বছর গণনার সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
সংস্কৃতি হচ্ছে যে কোন আদর্শের বহিরাবরণ। ইসলাম হলো সঠিক জীবন বিধান ও পরিশুদ্ধ জীবনাচারের মাপকাঠি। ইসলাম আমাদেরকে দিয়েছে সুন্দর সুসমাম-িত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। শান্তির ধর্ম ইসলাম থেকে বিচ্যুত হওয়া চরম দুর্ভাগ্যের লক্ষণ। দীনের যে কোন বিধানকে অবজ্ঞা করার ফলে এমনটি হয়ে থাকে। মানব জীবনে সংস্কৃতি হলো একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। প্রত্যেক জিনিসের একটা সীমা-রেখা থাকে। সীমা-রেখা মধ্যে থাকাই কল্যাণকর। কোন আদর্শের সংস্কৃতি পরাজিত হলে সে আদর্শের পরাজয় অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমাদের যাপিত জীবনে আজকাল মুসলমানরা মুসলিম জাতিসত্বা, ইসলামী আদর্শ ও তাহযীব তামাদ্দুন সম্পর্কে চরম অবহেলা ও উদাসিনতা প্রদর্শন করে চলেছে। এটা স্বতসিদ্ধ কথা যে কারো জমিতে ফসল না ফলালে সে জমি বিরাণ পড়ে থাকে না। আগাছা জন্মে। আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা ও চাষ না করলে এর বিকাশ ও চর্চা কীভাবে হবে? আর সংস্কৃতির নামে বিজাতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করার ফল কখনোই ভাল হয় না। মহান আল্লাহ সময় দেন যেন বান্দা সংশোধন হয়ে পূণরায় ফিরে আসে। এ ক্ষেত্রে কেউ যদি সীমালঙ্গন করে তবে তার জন্য আল্লাহর আদালতে কড়ায়-গ-ায় জবাবদিহী করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّهُ النَّاسَ بِظُلْمِهِمْ مَا تَرَكَ عَلَيْهَا مِنْ دَابَّةٍ وَلَكِنْ يُؤَخِّرُهُمْ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ (৬১)
‘আল্লাহ যদি মানুষকে তাদের সীমালঙ্ঘনের জন্য শাস্তি দিতেন তবে ভূপৃষ্ঠে কোনো জীব-জন্তুকেই রেহাই দিতেন না কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। তারপর যখন তাদের সময় আসে তখন তারা মুহূর্তকাল বিলম্ব করতে পারে না।’ (সূরা নাহলের ১৬/৬১)
আমি আত্মসমালোচনার পক্ষে। নিজেরা বেখবর উদাসিন থেকে অন্যকে অপসংস্কৃতি চর্চার জন্য দোষারোপ করা নিশক্তির কুযুক্তি। এটা করে পার পাওয়া যাবে না। অন্যেরা তো তাদের কাজ করবেই। শয়তানও বসে থাকার পাত্র নয়। সে তার পণ্যের ফেরি করবেই। আমাদের দায়িত্ব হবে নিজেদের নির্মল নিষ্কলুষ সংস্কৃতির অব্যাহত চর্চা ও বিকাশ সাধন করা।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে তাকালে পরিলক্ষিত হয় যে, সে সব দেশে পশ্চিমা উলঙ্গ সংস্কৃতির চর্চা বিকাশ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজাতিরা যতটা নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার পালনে তৎপর, আমরা ততটা অলস উদাসিন ও বেখবর। আর সাংস্কৃতিক দিক থেকে কেউ আল্লাহর অবাধ্য হলে এর শাস্তি ভোগ করতেই হয়। কেউ প্রকাশ্যে বা গোপনে আল্লাহর নাফরমানী করলে আল্লাহ তা দেখেন। সাময়িকভাবে এ পাপ থেকে বান্দার ফিরে আসার কোনো অবকাশ থাকলে তাও আল্লাহ দেখেন।
إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ (১৮)
‘আল্লাহ আকাশম-লী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে অবগত আছেন। তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন’। (সূরা হুজুরাতের ৪৯/১৮)
ইসলাম হলো আদর্শ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। ইসলামে যে পরিশিলিত সংস্কৃতি বিদ্যমান রয়েছে তা অন্য কোথাও নেই। তবুও মুসলমান স্বীয় সংস্কৃতি থেকে গাফেল হয়ে অজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে অপসংস্কৃতিকে আপন করে নেয়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ জন্য ইসলামী কৃষ্টি-কালচারকে আদর্শের মাপকাঠি এবং জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য করা চাই। তা যে কোনো অনুষঙ্গের ক্ষেত্রে হোক না কেন। সে জন্য ইসলামী জীবনাদর্শকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। ইসলাম একটি জ্ঞান ভিত্তিক জীবনার্দশ। এজন্য কুরআন মাজীদের প্রথম নির্দেশ, ‘পড়’। তাই আমাদের প্রচুর পড়াশুনা করতে হবে। ইসলামকে জানতে হবে, মানতে হবে, জানার মাঝে কামিয়াবী নয়, মানার মাঝে কামিয়াবী। দেশ, ধর্ম, জাতি, দল, মত নির্বিশেষে সবার মধ্যে পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটুক। মানব জীবনের সৌন্দর্যম-িত অনুষদ ও মার্জিত সংস্কৃতির জীবন্ত অধ্যায় তাহযীব ও তামাদ্দুন ইসলামী কৃষ্টি-কালচারের সুনির্মল ছোঁয়ায় হয়ে উঠুক চিরসজীব ও প্রাণবন্ত জীবন্ত। এই প্রত্যাশা করি।
মুহাররাম ও আশুরা
আরবী বারো মাসের মধ্যে মাহে রমযান ব্যতীত আরো চারটি মাসকে মহান আল্লাহ পরম সম্মানিত ও মর্যাদাসম্পন্ন বলে কুরআন মজীদে উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো-মুহাররম, রজব, যিলকদ ও যিলহাজ্জ। হিজরী সনের প্রথম মাস- মুহাররম। মুহাররম শব্দের অর্থ হারাম বা নিষিদ্ধ। এ মাসে কোন প্রকার ঝগড়া-বিবাদ বা যুদ্ধ-বিগ্রহ করা ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। যে কোন নিষিদ্ধ কার্যাবলী হতে মুক্ত বলেই এ মাসটিকে বলা হয় মুহাররম, এমনকি আইয়ামে জাহেলিয়াতেও এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে মানুষ মুক্ত থাকত। আর এ মাসের দশ তারিখে সংঘটিত হয়েছে পৃথিবীতে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা। তাই মুহাররমের দশ তারিখ আশুরা নামে খ্যাত এবং মুসলিম মিল্লাতের নিকট এ মাসটি অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ। মহান আল্লাহ দশই মুহাররম লাওহে মাহফুয ও প্রাণীকূলের রূহ সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর সমস্ত নদ নদী, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর ইত্যাদি সৃষ্টি করেছেন। মানবজাতির আদিপিতা হযরত আদম আ. কে এই দিনে সৃষ্টি করেন এবং এই দিনেই আল্লাহ তাঁর তাওবা কবুল করেন। হযরত নুহ আ. ও তাঁর অল্পসংখ্যক ঈমানদার উম্মত কয়েক দিনের খাদ্যদ্রব্য নিয়ে জাহাজে চড়েছিলেন। চল্লিশ দিনের মহাপ্লাবনের পর এই তারিখে সবাইকে নিয়ে নিরাপদে মুক্তি লাভ করেন। এই আশুরার দিন হযরত ইবরাহীম আ. খোদাদ্রোহী বাদশাহ নমরুদের প্রজ্বলিত অগ্নিকু- থেকে নিরাপদে মুক্তি লাভ করেন এবং হযরত মূসা আ. খোদাদ্রোহী বাদশাহ ফিরাউনের কবল থেকে মুক্তি লাভ করেন। একই সাথে ফিরাউন স্বীয় দলবলসহ হযরত মূসা আ.-এর পশ্চাদ্বাবন করতে গিয়ে নীলনদে ডুবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। হযরত আইয়ুব আ. দীর্ঘ আঠার বছর কঠিন রোগ ভোগ করার পর এই দিনে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন এবং সমস্ত ধনসম্পদ ফিরে পান। হযরত ইউনুস আ. এই দিনে মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ করেন এবং হযরত ইয়াকুব আ. অনেক শোকের পর প্রিয়পুত্র হযরত ইউসুফ আ. কে ফিরে পান। হযরত ঈসা আ. এই দিনে পৃথিবীতে আগমন করেন এবং এই তারিখেই মহান আল্লাহ তাঁকে আকাশে উঠিয়ে নেন। এই দিনেই মহান আল্লাহ সর্ব প্রথম আকাশ হতে পৃথিবীতে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। আর এই দিনেই শুক্রবারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছানুযায়ী কিয়ামত সংঘটিত হবে।
শাহাদাতে কারবালা
মূলত এই দিনটি হযরত আদম আ. থেকে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা. পর্যন্ত এবং তাঁর ইন্তিকালের পর ৬০ হিজরী পর্যন্ত মুক্তি ও নাযাতের দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। রোযা-নামায, যিকির-আযকার, তসবীহ-তাহলীল, কুরআন তিলাওয়াতসহ বিশেষ ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে এ দিবসটি পালিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এই তারিখে ইতিহাসের এক মর্মান্তিক ও হৃদয় বিদারক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কারণে মুক্তির সাথে সাথে শোক ও শপথের দিবস হিসেবে মুসলিম উম্মহ’র কাছে সমধিক গুরুত্ব ও পরিচিতি লাভ করে। হিজরী ৬০ সালে হযরত মু‘আবিয়া রা. ইন্তিকাল করেন। রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করে ইয়াযিদ। রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভের পর পরই ইয়াযিদ হযরত হুসাইন রা.কে তার প্রতি আনুগত্যের আহ্বান জানান। কিন্তু ‘খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়াত’ তথা ইসলামী আদর্শ ও নীতিমালা বিরোধী পন্থায় খলীফা নির্বাচিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই হযরত হুসাইন রা. এই আনুগত্যে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু ইয়াযিদ ছলেবলে হুসাইন রা.-এর আনুগত্য লাভের জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠে। ফলে উভয়ের দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। এরপরও হযরত হুসাইন রা. চেয়েছিলেন হিজাযে নিরিবিলি ও শান্তিতে বাস করতে। কিন্তু ইয়াযিদের ক্রমাগত চাপে তা অসম্ভব হয়ে উঠে। এ সময় কুফাবাসীদের আহ্বানে তিনি হিজায পরিত্যাগ করে কুফা গমন করেন। পথে কারবালা প্রান্তরে তিনি ইয়াযিদের প্রেরিত বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। ইয়াযিদের প্রেরিত বাহিনী শুধু হযরত হুসাইন রা.-এর সঙ্গীদের অবরুদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি। ফুরাত নদী অবরোধ করে হযরত হুসাইনের পরিবারবর্গের পিপাসা নিবারণের পানি সংগ্রহের পথও বন্ধ করে দেয়। হযরত হুসাইন রা. তাদেরকে প্রস্তাব করেন যে, তাঁকে মদীনায় ফিরে যেতে অথবা দামেস্কে ইয়াযিদের নিকট নিয়ে যেতে অথবা দেশের বাইরে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক। কিন্তু ইয়াযিদ বাহিনীর একটিই দাবি ছিল যে ইয়াযিদের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন করতে হবে। তারা ভেবেছিলো, দীর্ঘদিন ধরে পরিবার-পরিজনসহ ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হযরত হুসাইন রা. তিলে তিলে মৃত্যুর পরিবর্তে নিশ্চয়ই ইয়াযিদের প্রতি আনুগত্যের সহজ পথই গ্রহণ করবেন। কিন্তু এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এবং বিপদের আশংকা সত্ত্বেও আদর্শ বিসর্জন দিয়ে জীবন রক্ষার চেয়ে আদর্শের পথে অবিচল থেকে শাহাদাতের পথই গ্রহণ করেছিলেন হযরত হুসাইন রা.।
কারবালা প্রান্তরে মহানবী সা.-এর প্রাণাধিক প্রিয় দৌহিত্র হযরত হুসাইন রা.-এর সাথে ইয়াযিদ বাহিনী যে নৃশংস আচরণ করে এর তুলনা শুধু ইসলামের ইতিহাসে কেনÑগোটা মানব জাতির ইতিহাসের খুঁজে পাওয়া ভার। কারবালায় বাহ্যত পরাজয় ঘটেছিল হযরত হুসাইনের এবং বিজয় হয়েছিল ইয়াযিদের। কিন্তু প্রকৃতপক্ষেই কি কারবালায় হযরত হুসাইনের পরাজয় এবং ইয়াযিদের বিজয় হয়েছিল? না, বাস্তবেই তা নয়। উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিক ও স্বাধীনতার বীর সৈনিক মাওলানা মোহাম্মদ আলী জাওহারের ভাষায় : “কাতলে হুসাইন আসল মে মর্গে ইয়াযিদ হায় ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হার কারবালাকে বা‘দ।” ‘হুসাইন রা.-এর হত্যাকা-ের মধ্যেই নিহিত ছিল ইয়াযিদের মৃত্যু, প্রতিটি কারবালার পরই ইসলামের নব উত্থান ঘটে।’ হুসাইন রা. নবুওয়তী আদর্শ রক্ষার উদ্দেশ্যে চরম আত্মদানের মাধ্যমে অনাগত ভবিষ্যতের প্রতিটি সংগ্রামী কাফেলার জন্য দিশারী ও প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে। আর সে দিনের আপাত বিজয়ী ইয়াযিদ যুগ যুগ ধরে কুড়িয়েছে মুসলিম উম্মাহর ঘৃণা ও ধিক্কার। হিজরী ৬১ সালের ১০ মুহাররম কারবালার প্রান্তরে হযরত ফাতিমা রা.-এর নয়নমণি, শেরে খোদা হযরত আলী রা.-এর কলিজার টুকরা এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত হুসাইন রা. স্বীয় পরিবারবর্গের ৭২ জন সঙ্গীসহ ইয়াযিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন।
শাহাদাতে কারবলার মূল কারণ
এখানে একটি বিষয় জানা প্রয়োজন যে, কেন হযরত হুসাইন রা. স্বল্পসংখ্যক সাথীদের নিয়ে এই অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন? ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, নবী করীম সা.-এর ইন্তিকালের পর খুলাফায়ে রাশেদার রাজত্বকাল পর্যন্ত ইসলামী আদর্শ তথা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হত এবং ইসলামী খিলাফতের নবুওয়তী ধারা অনুযায়ী খলীফা নির্বাচন করা হত। নবী করীম সা. বলেছেন, “আমার সুন্নত অবলম্বন কর এবং আমার পর খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নত অবলম্বন কর।” কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত খুলাফায়ে রাশেদার প্রতিষ্ঠিত নীতি লংঘন ও পদদলিত করে ইয়াযিদকে মুসলিম জাহানের শাসক নির্বাচন করা হয় এবং খিলাফতের পরিবর্তে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ পদে সমাসীন হওয়ার পর ইয়াযিদ ইসলামবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত হন এবং রাষ্ট্রীয় আমানত ও মুসলমানদের জাতীয় সম্পদ বায়তুলমাল ব্যক্তিগত সম্পদ হিসাবে ব্যবহার শুরু করেন। শুধু তাই নয়, মুসলিম জাহানের খলীফা হিসাবে তার হাতে বায়আত গ্রহণের জন্য হুসাইন রা.-এর উপর চাপ সৃষ্টি করে। ভয়ভীতির কারণে অনেকেই বায়আত গ্রহণ করেন। কিন্তু যিনি আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর কোলে লালিত-পালিত হয়েছেন, যার পবিত্র দেহে বিশ্বনবী সা.-এর রক্ত প্রবাহিত তিনি কীভাবে পারেন তারই আদর্শবিরোধী পন্থায় অধিষ্ঠিত শাসকের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করতে? সুতরাং হুসাইন রা. ‘আমর বিল মারূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার’ তথা ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধের মহান দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে বায়‘আত গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন এবং মহানবী সা. ও খুলাফায়ে রাশেদার সুমহান আদর্শ প্রচার শুরু করেন। মৃত্যুকে নির্ঘাত জেনেও তিনি মদীনা থেকে মক্কায় ও মক্কা থেকে কুফায় রওয়ানা হন এবং কারবালার প্রান্তরে ইয়াযিদ বাহিনীর সাথে বীরের মত লড়াই করে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন।
হযরত হুসাইন রা. ছিলেন সত্যের প্রতীক, সত্যনিষ্ঠায় যার জীবন হয়েছে অতিবাহিত সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাতিলের রক্তচক্ষু অভীষ্ট লক্ষ হতে তাঁকে এতটুকু বিচ্যুত করতে পারেনি। বজ্রকঠিন প্রত্যয়ে অবিচল থেকে বাতিলকে প্রতিহত করার শপথ নিয়ে সেদিন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। অবশেষে স্বীয় প্রাণ বিসর্জন দিয়ে তিনি প্রমাণ রেখে গেলেন যে, সত্য-মিথ্যা, হক ও বাতিল, ন্যায় ও অন্যায়ের কখনো আপোষ হতে পারে না, যদি কোন দিন এ পথে স্বীয় জীবন উৎসর্গ করতে হয় তবুও না, বস্তুত এ চেতনাবোধই সেদিন হুসাইন রা. কে নিরাপদ আবাস থেকে বিপদ সংকুল কুফা অভিমুখে যাত্রার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। কারবালার ঘটনা পর্যালোচনা করলে এ সত্যটি বেরিয়ে আসে যে, মূলত ইয়াযিদ সেদিন বিজয়ী হয়েও ধ্বংস হয়েছে এবং হুসাইন রা. পরাজিত হয়েও বিজয়ী হয়েছেন। শুধু তাই নয়, স্বয়ং ইসলামী আদর্শের বিজয় হয়েছে। তাই দুনিয়ার ঘরে ঘরে হুসাইন রা. আলোচনা, তাঁর জন্য শোকের অশ্রু ঝরায় দুনিয়ার মানুষেরা, হযরত হাসান ও হুসাইন রা. তাই আজ আমাদের ঘরে ঘরে প্রাতস্মরণীয়। পৃথিবীতে এমন কোন জনপদ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে গ্রামে ও শহরে শিশুদের নাম হাসান ও হুসাইন রাখা হয় না। সন্তানের এ নাম রেখে পিতামাতা গর্ববোধ করে হুসাইনের বংশধারা হতেই সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে অসংখ্য সৈয়দ পরিবার আওলাদে রাসূল। পক্ষান্তরে ইয়াজিদ এমন ঘৃণিত অপদস্ত ও অশুভ প্রেতাত্মা হিসাবে আখ্যায়িত যার নামে কোন মানুষের নাম এ পৃথিবীতে খুবই কম খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ ইয়াযিদ মরে গেছে, সমূলে ধ্বংস হয়েছে। আর হুসাইন রা. মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় আদর্শের সুউচ্চ মিনার হিসেবে অমর হয়ে আছেন। ইসলামের জন্য মহানবী সা.-এর আদর্শের জন্য চরম কুরবানীর বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনে এর চেয়ে উত্তম প্রতিদান আর কি হতে পারে? প্রতি বছর ফিরে আসে আমাদের নিকট আশুরা-১০ই মুহাররম।
আশুরার আমল হিসেবে দু’দিন রোযা রাখার কথা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এ উপলক্ষে নফল নামায, কুরআন তিলাওয়াত ও তাসবীহ-তাহলীলের মাধ্যমে ইবাদত এবং কারবালার প্রান্তরে শাহাদাত বরণকারীদের জন্য দু‘আ করতে পারি। কিন্তু কিছুসংখ্যক লোক হায় হুসাইন! হায় হুসাইন! বলে মাতম করে মর্সিয়া গেয়ে থাকেন। এর দ্বারা কি পবিত্র আশুরার দাবি পূরণ হয়। তাই কবির ভাষায় বলতে হয় : ‘ফিরে এলো আবার সেই মুহররম মাহিনা, ত্যাগ চাই, মর্শিয়া ক্রন্দন চাহিনা।’ শুধু মর্সিয়া বা ক্রন্দন নয় বরং অন্যায়, অসত্য ও বাতিলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আত্মত্যাগের মাধ্যমে হযরত হুসাইন রা. যে উজ্জ্বল ও মহান আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, আজকের মুসলিম মিল্লাতকে সেই আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। বাতিল ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আজকের এই দিনে বজ্রকঠিন শপথ গ্রহণ করতে হবে। যুলুম অবিচার অশান্তি সন্ত্রাস নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ চাই। তাহলেই অসত্যের কালো মেঘ দূরীভূত করে একটি সুখী-সুন্দর শান্তিময় ও সম্পদশালী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, বাতিল ও অসত্য অবশ্যই একদিন মিটে যাবে, ধ্বংস হবেই। কারণ মহান আল্লাহর ঘোষণা করেছেন,
وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا
সত্য সমাগত মিথ্যা বিলুপ্ত, মিথ্যা তো বিলুপ্ত হবেই।” (সূরা বনী ইসরাঈল ১৭/৮১)
আমাদের করণীয়
মুসলিম জাতি একটি বৈশ্বিক জাতি। দুনিয়ার বৈরী প্রচার মাধ্যম মুসলমানদের নামে নানা অপবাদ দিলেও মুসলমানরা বিশ্ব সভ্যতার গর্বিত অংশিদার। ইসলাম মুসলমানদের বিশ্ব নাগরিক হবার দীক্ষা দেয়। সকল প্রকার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকার শিক্ষা দেয়। এজন্য ইসলাম ভূগোল, বর্ণ ও ভাষাভিত্তিক সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করে না। ইসলাম পৃথিবীর সকল মানুষকে আদম সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এক আদি পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে এক আল্লার সৃষ্টি হিসেবে সকল মানুষের মধ্যে এক মানবিক সম্পর্কের কথা বলে। আবার আদর্শিক ও সংস্কৃতিক ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র বজায় রাখার প্রত্যয়দীপ্ত তাগিদ দেয়। সে মতে প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে স্বজাতি ও স্বদেশের প্রতি দায়িত্বশীল থাকা এবং বিশ্বাসের শুদ্ধতা, আমলের নির্মলতা, চরিত্রের নিপুনতা, আচার আচরণের পরিশিলতা বজায় রাখা; স্বীয় আদর্শ ও সংস্কৃতিকে ধারণ ও গ্রহণ করে এর লালন ও বিকাশে ভূমিকা রাখা। হিজরী সন ইসলামী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুতরাং আমাদের করণীয় হচ্ছে-
১. হিজরী সন গণনার গুরুত্ব উপলব্ধি করা এবং এর ব্যবহার ও চর্চা বৃদ্ধি করা।
২. দৈনন্দিন জীবনে হিজরী সন তারিখ ব্যবহার করা।
৩. হিজরী সন গণনার প্রতি গণমানুষকে উদ্বুদ্ধ করা।
৪. শিক্ষার্থীদের নিকট এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা। প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক এবং
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এ বিষয়ক সেমিনার সেম্পোজিয়াম আয়োজন করা।
৫. পত্র-পত্রিকায় লেখা লেখি বৃদ্ধি, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার করা।
৬. এ বিষয়ক পুস্তক পুস্তিকা ও প্রচার পত্র বিতরণ করা।
৭. সকল প্রকাশনায় হিজরী সনের ব্যাবহার নিশ্চিত করা।
৮. মালিকের আনুগত্যে অটল থাকা, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অবিচল থাকা।
৯. সৎকাজে আদেশ অসৎ কাজে নিষেধ অব্যাহত রাখা।
১০. উম্মাহর ঐক্য পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হওয়া, আশুরা উপলক্ষে দুটি রোযা রাখা।
মহান আল্লাহ আমাদের সুমতি দান করুন। স্বীয় আদর্শ ও সংস্কৃতির উজ্জীবনে সচেতন ও সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখার তাওফীক দিন। আমীন।
লেখক পরিচিতি : গবেষক, আলেম ও বহুগ্রন্থ প্রণেতা।
আরও পড়ুন-