সংগৃহীত পোস্ট : এদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার ইতিহাস বহু পুরানো। ইংরেজ আমলের আগে থেকেই দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রচলিত ছিল। ইংরেজরা এ শিক্ষা বন্ধ করে দিলে মুসলমানরা নিজেদের উদ্যোগে মাদ্রাসা খুলে আবারও এই শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে। মাদ্রাসা শিক্ষায় কওমি ধারা প্রায় ১৫০ বছর আগে শুরু হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে আরবি শিক্ষা উঠিয়ে দেওয়ার পর ১৮৬৫ সালে মুসলমানরা সামাজিকভাবে আরবি শিক্ষার দায়িত্ব নেন। সিপাহী বিপ্লবের কয়েক বছর পর ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ ও সাহারানপুরে মাওলানা কাসেম নানুতুবী এবং রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীর উপমহাদেশে প্রথম কওমি মাদ্রাসা গড়ে তোলেন। দেওবন্দে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার নাম অনুসারে কওমি শিক্ষার আরেক নাম দেওবন্দ শিক্ষা এবং এ মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণকারীদের দেওবন্দের অনুসারী বলা হয়।
এই শিক্ষায় লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করলেও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন হচ্ছে না কওমি শিক্ষার কার্যক্রম। আধুনিক শিক্ষাক্রম দিনে দিনে এগুলেও মাদ্রাসা শিক্ষা রয়ে গেছে সেই আদি স্তরেই। এ কারণে দেশের মাদ্রাসাগুলোতে এখনও প্রচুর সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও যুগোপযোগী শিক্ষা হিসেবে স্বীকৃত না হওয়ায় মাদ্রাসা পাশ করা শিক্ষার্থীদের সরকারি-বেসরকারি চাকরির সুযোগ নেই বললেই চলে। ফলে এই ধারার শিক্ষার্থীদের জীবনজুড়ে থাকে অনিশ্চয়তা ও পরনির্ভরতা।দীর্ঘ এই সময়েও সরকারের স্বীকৃতি মেলে নি। অভিযোগ আছে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত একটি অংশই চাননা সরকারের স্বীকৃতি নিতে। ফলে এই কওমি শিক্ষার কার্যক্রম নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ যেমন উঠছে, তেমনি চাকরির ক্ষেত্রেও এই শিক্ষায় শিক্ষিতরা পিছিয়ে রয়েছে।
মূলত দুই ধরনের মাদ্রাসা রয়েছে দেশে। একটি সাধারণ ধারার মাদ্রাসা (আলিয়া) আরেকটি কওমি মাদ্রাসা। মাদ্রাসা নামে পরিচালিত হলেও এই দুই ধারার মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। এছাড়া ধর্মীয় ও জাগতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়েও রয়েছে মতবিরোধ। সাধারণ ও কওমি মাদ্রাসায় মোট কত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে এর সঠিক হিসাব নেই। তবে বিভিন্ন সূত্রে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। সরকার এবং বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার আনুমানিক হিসাব হচ্ছে, দেশের মোট শিক্ষার্থীর আট শতাংশই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। আর দেশে মোট শিক্ষার্থী জনসংখ্যার প্রায় ২৬ শতাংশ। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর কর্মজগতে প্রবেশের সুযোগ বেশ কম। এমনিতেই দেশে বেকার সমস্যা প্রকট, তার ওপর মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য চাকরির সুযোগ খুবই কম। দেশে এখন প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার ধারা ও উপধারা আছে এগারোটি। বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ও উপ-আনুষ্ঠানিক বিভিন্ন ধারা ছাড়াও রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষার কমপক্ষে চারটি ধারা। এর মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসারই কেবল সরকারের স্বীকৃতি আছে। এ ধারায় ইবতেদায়ি বা প্রাথমিক থেকে কামিল বা মাস্টার্সের সমপর্যায় পর্যন্ত পাঁচটি স্তরে ধর্মীয় এবং সাধারণ শিক্ষার সমন্বয় করা হয়েছে। আলিয়া বাদে মাদ্রাসার অন্য ধারাগুলো মূলত ধর্মীয় শিক্ষাই দেয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধারা কওমি। কওমি গোত্রেই পড়ছে হাফেজিয়া বা ফোরকানিয়া এবং কিতাবখানা নামের মাদ্রাসাগুলো। নূরানী মাদ্রাসা আছে শুধুই প্রাথমিক স্তরে। এছাড়াও আছে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের এক বছর মেয়াদি মসজিদ বা মক্তবভিত্তিক মাদ্রাসা।
কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষিতরা পেশাগত জীবনে সাধারণত মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন, মাদ্রাসার শিক্ষক হচ্ছেন। এদের কেউ কেউ মুফতি (ফতোয়া বা ইসলামি আইনে অভিজ্ঞ), ক্বারি (শুদ্ধভাবে কোরআন তেলওয়াত), মাওলানা (দাওরায়ে হাদিস উত্তীর্ণ এবং সামগ্রিক ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন), হাফেজ (কোরআন শরিফ মুখস্থ থাকা) ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও ইসলামের প্রচার করতে গিয়ে কেউ কেউ হন মুফাসসির (কোরআনের ব্যাখ্যা), মুহাদ্দেছ (হাদিসে পান্ডিত্য) ইত্যাদি হিসেবে স্বীকৃত হন। তবে সরকারি স্বীকৃতি না থাকায় তাদের সনদের গ্রহণযোগ্যতা চাকরি, উচ্চশিক্ষা, বিদেশে কর্মসংস্থান কোথাও তেমন একটা নেই।
অন্যদিকে কওমি শিক্ষার্থীদের যেসব অনুশাসন ও আদব-কায়দা শেখানো হয় তা রোজকার জীবনে, চাকরির বাজারের আদব-কায়দার সঙ্গে খাপ খায় না। যেমন, প্যান্ট পরা যাবে না, চেয়ারে বসে খাওয়া যাবে না, সালাম দেওয়ার সময় হাত ওঠানো যাবে না ইত্যাদি। সাধারণ বা আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষায় দাখিল পাস করে কলেজ এবং আলিম পাস করে ডিগ্রি এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকলেও কওমি-নূরানী মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জীবন ও কর্মক্ষেত্র ধর্মীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকছে। কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা মাস্টার্স সমমান দাবি করা ‘দাওরায়ে হাদিস’ ডিগ্রি অর্জনের পরও সরকারি কর্মকমিশনের (বিসিএস) পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় না। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে তাদের জন্য যে কোনও চাকরির সুযোগ খুবই সীমিত। দেশে একমাত্র আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক নিয়োগের ক্ষেত্রে কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দেয়।
এই শিক্ষা প্রতিযোগিতা এবং পেশার উপযুক্ত দক্ষ নাগরিক গড়ে তুলতে পারছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকের মনে। কওমি মাদ্রাসা থেকে পাস করার পর চাকরির অনিশ্চয়তা সম্পর্কে জামিয়া রহিমিয়া মাদ্রাসার একজন হাফেজ বলেন, ‘আল্লাহকে রাজিখুশি করতে দ্বীনের শিক্ষা নিচ্ছি। গাড়ি-বাড়ির স্বপ্ন দেখি না, কোনও মতে খেয়ে-পরে ইসলামের খেদমত করতে চাই।’ কওমি বোর্ডের পক্ষ থেকে তাদের সনদের সরকারি স্বীকৃতি দাবি করে জোট সরকারের শেষ বছরে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে বলা হয়, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকায় প্রচুর হাফেজ, ইমাম এবং ধর্মশিক্ষকের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সরকারের স্বীকৃতি না থাকায় কওমি শিক্ষার্থীরা এসব সুযোগ হারাচ্ছে।’ আবেদনে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায় দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমান এবং কওমি বোর্ডকে অধিভুক্তকারী (এফিলিয়েটিং) ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হয়।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব ধর্মতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী নুরুল ইসলাম মনে করেন, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে পশ্চাদপদ হলো আলিয়া শিক্ষা এবং তার চেয়েও অনগ্রসর হচ্ছে কওমি শিক্ষার ধারা। তিনি বলেন, ‘আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, ইসলামি অর্থনীতি সম্পর্কে তাদের ধারণা থাকলেও ভূগোল, ইতিহাস তারা জানে না।’
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কওমি মাদ্রাসার বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ধর্মবিশ্বাসী দরিদ্র পরিবারের সন্তান। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা অবৈতনিক হলেও মাদ্রাসায় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের থাকা-খাওয়া-শিক্ষা কোনটারই ব্যয় লাগে না। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের কিছু সন্তানদেরও সম্প্রতি এসব মাদ্রাসায় ভর্তি করা হচ্ছে। মোহাম্মদপুর ভেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল কিশোর মো. আলী আজম। ফ্যাকাশে মুখমণ্ডল, দুই ঠোঁটের পাশে দগদগে ঘা। গোড়ালি পর্যন্ত ময়লা ও ভাঁজপড়া পাঞ্জাবি এবং মাথার তুলনায় ছোট ও ছেঁড়া টুপি। পবিত্র কোরআনের হাফেজ হওয়া ওর স্বপ্ন। ‘একজন হাফেজের কত দাম জানেন! সবাই সম্মান করে, সালাম দেয়,’ বলল আজম। ফরিদপুরের নগরকান্দা থানার উড়াপাড়া গ্রামের কৃষক মোতাহের মোল্লার ছেলে আজম। মা-বাবাকে ছেড়ে ঢাকায় আসার কারণ সম্পর্কে জানায়, ‘গ্রামে তিনবেলা খেতে পারতাম না। এজন্য ভাই ঢাকায় নিয়ে এসেছে।’ ওর বড় ভাই এবাদত হাফেজি পাস করে চাকরি খুঁজছেন। আরেক ভাই জামিলও হাফেজি পড়ছেন। প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে নবীনগরে আজমের থাকা, খাওয়া এবং পড়ার ঠিকানা জামিয়া রহিমিয়া মাদ্রাসা।
সেপ্টেম্বর ২০১৪ সাল নাগাদ অনুসন্ধানে কওমি মাদ্রাসার ৩৫টিরও বেশি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড (বেফাক), সম্মিলিত কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড (গহরডাঙ্গা), চট্টগ্রামের হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার অধীনে প্রায় এক হাজার একশ’, চট্টগ্রামের পটিয়া আল জামেয়া আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার অধীনে পাঁচশ’ এবং সিলেট শহরের সোবহানিঘাট মাদ্রাসার অধীনে চারশ’ মাদ্রাসা আছে। সংখ্যায় কম মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণকারীরা হচ্ছে- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা (১০০), কিশোরগঞ্জের জামিয়া এমদাদিয়া মাদ্রাসা (৮০), সিলেটের কানাইঘাট দারুল উলুম মাদ্রাসা (২২৫), সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানার রাণাপিং মাদ্রাসা (২০০), গোপালগঞ্জের গহরডাঙ্গা মাদ্রাসা (১০০), বগুড়া জামিল মাদ্রাসা (১২৫)। এছাড়াও হবিগঞ্জের সবচেয়ে বড় কওমি মাদ্রাসার অধীনে (৮০), মাদানীনগর মাদ্রাসার অধীনে (১০০) এবং মাওলানা মুজিবুর রহমান যুক্তিবাদীর নেতৃত্বে ১০০ মাদ্রাসা রয়েছে।
সূত্র জানায়, রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলায় অবস্থিত কওমি মাদ্রাসা বোর্ডে নেতৃত্বের কোন্দল, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এবং পাঠ্যপুস্তক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বেশ নাজুক অবস্থায় আছে। আর এ অবস্থার সুযোগে আঞ্চলিক ধর্মীয় নেতারা তাদের নিয়ন্ত্রণের কিছু মাদ্রাসা একত্রিত করে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, বোর্ডের কিছু কর্তাব্যক্তি বই লিখে ও তা প্রকাশ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। কওমি বোর্ডের মহাসচিব মোহাম্মাদ আবদুল জব্বার অবশ্য দাবি করেন, পাঠ্যবই লেখা ও প্রকাশের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বোর্ড তথা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কল্যাণে খরচ হয়।
দেশের সাধারণ ধারার মাদ্রাসা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পরিচালিত হয়। কিন্তু কওমি শিক্ষার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সেজন্য তাদের কাছে কোনো তথ্যও নেই। এজন্য এই ধারার মাদ্রাসা ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। এ নিয়ে নানা সময়ে অভিযোগও উঠেছে। এই শিক্ষা নিয়ে এদেশে গবেষণাও হয়েছে কম। ফলে এই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রকৃত তথ্য কোথাও নেই। ২০০৮ সালে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর একটি গবেষণা সমীক্ষা চালায় বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)। ওই গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, প্রায় পাঁচ হাজার ২০০ কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী সংখ্যা আনুমানিক ১৪ লাখ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, এখানে প্রকৃত তথ্য উঠে আসেনি। লালবাগ জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার প্রয়াত প্রিন্সিপাল মাওলানা ফজলুল হক আমিনী দাবি করতেন, এই ধারায় শিক্ষার্থী প্রায় ৪০ লাখ। ওই গবেষণায় কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাকে দেশের প্রচলিত অন্যান্য শিক্ষা ব্যবস্থার মতো সরকারের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটি হয়নি।
২০১০ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবির) সঙ্গে মিলে ব্যানবেইস কওমি মাদ্রাসার ওপর একটি নমুনা জরিপ পরিচালনা করে। ওই জরিপে ছয় বিভাগের (তখন রংপুর বিভাগ হয়নি) সাতটি জেলার ৫৪৪টি মাদ্রাসার ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। তাতে দেখা যায়, ৮০ দশমিক ৭০ শতাংশ মাদ্রাসাই মফস্বল এলাকায় অবস্থিত। বাকি ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান শহরাঞ্চলে অবস্থিত। স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কওমি মাদ্রাসা সবচেয়ে বেশি ৪৪ দশমিক ০৪ শতাংশ বেড়েছে। এই সময়ে মফস্বলে ৪২ দশমিক ৭০ শতাংশ, পৌর এলাকায় ৫২ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং মহানগর এলাকায় ৪৩ দশমিক ০৮ শতাংশ মাদ্রাসা গড়ে উঠে। ২০০০ সালের পর থেকেও পৌর এলাকায় মাদ্রাসায় বেড়েছে। ওই জরিপ অনুযায়ী কওমি মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে ৭৫ ভাগ মাদ্রাসায় শুধু ছেলেরা পড়ে এবং ২১ দশমিক ৬৯ শতাংশে শুধু ছাত্রীরা পড়ে। মাত্র তিন দশমিক ৩১ শতাংশ মাদ্রাসায় ছেলে ও মেয়েদের একসঙ্গে পড়ার সুযোগ আছে। জরিপ বলছে মাদ্রাসায় মোট শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ১০ দশমিক ২১ শতাংশ নারী শিক্ষক। ব্যানবেইসের কর্মকর্তারা বলছেন এই নমুনা জরিপ দিয়ে মাদ্রাসা ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব নয়। কারণ হিসেবে একেক মাদ্রাসায় একেক ধরনের চিত্র দেখা যাচ্ছে। তবে এই জরিপের ভিত্তিতে একটি সাধারণ ধারণা পাওয়া সম্ভব। ওই জরিপে বলা হয় বেশকিছু বোর্ড সমন্বয়হীন ভাবে চলছে এবং কিছু প্রতিষ্ঠান একেবারেই স্বাধীন ভাবে চলছে। এরমধ্যে ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ মাদ্রাসা বোর্ডের অধীন এবং ২৯ দশমিক ৪১ শতাংশ মাদ্রাসা কোনও বোর্ডের অধীনে নেই। এটাকে একটা বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়েছে জরিপের ফলাফলে। জরিপে তদারক ব্যবস্থা উন্নত করা এবং জবাবদিহিতা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়।
সম্প্রতি, সদ্য বিদায়ী সরকারের আমলে জমা দেওয়া কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয় ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ১৫ হাজার কওমি মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে ছয়টি শর্তে স্বীকৃতির দেওয়ার সুপারিশ করা হয়;
প্রথমটি হলো কওমি মাদ্রাসার নেসাব বা নেজামে তালিমে কোনওরকম হস্তক্ষেপ করা চলবে না।
দ্বিতীয় হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদা সম্পূর্ণভাবে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।
তৃতীয়টি হলো মাদ্রাসা পরিচালনা পদ্ধতিতে কোনও হস্তক্ষেপ চলবে না।
চতুর্থটি হলো কওমি মাদ্রাসা কখনও এমপিওভুক্ত হবে না।
পঞ্চমটি হলো কোনও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় সরকার কোনও ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পারবে না এবং
সর্বশেষ শর্তটি হলো কওমি মাদ্রাসাগুলো তাদের স্ব স্ব বিধান অনুযায়ী চলবে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয় কওমি মাদ্রাসার স্তর হবে ছয়টি;
প্রাথমিক স্তরটি হবে ইবতিদাইয়্যাহ,
নিম্ন মাধ্যমিক স্তর হবে মুতাওয়াসসিতাহ,
এসএসসি স্তরের নাম হবে সানাবিয়্যাহ আম্মাহ,
এইচএসসি’র স্তরটি সানাবিয়্যাহ খাস্সাহ,
স্নাতক (সম্মান) স্তর হবে মারহালাতুল ফজিলত এবং
দাওরায়ে হাদিস বা স্নাতকোত্তর মারহালালতুত তাকমিল নামে পরিচিত হবে।
বর্তমানে অবশ্য এভাবেই চলছে কওমি মাদ্রাসার পাঠ প্রক্রিয়া। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এসব স্তর সমাপ্তকারী শিক্ষার্থীরা চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে স্তরভিত্তিক মূল্যায়ন সনদ পাবেন। অর্থাৎ এসব তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে কওমি মাদ্রাসার বিষয়ে প্রকৃত কোনও তথ্য নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কওমি শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ বিষয়ে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নিলেও গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আটকে যায়। এখনও সেই অবস্থায় আছে। মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, আপাতত এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো স্থগিত থাকবে। শিক্ষাবিদেরা বলছেন, কওমি শিক্ষাকে সরকারের আওতায় এনে সংস্কার করে আরও যুগোপযোগী করা উচিত। কারণ বিদ্যমান অবস্থায় তারা অনেক পিছিয়ে আছে। ফলে চাকরি-বাকরি থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে।
নূরানী বোর্ড যেভাবে চলছে
নূরানী তা‘লিমুল কুরআন বোর্ডের কার্যালয় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রিং রোডে। সরকারের স্বীকৃতিবিহীন এ মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক ধর্মীয় জ্ঞান পাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা শিক্ষার যে কোনও ধারায় যেতে পারে। নূরানী বোর্ডের লক্ষ্য কোনও মুসলমান শিশু যেন কোরআন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়। নূরানী বোর্ডের বাইরেও নূরানী নাম দিয়ে বেশকিছু মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। বোর্ডের খাদেম মাওলানা আব্দুল মান্নান বলেন, ‘অনেকেই নূরানী নাম দিয়ে মাদ্রাসা শুরুর পর বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, যেভাবেই হোক শিশু-কিশোররা কোরআন শিক্ষা তো পাচ্ছে।’ বোর্ড সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানায় রয়েছে সর্বাধিক ১৩০টি নূরানী মাদ্রাসা। নোয়াখালীর বাংলাবাজারে অবস্থিত সবচেয়ে বড় নূরানী মাদ্রাসায় প্রায় ৯০০ শিশু পড়াশোনা করছে। এছাড়া চট্টগ্রামের বাঁশখালী নূরানী মাদ্রাসায় ৭০০, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে মীরওয়ারিশপুর হোসাইনিয়া নূরানী মাদ্রাসায় প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী আছে।
দিনে দিনে বাড়ছে সাধারণ মাদ্রাসা
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী দেশে দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল স্তরে মোট মাদ্রাসা আছে নয় হাজার ৪৪১টি। এসব মাদ্রাসায় মোট শিক্ষার্থী ২২ লাখ ৪৭ হাজার ৯৮৩ জন। ব্যানবেইসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে দেশে দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল স্তরে মোট মাদ্রাসা ছিল ছয় হাজার ৬৫০টি। পরের বছর এই সংখ্যা দাঁড়ায় ছয় হাজার ৮৫১। ১৯৯৮ সালে হয় ছয় হাজার ৯৫৬টি। এভাবে বেড়ে বেড়ে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে নয় হাজার ৪৪১টিতে। সাধারণ ধারার মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সাধারণ ধারার শিক্ষায় যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তেমনি চাকরিতেও তাদের সীমিত সুযোগ রয়েছে। তবে এর মূল কারণ হলো শিক্ষাক্রম। তাঁরা যে শিক্ষাক্রম পড়ে তাতে চাকরির ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হয়। তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে মাদ্রাসার উন্নয়নে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ফর মাদ্রাসা এডুকেশন প্রকল্প
মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ‘ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ফর মাদ্রাসা এডুকেশন’ প্রকল্পের আওতায় ১০০টি মাদ্রাসায় ভোকেশনাল শিক্ষা কোর্স চালু করা হয়েছে এবং সাধারণ শিক্ষার অনুরূপ মাদ্রাসা শিক্ষায় বিজ্ঞান ও কম্পিউটার শাখা চালু করা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ৩১টি মাদ্রাসায় চারটি বিষয়ে সম্মান (অনার্স) কোর্স চালু করা হয়েছে। এছাড়া পৃথক একটি মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উপাচার্যও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) অনুদানে সারা দেশে ৯৫টি বেসরকারি মাদ্রাসায় একাডেমিক ভবন নির্মাণ ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, আসবাবপত্র সরবরাহের লক্ষ্যে ১০০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ৩৫টি মডেল মাদ্রাসায় প্রযুক্তিগত শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে বিজ্ঞান ও কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। ইবতোদায়ি ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বৃত্তি চালু করা হয়েছে। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি শিক্ষকদের বেতন প্রতি মাসে আগে পেতেন ৫০০ টাকা। এই টাকা বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করেছে। পৃথক মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর করার প্রক্রিয়াও চলছে।
এছাড়া প্রথমবারের মতো শুধু মাদ্রাসা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় একটি স্বতন্ত্র ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়ে কাজও শুরু হয়েছে। এজন্য উপাচার্যও নিয়োগ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশ অনুযায়ী সাধারণ ধারার মতো মাদ্রাসাতেও বাংলা, ইংরেজি, বাংলাদেশ স্টাডিজ, সাধারণ গণিত ও তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষায় অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ লক্ষ্যে সাধারণ শিক্ষার কিছু বই মাদ্রাসা শিক্ষার উপযোগী করার প্রক্রিয়া চলছে। তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা এদেশেরই সন্তান। তাদের এমন শিক্ষা দেওয়া উচিত, যাতে তারা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং প্রতিযোগিতা করে ভর্তি, চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জায়গা করে নিতে পারে। তবে তারা এও বলেছেন, সব সরকারই মাদ্রাসা শিক্ষা আধুনিক ও যুগোপযোগী করার কথা বলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেটি আর হয়ে ওঠে না।
সুত্রঃ চাকরির সুযোগ নেই, মাদ্রাসা পাস করে মেলে শুধু বঞ্চনা, বাংলা ট্রিবিউন ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ থেকে খানিক সম্পাদিত