রতিটি মানুষ স্বীয় মাতৃভূমিকে মায়ের চোখে দেখে এসছে। এ দেখাতে কারো কোনো ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লেশমাত্র নেই, থাকছে না বা থাকবেও না। কিন্তু একটা বামপন্থিদল রাজনৈতিকভাবে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে আরেকটা দলকে প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে। বিশ্বের সামনে তাদের দেশদ্রোহী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে কোনো কৃপণতা করছে না বিন্দুমাত্র। ঐ ইসলামবিদ্বেষি রাজনৈতিক দলটি সকলকে একই অপরাধের দায়ে দায়ি দেখিয়ে জেল-জুলুম এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছে নির্মমভাবে। এদের অপরাধ কী? তেমন কিছুই না। অপরাধটা হলো,তাদের বিপক্ষের লোক বটে, তাই।
পাঠক বন্ধুরা! নিশ্চয় এখানে রাজনৈতিক বামপন্থি দলটির নাম উল্লেখের প্রয়োজন মনে করছি না। কারণ, জ্ঞানীদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। ওদের বিরোধী যারাই হোন, তারাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এমনকি একজন আল্লাহওয়ালা মানুষকে পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে না নির্যাতনের বেলায়। দেশে নির্যাতনের চরম অপমানজনক দৃষ্টান্তু স্থাপনের জন্য এরচে জঘন্যতম অপরাধ আর কী হতে পারে, বলুন তো দেখি আপনারা?
যে সমস্ত ওলামায়ে কেরাম এবং ইলমে দ্বীনের মধু আহরণকারি ছাত্ররা আজ ঐ জালিম সরকারের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে বা হচ্ছে, তারা কি দেশপ্রেমিক নয়? তারা কি মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান নয়? অবশ্য, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, এ ভারতবর্ষের বিজয় ছিনিয়ে আনার পেছনে কাদের অসাধরণ ভূমিকা রয়েছে, ইতিহাসের পাতায় তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা। যারা সঠিক ইতিহাসের উপর জ্ঞান রাখেন, তাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না বলে আমি মনে করি। আর তাই দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলা যায়, ভারতবর্ষের বিজয় এনেছিলেন ওলামায়ে কেরাম। আর বাংলা বিজয়ের ভিত্তি হলো ভারতবর্ষের বিজয়ের উপর। তা হয়েছিল একমাত্র ওলামায়ে কেরামগণের দ্বারা। যা আগের আলোচনা থেকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেছে। এ আলোচনা থেকে বুঝা যায়, কারা মূলত দেশপ্রেমিক। দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, আলেমগণ এবং তাদের অনুসারিরাই।
ওলামায়ে কেরামগণ আল্লাহকে বেশি ভয় করেন, এটা কোরআনুল কারিম দ্বারা প্রমাণিত। বলা আবশ্যক যে, আল্লাহ তা’লার ইবাদত করতে গেলে, আপনাকে আগে পবিত্র স্থান তালাশ করতে হবে। আর এজন্য প্রথমে দরকার নিরাপদ জমিন। কারণ, নিরাপদ জমিন না পেলে আল্লাহর ইবাদত আদায় করতে ব্যাহত হবে, নিশ্চিতভাবে। তাই আগে আপনাকে নিরাপদ জায়গা খোঁজতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ভারতবর্ষে বৃটিশদের কালো থাবা হতে, ওলামায়ে কেরাম ধর্মীয় ইবাদত পালনে বিঘœতা দূরীকরণে এবং জানমালের হেফাজত এক কথায় ইসলাম রক্ষার্থে বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। আর তাতে উনারা সফলও হন। এ হিসেবে ওলামায়ে কেরামগণ বাংলার স্বাধীনতার সূচক। ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত উনারাই। বাংলার মাটিতে পা রাখার সাফল্য মুক্তিযোদ্ধারা আসলে উনারাই। তাদের অবদানেই আজ স্বাধীন বাংলার প্রাপ্তি।
অথচ, আজ আলিমদের উপর নির্যাতনের ষ্টিমরোলার চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে ক্বওমি ওলামাদের উপর। যারা শুধু ইসলাম রক্ষার্থে কয়েকটি দফার দাবি করছিলেন মাত্র । ফলে হাজার হাজার আলিম-ওলামা এবং তালিবে ইলমসহ ইসলামপ্রিয় মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকাস্থ শাপলা চত্বর অঙ্গন। ঘটনার তারিখ গভীর রাতের ৬ মে, ২০১৩ইং। আজকের ওলামায়ে কেরামদের যে দাবি, সেটা পূর্বসূরি ওলামায়ে কেরামদের মত একই আন্দোলন। তা না হলে নিরাপদে ইবাদত করা মুশকিল হয়ে যেত। তবে পার্থক্যটা ছিল, তখনকার ওলামায়ে কেরামগণ জিহাদের ডাক দিয়ে ইসলাম ও দেশ রক্ষার্থে বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে নেমেছিলেন। আর এখনকার ওলামায়ে কেরামগণ ইসলাম রক্ষার্থে তথাকথিত মুসলিম সরকারের কাছে মাত্র কয়েকটি দাবি আদায়ের জন্য ঢাকায় অবরোধ করেছিলেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থানের কর্মসূচি ঘোষণা করেন নেতাকর্মিরা। পরে কালো রাতের পূনরাবৃত্তি ঘটায় সরকার। ঐ রাতে বিদ্যুৎ লোডশেডিং করে পুলিশ-র্যাব বাহিনি দিয়ে অতর্কিত হামলা চালিয়ে হাজার হাজার গুলি করে ঘুমন্ত, তাসবীহ-নামাজরত এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মঞ্চে থাকা নেতাকর্মীসহ অসংখ্য মুসলমানদের মেরে লাশ গুম করার মত ঘটনা ঘটানো হয়েছে। জিহাদের ডাক যদি দেয়া হত, তাহলে বিষয়টি বিবেচ্য ছিল।
যাই হোক, আলোচনা থেকে বুঝা গেলো, আলিম-ওলামাগণ যেমনি ইমানি চেতনায় উদ্ধুদ্ধ থাকেন, ঠিক তেমনি মুক্তির জন্যে, স্বাধীনতার জন্যেও যুদ্ধে উদ্ধুদ্ধ থাকেন। ফলে তাদের বলা যেতে পারে, বলা যেতে পারেই না শুধু, আমাদের বলাই উচিৎ যে, আলিম-ওলামাগণ খাঁটি মুসলমান এবং প্রকৃত দেশপ্রেমিক। অর্থাৎ ওলামায়ে কেরামগণের শ্ল্রোগান হলো, আমরা প্রথমে প্রকৃত মুসলমান পরে বাঙ্গালী বা দেশপ্রেমিক। আমার বিশ্বাসে এটাই বদ্ধমুল যে, এরাই সঠিক এবং প্রকৃত দেশপ্রেমিক।
পক্ষান্তরে যারা বুকে অন্য কথা ধারণ করে মুখে বলে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেমিক, মূলত তারাই দেশদ্রোহী। তাদের শ্লোগান থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয় যে, তারা বাঙ্গালী পরে মুসলমান। এ কথায় কী হয় জানেন? তাদের এ কথায় তারা বুঝাতে যায় যে, ইমান-ইসলাম এবং মুসলমানিত্ব থাকুক আর বা নাই থাকুক, আমাদের মুুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আকড়ে ধরে রাখতে হবে। তাদের ইমানি স্তম্ভ হলো মুক্তিযুদ্ধ। মনে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ এটা একটা ধর্ম। ধারণা করব কেনো, তাদের কর্মতৎপরতা তো তাই প্রমাণ করছে। আর তাই প্রথমেই ধর্ম হিসেবে তাদের এটাকে ধরে রাখতে হবে ভেবে তারা এতো চিল্লাচিল্লি করছে। অর্থাৎ এরা ইমান-ইসলামকে অস্বিকার করলেও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে অস্বিকার করতে পারে না। এরা ইসলামকে হারাতে পারবে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ধর্মকে হারাতে পারবে না। ফলে এদেরকে আমরা নাস্তিক বলতে বাধ্য হই, হচ্ছি। কারণ, এদের একদল তো সরাসরি আল্লাহর একত্ববাদকে অস্বিকার করছে বটে। আর আরেকটা দল কর্মকান্ডে অস্বিকারকারি। ফলে এরা দু’দলই নাস্তিক। এরা মুহাম্মদি চেতনায় বিশ্বাসি নয়। এরা রবিন্দ্র নাথের চেতনায় বিশ্বাসি। বক্তৃতায় দেশকে এগিয়ে নিতে রবিন্দ্রনাথের চেতনার কথা উঠে আসে। কিন্তু বাহ্যত সে একজন মুসলমান হওয়া স্বত্ত্বেও কোনোদিন বলেনি যে, আমরা মুহাম্মদি চেতনায় চলব, অন্যকে চালাব এবং দেশ পরিচালনা করব।
ওলামায়ে কেরাম এবং ইসলামপ্রিয় মানুষেরা যেভাবে ইমানি চেতনায় বিশ্বাসি, ঠিক তেমনি তারা দেশপ্রেমেও বিশ্বাসি। এরা শুধু মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্ভর করে দেশপ্রেমিক নয়, এরা সর্বদিক থেকে দেশপ্রেমিক। যেভাবে আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে একত্ববাদের বিশ্বাসি, ঠিক তেমনি হাদিছের উপর আমল করে তারা দেশপ্রেমিকের পরিচয় দিয়ে থাকেন। হাদিছে আছে, “হুব্বুল ওতনি মিনাল ইমান” অর্থ- “দেশপ্রেম ইমানের অঁঙ্গ”। সেই হিসেবে আমরা প্রথমে আল্লাহর উপর ইমান ঠিক রেখে দেশের চিন্তা করি। প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন যে, দেশ যাই হোক, আগে আপনাকে ইমান ঠিক রাখতে হবে? হ্যা ঠিক বলছেন। এছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আমরা মুসলমানদের প্রথমে মুসলমানিত্ব ঠিক রেখে পরে দেশকে ভালবাসতে হবে। আর এটাই আমাদের ইসলামি নীতিমালার মূলনীতি। এর উল্টোটা সম্ভবই নয়। যা নাস্তিকেরা মনে করে থাকে। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের প্রকৃত মুসলমানিত্বের পাশাপাশি একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে কবুল করুন- আমিন ॥
লেখক : প্রাবন্ধিক, আজমিরীগঞ্জ, হবিগঞ্জ।
junaidalhabib@yahoo.com