কুফা নগরী। ১১০ হিজরির শুরুর দিকে সেখানে ততকালীন সময়ের বিশ্বনন্দিত, জগতখ্যাত বড়বড় আলেম-উলামা ও ফুকাহাদের মাজমা বসতো। বিদগ্ধ মুফতি, মুহাদ্দিস, ভাষাবিদ, সাহিত্যিক ও ব্যাকরণবিদদের পদচারনায় মুখর ছিল সেই মাজমা। বারো অথবা তেরো বছরের অসাধারণ মেধা ও স্মৃতি শক্তির অধিকারী, অদম্য জ্ঞান পিপাসু নুমান নামক একজন বালক প্রথমে প্রিয়নবী সা. র অন্যতম খাদেম ও জলিলুল কদর সাহাবী হযরত আনাস বিন মালেক রাহ.’র তত্বাবধানে পবিত্র কুরআন শরীফ হেফজ করে ইলমে কালামের দিকে মনোনিবেশ করেন। অত:পর হিজরী ১০০ সালে হযরত হাম্মাদ রাহ.’র দরসগাহে ভর্তি হয়ে একাধারে ১০ বছর ইলিম অর্জন করেন। পরে তিনি কুফা নগরীর আলেম-উলামা, ফুকাহাদের মাজমায় পা রাখেন। কুফা তখনকার সময়ে ইসলামি নগর হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
সেই কুফায় আগমনকারী নুমান নামের অদম্য জ্ঞান আহরনকারীই পরবর্তীতে ইমামে আযম হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন। সেই নুমান বিন সাবিতই হানাফি মাযহাবের গুরু। যাকে সমস্ত জাহানবাসী ইমাম আবু হানিফা নামেই জানে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাহ.’র মূলধারার শিষ্য হযরত হাম্মাদ রা. ছিলেন ততকালীন একজন ফিকহ শাস্ত্রের গুরু। তাঁর কাছ থেকে ইমাম আবু হানিফা রাহ. জ্ঞান আহরণ করেন তাঁর কাছ থেকে। ফিকহ শাস্ত্রের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন কুফা থেকে বিজ্ঞ ফকিহদের কাছ থেকে। ১২০ হিজরিতে হযরত হাম্মাদ রা. ইন্তেকাল করলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন হযরত ইমাম আবূ হানিফা। এরপর থেকে ইমাম আযম রাহ.’র নেতৃত্বে পরিচালিত হতে থাকে কুফার ইলমি মারকায। যাকে ততকালীন ফোকাহায়ে কেরামও কেয়াসের প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করেন। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আমিরুল মুমিনুন হযরত অবদুল্লাহ ইবনে মুবারক, হাফস ইবনে গিয়াস, ইমাম আবু ইউসূফ, ইমাম যুফার , হাসান ইবনে যিয়াদ, প্রমুখরা ছিলেন ইমাম আবূ হানিফা রা.’র মজলিসের মধ্যমনি।
ইমাম আবু হানিফা রাহ.। একটি সংগ্রামের নাম। একটি আলোকরশ্মির নাম। ইলমের একটি সাগরের নাম। একটি চেতনার নাম। কুরআন-হাদিস, ইজমা-কিয়াসের সমষ্ঠির নাম। জিহাদময় জীবনের নাম ইমাম আবু হানিফ। ইমাম আবু হানিফা তিনিই যার মাসআলার সমাধান দেখে চিনেছেন ইমাম আওযায়ী। যার সম্পর্কে ইমাম মক্কি ইব্রাহিম রাহ. বলেছেন, যার জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জিহাদ। দারুল হিজরতের (মদীনার) ইমাম মালেক রাহ. তাঁর সম্পর্কে বলেন, ও যদি এই লোকটা কাঠের পালঙ্গকে যুক্তি দিয়ে স্বর্ণ বানাতে চান, পারবেন।
যিনি সরাসরি চারজন সাহাবি এবং প্রায় চার সহস্রাধিক তাবেঈ মাশায়েখের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহন করেছেন। ফিকহ শাস্ত্রের অদ্বিতীয় পন্ডিত ছিলেন যে ইমাম আবু হানিফা। তাছাড়া ইলমে হাদীস, ইলমে কালাম, ইলমে বালাগাত, ইলমে নাহু, ইলমে সরফ, ইলমে তাফসীর প্রভৃতি বিষয়ে যার তুলনা তিনি শুধু তিনি নিজেই। সেই মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধর্মের নামে আগাছা লা-মাযহাবিরা বলে তিনি নাকি মুহাদ্দিস ছিলেন না। হাস্যকর এসব কথার প্রেক্ষিতে আমি বলতে চাই তোমার কথা মতো ধরে নিলাম ইমাম আবু হানিফা মুহাদ্দিস ছিলেন না ঠিক। তিনি ছিলেন উস্তাযুল মুহাদ্দিসীন। শতশত মহান ব্যক্তিরা তাঁর কাছ থেকে হাদিসের দারস গ্রহণ করে স্বীয় যুগে জগতখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন আটশত আশিজন শিষ্যের উস্তায। আমর ইবনে মাইমুনা, ইমাম যুফার, সুফিকুল শিরোমণি দাউদ তায়ী, হাববান ইবনে আলী, কাসেম ইবনে মায়ান, আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক রহ., কযিউল কুযাত ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ বিদগ্ধ মুফতি-মুহাদ্দিস ও ফকিহবিদদের উস্তাদ ছিলেন ইমাম আযম রাহ.।
অপপ্রচারে আগাছা: যাত্রীরা হুশিয়ার
হাল যামানা ডিজিটালের হাওয়ায় ভাস্বর একটি যুগ। যুগের সাথে তাল মেলাতে পাশ্চাত্যের গোলামির শিকলে নিজেকে বেঁধে স্যুর্ট-কোর্ট, টাই পড়ে মিডিয়ার সামনে বকবক করে পর্দাবেপর্দা, এগানা-বেগানা নারীদের বাহ্বা কুঁড়িয়ে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হওয়া যেতে পারে। ইমাম আবু হানিফা রাহ.’র মতো বিশ্ববাসীর কল্যাণে ইসলামি দিকনির্দেশনাকারী, জটিল সমস্যার সমাধানে গভীরে যাওয়ার যোগ্যতা লাভ করা যায়না।
যুগ ডিজিটাল। চিন্তা-ফিকিরও হবে ডিজিটাল। সমস্যা ডিজিটাল। এর সমাধানও হবে ডিজিটাল তরিকায়। এটাই ডিজিটালের চাহিদা। শ্রোতারা স্যুর্ট-কোর্ট, টাই পরিহিত, বক্তাও হবেন ঠিক এমন। এভাবে চলছে। চলুক। যুগ চাহিদার খোরাক যোগাচ্ছেন। তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে চলেছেন। লাইভ প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছেন। বইপুস্তক বাজারজাত করছেন। ভালো। বেশ ভালো। তবে ইসলামের প্রচারের নামে অপপ্রচার। মানা যায়না। মাযহাব ছাড়া ধর্মপালন অসম্ভব। তবে কেন রোগাক্রান্ত হলে ডাক্তার প্রয়োজন হয়। ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশন মানা হয়। অনেক হালাল আহার্য্য খাদ্যদ্রব্য ডাক্তারের নির্দেশে খাওয়া থেকে বিরত থাকা হয়।
মিডিয়ায় কিছু দাঁড়ি, টুপি, পাঞ্জাবি পরিহিত নামধারী মৌলভীদের আনাগুনা বেড়ে গেছে। যাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে মনে হয় যেনো তারা ধর্মের ঠিকাদারী পেয়ে গেছেন। যার কারণে একটি মহলকে রাজি আর খুশি করার মানসে তারা কিতাব পড়ার সময় পান না। তবে আগে বেশ ভালো করে পড়ালেখা করার দরুণ মুখস্ত রেফারেন্স দেওয়ায় খুব পারদর্শী।
এসব টিভি মৌলভী আর আহলে হাদিস নামধারী হাদিস বিরোধী চক্র ইমামে আযম আবু হানিফা সম্পর্কে বলে থাকে তিনি নাকি হাদিস জানতেন না। তিনি নাকি সহিহ হাদিসের পরিবর্তে দুর্বল হাদিস বর্ণনা করতেন। বগলে বাংলা বুখারি বহন করে পাড়া-মহল্লায় ঘুরে বেড়ায়। আর বিবেদ সৃষ্ঠি করে। বাংলা বুখারি শরিফ পড়ে তারা সহিহ হাদিস পায়। আর ইমাম আবু হানিফা বিশ্ববিখ্যাত মনিষীদের কাছ থেকে থেকে হাদিসের সবক নিয়েও সহিহ হাদিস পেলেননা। আজব তেলেসমাতি। আজিব বাতচিত। ইছি হায় আহলে হাদিস।
সত্যিকার অর্থে কুরআন-হাদিস সম্পর্কে তাদের সঠিক জ্ঞান নেই। এবং ইমাম আবূ হানিফা রাহ.’র জ্ঞান সম্পর্কেও তাদের কোন ধারনা নেই। ইমামে আযম আবু হানিফা রাহ. যেভাবে প্রত্যেকটি বিষয়ের সমাধান দিয়েছেন আজ পর্যন্ত কেউ এতসুন্দর সামাধান দিতে পারেনি এবং তাঁর প্রদত্ত কিয়াসগুলোর খন্ডন আজও কেউ করতে পারেনি।
ইমাম আওযায়ী রা. যিনি ইমাম আবূ হানিফা রাহ.’র সমকালিন মুজতাহিদ ও মুহাদ্দিস ছিলেন তিনি একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহ. কে বললেন, কুফায় গজিয়ে উঠা এই বেদাআতির পরিচয় কি? যাকে আবু হানিফা উপনামে ডাকা হয়? ইমামে আযম আবু হানিফা রাহ.‘র প্রাণপ্রিয় শিষ্য ইবনে মুবারক এ কথা শুনে চুপ থাকেন, এসময় তিনি কিছু জটিল ও দুর্বোধ্য মাসআলা বর্ণনা করেন এবং সর্বজনগ্রাহ্য ফতোয়ার দিক নির্ণয় করেন। ইমাম আওযায়ী রা. বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে বলেন কে দিয়েছেন এই ফতোয়া? ইবনে মুবারক বলেন ইরাকের জনৈক শায়খ যার সাক্ষাতে এই মাসআলা ও ফতোয়া জেনেছি। ইমাম আওযায়ী রা. বলেন যিনি এই ফতোয়া দিয়েছেন তিনি মাশায়েখকুল শিরমণি। যাও তার কাছে গিয়ে আরো ইলিম হাসিল করো। ইবনে মুবারক বললেন, হযরত! সেই শায়খের নাম আবু হানিফা। পরবর্তীতে মক্কায় ইমামে আযমের সাথে ইমাম আওযায়ী রা. এর সাক্ষাত হয় এবং অনেক মাসআলা নিয়ে আলোচনা (তর্ক-বিতর্ক) হয়। অবশেষে ইমাম আওযায়ী রাহ. ইমাম আবু হানিফা রাহ. সম্পর্কে বলেন, লোকটার গভীর জ্ঞান ও অসামান্য বুদ্ধি বিবেকের প্রতি খামোখাই সমালোচনার তীর ছুড়েছি। এজন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। সত্যি বলতে কি আমি প্রকাশ্য ভুলের মাঝে ছিলাম। মহামানবের চরিত্রে এলজাম দিয়েছিলাম। লোকমুখে যা শুনেছি এর থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
লোকমুখে শুনে ইমাম আওযায়ী রা. ইমাম আবূ হানিফা রা. সর্ম্পকে সঠিক ধারনা পোষন করেননি। কিন্তু যখন ইমাম আবূ হানিফা রাহ.’র গভীর জ্ঞানের কথা শুনলেন তখন তিনি তাকে মাশায়েখকুল শিরমণি বলেছেন। আর আজকে যারা ইমাম আবূ হানিফা রাহ. সর্ম্পকে মন্তব্য করার মত দু:সাহস করে তাদের অস্তিত্ব ঠিক আছে কিনা খবর নাই। অবস্থা দেখে মনে হয় তারা আধুনিক যুগের সংস্কারক।
অতএব পরিশেষে বলতে চাই যারা বলেন ইমাম আবু হানিফা রাহ. হাদিস জানতেন না। তিনি মুহাদ্দিস ছিলেননা। তাদের এই কথার কোন ভিত্তি নেই। বরং যারা এসব কথা বলে তাদের জ্ঞান-চিন্তাভাবনা যেখানে শেষ ইমাম আযম আবু হানিফা রাহ.’র জ্ঞান-চিন্তাভাবনা সেখান থেকে শুরু। ইমাম আবু হানিফা রাহ. সম্পর্কে কোনো কিল ও ক্বাল না করে বরং তাঁর প্রদত্ত মাসআলা তথা হানাফি মাযহাব অনুসারে নিজের জীবনকে বাস্তবায়ন করাই প্রকৃত জ্ঞানীর কাজ। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সহিহ সমুঝ দান করুন। আমিন।
তথ্যসূত্রঃ ১. বুখারী শরিফ, ২. মুসলিম শরীফ, ৩. খতিবে বাগদাদী, ৪. মানাকিবু ইমামিল আযম আবী হানিফা, ৫. আল খাইরাতুল হিসান
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
syl.atiknogori@gmail.com