হতাশার গল্প বলতে আর ভাল লাগে না! ইচ্ছে করে না আর। শুনবে কে? কার দায় পড়েছে? ভাবটা এমন; গাড়ি তো চলছে। যেভাবেই চলুক, চলছে তো। আত্মতুষ্টিতে অভাব নেই। তবে আর লাভ কি কেঁদে? আর কান্নাকাটি কি কম হল? কান্নাগুলো ফিরে আসে বার বার, অরণ্যে রোদন হয়ে! কী লাভ তাহলে!
তবুও বলতে হচ্ছে। আজ আবার কাঁদতে হচ্ছে। কেঁদেছি অনেক, জীবনে। কেউ শুনেনি। স্বপ্ন’র পাজড় ভাঙার শব্দ কত নির্মম হয়, জানি আমি। তাই আজকাল আর স্বপ দেখি না। সামগ্রিক বিকশনের ইচ্ছেরা মাথা তুলতে চায়। চেঁপে ধরি। বলি, লাভ নেই। যেমন আছ, ভালো আছ। তাই থাক। আস্থার বেলুনটি ফুটো হয়ে যায়। চোখের সামনেই। কিচ্ছু বলি না। বলতে আর ইচ্ছে করে না। ভাবনাগুলো জড়িয়ে যায় হতাশার লতানো ডালের মতো। বসে বসে দেখি। দেখি আর ভাবি, খামখেয়ালীর কাছে অসহায় আত্মসমর্পনে এ কেমন তুষ্টি?
ইদানীং আশার ভরকেন্দ্রে জং লেগে আছে। প্রত্যাশার ইটগুলো ভেঙে পড়ছে একে একে। আচ্ছন্ন হয়ে রই বেঘোরো বেয়াড়ার মত। ভেবে পাই না কিছু। ভাবতে ইচ্ছেও করে না বেশি। কেন এমন ঝিমিয়ে থাকা! এ কিসের লক্ষণ? বিক্ষত আত্মার আকুতি কেন ফিরে আসে এভাবে? সম্ভাবনার গলাটিপে ধরায় এ কেমন আনন্দ? এগিয়ে যাবার কথা বলি, চলি পেছনের দিকে! ঘুরে ফিরে সামনে আসে সেই কমন প্রশ্নগুলোই।
কথা তো অনেক বলা হল। তিতা কথা, মিটা কথা, ভালবাসার রঙ মিশিয়ে, জাগিয়ে তোলার তেজ বিঁষিয়ে। ভালোবাসার শক্তিতে। কাজ তো হল না কিছু! তবুও আজ আবার বলছি। পথ মসৃণ নয় জানি। আবহাওয়া বিরূপ হয়ে উঠতে পারে, তাও জানি। মেঘ হোক আর রুদ্দুর, তবুও, চলতে হবে, কী আর করা! সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে ভয় করলে কীভাবে চলে?
দুই
কান্নাকাটি করতে হবে কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডগুলো নিয়ে। হতাশার চাঁদর এতটাই ঘিরে রেখেছে যে, আজকাল আশা করতেই আর ভরসা পাই না। ভাবি, কী দরকার অযথা চোখের পানি ফেলে। আমি দেড়শ টাকার স্ট্যাম্পে গুড অক্ষরে লিখে দিতে পারি, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডগুলো কিয়ামতের আগেও এক হবে না। আমার এই ধারণা মিথ্যে প্রমাণিত হলেই আমি বেশি খুশি হতাম; কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে আমার খুশি হওয়ার মত কোন আলামত চোখে দেখা পড়ছে না।
ঐক্যের স্বপ্ন দেখেন? আমিও দেখতাম একসময়। এখন আর দেখি না। আপনাদেরও বলি, ভুলে যান। তারচে’ বরং চলেন, আলাদা আলাদা সাইনবোর্ড নিয়ে মাটির সাথে মিতালি করতে থাকা বোর্ডগুলোর কর্তা যারা, তাদের খেদমতে কিছু আরজ পেশ করি।
জানি তারা শুনবেন না! জানি তারা ভাববেন না আমাদের পরামর্শ নিয়ে? তবুও বলা যায়। তারাই আমাদের শিখিয়েছেন, ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ!
তিন
বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডগুলো নিয়ে যে বলব, আল্লাহর কসম আমি জানি না সারা দেশে ছোট, বড়, মাঝারি, শিফনের জ্যাকেটে সদরিয়ার পকেটে সব মিলিয়ে বোর্ডের সংখ্যা কত? এ আমার ব্যর্থতা, হতে পারে। তারচে’ও বড় ব্যর্থতা আছে আমার। এ পর্যন্ত এমন কারো সাথে আমার মোলাকাত নসিব হয়নি, যার কাছে পূর্ণাঙ্গ কোনো পরিসংখ্যান আছে। স্ট্যাটিস্টিক্যাল ব্যুরো’র কাছে গেলে তারা হয়তো বলবে, মাফ চাই, দোয়াও চাই। এ কেমন অবস্থা?
একদম সহজ অংক। দুই আর দুই যোগ করে চার মেলানোর মতো। আমরা যারা জীবনের পনেরোটি বসন্ত কাটালাম ঐতিহ্যের এই বাউন্ডারিতে, কী পেলাম অথচ, কী পাবার কথা ছিলো?
আমি চেষ্টা করি হিসাব মেলাতে। মিলে না। তবুও মিলে না অংকগুলো। বসে বসে মাথার চুল ছিড়ি। ছিড়ি আর ভাবি, যখন আর চুলও থাকবে না মাথায়, তখন কী করব?
আমি জানি, এ দেশের কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডগুলোর কাছে যে প্রত্যাশা আছে পোড়খাওয়া ছাত্রদের, সেটা কিয়ামতের আগে কখনো পূরণ হবে না। কিছুটা যদিও হত, এই যেমন টুয়েন্টি পার্সেন্টও, তাহলেও হামাগুড়ি দিয়ে চলা যেত। এতটুকু দয়াও যদি তারা দেখাতেন! কওমি শিক্ষাবোর্ড-গুলো/সমূহ/ম-লীর গদিনশীনদের উদ্দেশ্যে যদি আমরা বিনীত কিছু আরজি জানাই, তারা কি ভাববেন এসব নিয়ে? জবাব হল, না। তারপরেও বলছি। সেই বলা কথাগুলোই আবার বলছি। যতদিন না তাদের সেমাহত থেকে গিশাওয়াহ না সরছে, ততদিন পর্যন্ত আমরা বলেই যাব। এতে তারা খুশি হলে ভাল, না হলেও সমস্যা নাই। অধিকার নিয়ে কথা বলবার জন্য কারো রেজামন্দির ধার ধারতে হয় না।
চার
একসময় ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন ছিলো সাপে-নেউলে। সেই সময়ের কথা বলছি, ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন নেত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী যখন বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বানানোর খাহেশ প্রকাশ করতেন। এখন আওয়ামীলীগ-বিএনপি, একে অন্যের ছায়াও মাড়াতে চায় না। এটা তাদের রাজনৈতিক বিভাজন। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে… এখানে কিন্তু বিভাজনের দেয়াল নেই কোনো। সকলের জন্য একই শিক্ষাবোর্ড, অভিন্ন সিলেবাস।
আর আমাদের আঙিনায়! আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ব্যানারের এক একটি অংশ এক এক পক্ষ দখল করে আলাদা আলাদা প্লাটফরম বানিয়ে বসে আছেন এক একজন! গড়পরতা হিসাব করলে প্রতি একডজন মাদরাসার জন্য আল্লাহর রহমতে একটি বোর্ড কায়েম করে ফেলা হয়েছে। কেন? এত বিভাজনে ফজিলত কি? কোন কিতাবে লেখা আছে বোর্ডে বোর্ডে বাড়তি সওয়াব! আমি যদি বলি রাজনৈতিক বিভাজনটাই এখানে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে, ভুল হবে? কী হয় এমন রাজনীতি না করলে, যে রাজনীতি ভাইকে ভাই থেকে আলাদা করে ফেলে।
পাঁচ
এদেশের কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডগুলোর কর্ণধারদের কখনো একত্রে সামনে পাবার সুযোগ নেই। ততটা আশাও করি না। তাই আমাদের আওয়াজ বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে লাগবে। এ জন্যে আমার মনে হয় খেতাবটা গায়িব হিশেবেই হওয়া উচিত। আমরা সেভাবেই বলছি-
মুহতারাম গায়িবীন!
সহজ কথা সহজ করে বলতে পারা বেশ কঠিন। আমরা চেষ্টা করছি। ভাল কথা। আমাদের চিনতে পারছেন তো? আমরা আপনাদেরই হতভাগা সন্তান। যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই চলেছি আমরা।
কখনো প্রতিবাদ করিনি। আর কিছু অর্জন করতে পারি আর না পারি, মান্যতার সবকটি আত্মস্থ করা হয়েছে ভালভাবেই। কিন্তু সমস্যা হলো, এদেশে একটি নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। তারা বলতে শিখে গেছে। ইদানীং লক্ষ্য করবেন কঠিন কঠিন কথাও তারা বলতে শুরু করেছে। আমাদের কলমের ডগায় সহনশীলতার লাগাম লাগানো থাকে বলে অন্তর্জ্বালা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি। যেখানেই পানি দেখছি, কোপ মারবার আগে ভাবছি হাঁটুর অবস্থান কোথায়? কিন্তু এই দশকে আপনাদের ছোট্ট ছেলেরা, যারা লিখতে শিখেছে, তারা কিন্তু এমন না। রাখডাক না করেই যা বলার বলে ফেলছে। তৃষিতের তৃষ্ণা নিবারণে খামখেয়ালী আর মনে হয় করা ঠিক হবে কিনা ভেবে দেখুন। আমাদের কথা বিবেচনায় নিন। লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না। আস্থা রাখুন, সন্তান তার পিতামাতাকে কখনো বিভ্রান্ত করে না।
খুব বেশি কিছু করতে হবে না। আমরা আপনাদের বলব না আকাশের চাঁদটা পেড়ে আমাদের সামনে এনে দিন। আপনাদের দ্বারা সম্ভব; এমন কিছুই চাইব আপনাদের কাছে। দিয়ে দেয়া উচিত।
১। পাঠ্যসূচিকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে। বর্তমানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, এমন কিতাবাদি সিলেবাসের বাইরে রাখতে হবে। খামাখা মাথা ঘামানোর দরকার কি? বাস্তবতাকে আমলে নিতে হবে। দরসে নেজামিই এক্ষেত্রে যথেষ্ট বলে ধরে নেয়া যায়। আশা করি বোর্ড’র কাছে আছে। না থাকলে আমরা সাপ্লাই দিতে পারি। আমাদের সংগ্রহে অরিজিনাল কপিই আছে।
২। বর্তমানের সাথে খুব বেশি সংশ্লিষ্ট নয় এবং ভবিষ্যতে অনেক ‘যদি কিন্তু’র উপর নির্ভরশীল কিতাবাদি বা অধ্যায়গুলো সিলেবাস থেকে আপাতত ছেটে ফেলতে হবে। সময় আসলে সময়ের গীত গাওয়া যাবে।
৩। কিতাবভিত্তিক নয়, বিষয়ভিত্তিক পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। হাদিস বিভাগ, তাফসীর বিভাগ, ফেক্বাহ বিভাগ, বিন্যাসটা এভাবে হতে পারে; বরং হওয়া উচিৎ। আপনারা কি আমার কথা বিশ্বাস করবেন, এই সময়ের অধিকাংশ ছাত্রই সব বিষয়ের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে কোনো একটি বিষয়েও পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না!
৪। কুরআন-হাদিসে নিষিদ্ধ নয়- এমন সকল প্রয়োজনীয় বিষয় সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। কেন ছেলেরা অন্যদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে? প্রতিভা আছে, চেপে রাখায় তো কোন ফায়দা নেই। না কি আছে? দিন না বিকশিত হতে। সমস্যা কি!
৫। শিক্ষা সিলেবাস শিক্ষাদান পদ্ধতিকে বর্তমানমুখি করতে হবে। ভোকেশনাল শিক্ষাকে গুরুত্বের সাথে আমলে না নেয়ার তো কোনো কারণ দেখছি না। অর্থনীতিকে অর্থনীতির লেবাসেই ছাত্রদের সামনে হাজির করার ব্যবস্থা করতে হবে, ‘ইসলাম কা এক্বতেসাদি নেজাম’ নামে নয়। খুবই কি কঠিন? চাইলেই তো পারা যায়। দরকার শুধু দৃষ্টিভঙ্গিতে একটু ঘষামাজা। আর কিছু না। রাজি হয়ে যান।
৬। অবশ্যই বাংলাকে শিক্ষাদানের মাধ্যমে বানাতে হবে। নো অলটারনেটিভ। আমরা বাংলাদেশে বাস করি। আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলো বাংলাতেই সামনে আসে। কাসিম নানুতুবীর সম্মতি আছে। সমস্যা নেই। জেনেই বলছি।
৭। শিক্ষাকে থিওরিক্যালিটির গ্যাড়াকালে আবদ্ধ না রেখে প্র্যাকটিক্যাল করতে হবে। বোর্ড’র উদ্যোগে ও অর্থায়নে মৌলিক ব্যাপার-সেপার ঠিকটাক রেখে যে কিতাবগুলা এখন পড়ানো হচ্ছে, সেগুলোকেই এই শতকের উপযোগি করে রচনা করার কথা ভেবে দেখা যায়। আর কতকাল ‘জ্বারাবা যায়দুন আমরা’ দিয়ে কাজ চালানো হবে? ‘আমর’ ছেলেটা আর কতকাল মার খাবে! বিকল্প কি নেই? উদাহরণগুলো তো কুরআন থেকেও বাছাই করা যায়। ‘ফেইল’ ‘ফাইল’ ‘মফঊল’ শিখাই তো মকসুদ। উদাহরণের অভাব আছে কুরআনে? ‘ক্বালাল্লাহ’ ক্বালা ফেইল, আল্লাহ ফাইল, চলতো না?
৮। বোর্ডের অন্তর্গত সকল মাদরাসায় একই সিলেবাস অনুসৃত হতে হবে। এ এক মহাআশ্চর্য! একই বোর্ড’র অধীনে থাকা সবগুলো মাদরাসার পাঠ্যসূচি আবার সমান নয়। এটা কেন হবে? মাদরাসাগুলো থেকে ফি নিয়ে নিয়ে বোর্ড’র একাউন্ট ভারি করছেন, তদারকি তো করেন। বছরান্তে অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে মারকাযি ইমতেহান নেয়া ছাড়া বোর্ড’র আরো কিছু দায়িত্ব আছে। সেগুলোতেও নজর দিন।
৯। একটি কমপ্লিট শিক্ষক নীতিমালা তৈরি করেন। বিস্মিত হই আমি, মানসম্পন্ন একটি শিক্ষক নীতিমালা পর্যন্ত নেই কোনো বোর্ড’র! যে কারণে বোর্ড’র অন্তর্গত, যে কোন বোর্ডই হোক, মাদরাসাগুলোর মুহতামিম সাহেব এক্সট্রা অর্ডিনারি ক্ষমতার মালিক হয়ে বসে থাকেন। উস্তাদগণের চাকরি তখন থাকে উনার মর্জির উপর। তোষামোদে কমতি হলেই ক্লিন বোল্ড! বোর্ড কর্তৃপক্ষের কেন মনে হয় না একটি ‘শিক্ষক নীতিমালা’ অপরিহার্য।
১০। জানি, জীবনেও সবগুলো বোর্ড এক হবে না। বলেও লাভ নেই কোনো। অন্তত সবগুলো বোর্ড’র মধ্যে একটি সমন্বয় তো সাধন করতে হবে। কওমি মাদরাসাগুলোর বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায় করতে হলে যে বিকল্প নেই, স্বীকৃতির আন্দোলনের মুখ থুবড়ে পড়া থেকে এই সত্যটা তো উপলব্দিতে চলে আসার কথা।
ছয়
মনে রাখতে হবে অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। তার আগে নিজেকে সেভাবেই গড়ে তুলতে হয়, মেলে ধরতে হয়। আমরা খুব বেশি কিছু চাইব না। কথা ও কাজে মিল থাকুক, এটা তো চাইতেই পারি।
কোন কথা?
দারুল উলুম দেওবন্দ। আমাদের কাছে সবচে’ প্রিয় শ্লোগান। আমরা দারুল উলুম দেওবন্দের অনুসারী। দারুল উলুম দেওবন্দের অনুসরণ মানে তো কাসিম নানুতুবীর ‘উসূলে হাশতেগানা’র অনুসরণ। আমরা তাই চাই। তাই করা হোক। কওমি ধারার দৃশ্যপট পালটে যাবে। আমাদেরকে আর অন্যদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে না। বাকিরা সবাই এসে আমাদের পেছনে লাইন দেবে।
লেখক : কথাসাহিত্যক ও সম্পাদক, সমীক্ষা- নিউইয়র্ক