সূচনা: মানুষ গদ্যে কথাবার্তা বলে এটাই স্বাভাবিক বাকরীতি। কিন্তু সাহিত্যকর্মে গদ্যের ব্যবহার হয়েছে অনেক পরে। প্রথমে সাহিত্যকর্মের একমাত্র ভাষা ছিল কবিতা। অনান্য ভাষার ন্যয় বাংলাতেও অনুরুপ হয়েছিল। কিন্তু বাংলাতে গদ্যের আরম্ভটি অন্য ভাষার তুলনায় অনেক দেরিতে হয়। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত আমাদের দেশে কবিতা ছিল সাহিত্যের একমাত্র ভাষা। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দির শেষে গদ্যের প্রচলন যে হতে থাকে এটা অনেকটা স্বীকৃত। তবে তা ছিল দলিল-দস্তাবেজে এবং চিটিপত্রে। সপ্তদশ শতাব্দির শুরু থেকে পর্তুগিজ পাদ্রীরা মধ্য পূর্ববঙ্গে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য এক ধরনের বাংলা গদ্য ব্যবহার করতে থাকেন। তাদের প্রয়াশে বাংলা গদ্য রচনার পথ কিছুটা সুগম হয়।
রচনাবলি: পর্তুগিজ পাদ্রীরা ধর্ম প্রচারের জন্য বাংলায় যে সমস্ত গদ্য রচনা করেছিল তার প্রথমটি হল দম অন্তওনি রচিত ২২০পৃষ্টার ‘ব্রাক্ষ্মণ রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’। তাতে তিনি হিন্দু ধর্মের তুলনায় খ্রিষ্টধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন। এ গন্তটি সপ্তদশ শতাব্দির সপ্তম দশকের দিকে লিখা হয়েছিল। তাদের রচিত অন্য আরেকটি গ্রন্তের নাম ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’ এই গ্রন্তটি মনোএল দ্য আস-সুমসাম ঢাকার ভাওয়ালে অবস্তান কালে ১৭৪৩ খ্রী. ভাওয়ালে প্রচলিত মৌখিক ভাষায় লিখেছিলেন। তাতে তিনি গুরুশিষের সংলাপের ন্যয় খ্রিষ্টধর্মের সারবত্তা ব্যাখ্যা চেষ্টা করেছিলেন। তাতে যে সমস্ত বিষয় রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে ক্রুশ চিহ্নের ব্যাখ্যা। অন্য আরেকটি হচ্ছে মহান পিতা (সৃষ্টিকর্তা) সম্পর্কে আলোচনা। মনোএল বাংলা ভাষার একটি ব্যাকরণ ও লিখেছিলেন যা লিসবন শহর থেকে ১৭৪৩ খ্রী. প্রকাশিত হয়। মনোএল এর ব্যাকরণ গ্রন্তটি অবশ্য বাংলা ব্যাকরণের সম্পূৃর্ন রুপরেখা ছিল না।
অতঃপর ১৭৭২ সালের মধ্যে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশের প্রশাসনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে। তাই শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য বাংলা ভাষা শিক্ষা করা তাদের অপরিহার্য হয়ে পড়ে। প্রায় সেই সময় নাথানিয়েল হেলহেড নামক এক ইংরেজ সিভিলিয়ান বাংলাশে আসেন। তিনি এসেই বাংলা ভাষা চর্চা শুরু করে দেন। এবং অবিলম্ভে তাতে দক্ষতা অর্জন করে ১৭৭৮ সালে Gamar of the Bengali Languag নামে ইংরেজীতে একটি বাংলা ব্যাকরণ লিখেন। আর এটাই হল বাংলা ভাষার প্রথম আদর্শ ব্যাকরণ। হেলহেড তার ব্যাকরণে বাংলা শিক্ষার ক্ষেত্রে সংস্কৃতের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা স্বীকার করেছেন। তিনি তার ভূমিকায় বলেন বাংলার চলিত বুলি বা অঞ্চলিক ভাষায় ব্যাকরণগত অনেক অসংগতি রয়েছে তাই আঞ্চলিক ভাষার গতি প্রকৃতির সাহায্যে বাংলা ব্যাকরণ রচনা সম্ভব নয়। তিনি আরো লিখেন এই অঞ্চলের মুসলমানগণ তাদের ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে, পারিবারিক অঙ্গনে এবং প্রশাসনিক ব্যবস্তাপনার ক্ষেত্রে অনেক পরিমানে আরবি, ফারসি ব্যবহার করেছিলেন। তবে হেলহেড তার পক্ষপাতি ছিলেন না। তিনি বাংলা ব্যাকরণকে সংস্কৃত ভাষা বিশুদ্ধতার সাহায্যে সমন্বিত করতে চেয়েছিলেন।
অতঃপর হেনরী পিট্স ফরস্টারের Vocabulary নামে বাংলা-ইংরেজী দুই খন্ডের একটি শব্দকোষ যথাক্রমে ১৭৯৯ ও ১৮০২ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি আরো একটি বই লিখেছিলেন যার নাম Essay on the principles of Sanscrit grammar’।এটি প্রকাশিত হয় ১৮১০ সালে।
একটি কথা এখানে মনে রাখা দরকার যে পরবর্তীতে উইলিয়াম কেরী যখন বাংলা অভিধান রচনা করেন তখন তিনি ফরস্টারের গ্রন্তের উপর নির্ভর করেছিলেন।তারপর এ.আপজন ১৭৯৩ সালে বাংলা-ইংলিশ ভোকাবুলারি প্রকাশ করেন।
প্রধানত হ্যালহেড এবং ফরস্টারের চেষ্টায় এবং পরবর্তিতে কেরীর সমর্থনে এবং বাঙ্গালিদের মধ্যে রামমোহন রায় ও তার বন্দুদের সমর্থনে বাংলা ভাষা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সরকারী ভাষায় পরিণত হয়।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ : ১৭৯৯ সালে একদল ইংরেজ যাজক বা খ্রীষ্টান মিশনারী জাহাজ থেকে গঙ্গা তীরে অবতরণ করেন এবং শ্রীরামপুরে একটি মিশন স্থাপন করেন। তারও এক বছর পর ১৮০০ সালের মে মাসে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্টিত হয়, তরুণ ইংরেজ প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণকে বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য। এভাবেই ক্রমশ ফোর্ট উইলিয়ামকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষার প্রাথমিক পরিচর্যা শুরু হয়। তাতে মিশনারীগণ সম্পৃক্ত ছিলেন তাছারা জে.এফ. এলারটন ও স্যার গ্রেভিস নামে দুইজন ইংরেজ কর্মকর্তা ছিলেন। শ্রীরামপুর মিশনের সঙ্গে যাদের নাম যুক্ত ছিল তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন কেরী, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড।
যখন ইংরেজরা দেখল যে এদেশকে সুষ্টভাবে শাসন করতে হলে এদেশের ভাষা কিছুটা হলেও শিক্ষা করা অপরিহার্য। তাই ইংরেজ সিভিলিয়ান কর্মচারীদেরকে বাংলা ভাষা শিখানোর উদ্দেশ্যে, শ্রীরামপুর মিশনের কর্মযোগী পুরুষ উইলিয়াম কেরীকে অধ্যক্ষ নিযুক্ত করে ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগ খোলা হয়। কেরীর অধীনে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কর এবং রামনাথ বাচস্পাতি নামে দুজন পণ্ডিত এবং শ্রীমতিমুখোপাধ্যায়, আনন্দচন্দ্র, রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়, কাশীনাথ (তর্কালঙ্কার), পদ্মলোচন চুড়ামণি ও রামরাম বসু নামক ছয়জন সহকারী পন্ডিত নিযুক্ত হন। কেরী বাংলা বিভাগের দায়িত্ব হাতে নিয়েই পাঠ্য পুস্তকের তীব্র অভাব অনুভব করেন। তাই তিনি নিজেও যেমন পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন, তার অধীনস্ত পন্ডিতদের ও পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে উৎসাহিত করেন।
এই সূত্রে কেরীর নামে ‘কথোপকতন’ ১৮০১ সালে ও ‘ইতিহাসমালা’ ১৮১২ সালে দুইটি বই শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত হয়। লেখক হিসেবে কেরীর কৃতিত্ব যতটুকু ছিল, তার চেয়ে বেশী ছিল বাংলা গদ্য সৃষ্টির ব্যাপারে তার সৈনাপত্য গ্রহণে। পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে গিয়ে বাংলা ভাষার অপূর্ব প্রাণশক্তির এবং সম্ভাবনার ইংঙ্গিত তিনি আবিস্কার করতে পেরেছিলেন। এবং তিনি বাংলাকে বিশেষ একটা কাঠামোভিত্তিক রুপ দান করেছিলেন। তবে তার গদ্য সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। শত শত বছর ধরে যে বাংলা ভাষা র্চচিত হচ্ছিল তিনি তার ধারার ছন্দপতন ঘটান। এমন এক ভাষারীতি প্রবর্তন করেন, যা জনগণের অপরিচিত। তার গদ্যের কিছু নমুনা দিচ্ছি-
“তাহার পরে আর সাতটা গাভী উঠিল নদী হইতে বড় কুচ্ছিত ও কৃষা পরে নদীতীরে দন্ডাইল আর সকল গাভীর কাছে। অতঃপর কুচ্ছিত ও কৃষা খাইয়া ফেলাইল সেই সাতটা সুন্দর হৃষ্টপুষ্ট গাভীর দিগরে।” উনবিংশ শতাব্দীতে আরবী, ফারসী শব্দ বর্জন করে যেভাবে বাংলা গদ্য ধীরে ধীরে সংস্কৃতানুসারী হয়ে ওঠে উইলিয়াম কেরীই তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য বাংলা ভাষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। পাদ্রীরা এতে নিজেদের শ্রম, মেধা ও পরিকল্পনা ব্যয় করেন। তারা চেষ্টা করেন মুসলমানী উপাদানসমূহ সরিয়ে দিয়ে ভাষাটিকে সতন্ত্র রুপ দান করতে। এতে তারা একেবারে সফল না হলেও বাংলা ভাষায় এখনো তাদের কাজের অজস্র স্বাক্ষর ছরিয়ে ছিটিয়ে আছে।
লেখক : বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জামিয়াতুল খাইর আল ইসলামিয়া, মিরাপারা, টিলাগড়, সিলেট।