বেশি নয় এইতো কদিন পূর্ব পর্যন্ত আলকায়েদা ও আইএস আন্তর্জাতিক ইস্যু ছিলো। কিন্তু এখন দেখি তা ক্রমান্বয়ে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হতে যাচ্ছে। ইদানিং বিদেশী দু’জন নাগরিক হত্যার দায়ভার আইএসের উপর পড়ার পর বিষয়টা আরেকটু ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। এরপূর্বে বিভিন্ন হত্যার দায়িত্ব আলকায়েদা নিয়েছে।
ইতোমধ্যে আশাকরি প্রায় প্রত্যেকের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আলকায়েদা এবং আইএস দুটি ভিন্ন বিষয়। তালেবান-আলকায়েদা-টিটিপি তাদের আমীর হিসেবে ইমারাতে ইসলামিয়্যাহ আফগানিস্তানের প্রধান আমীরুল মুমিনীন মোল্লা আখতার মুহাম্মদ মনসুর হাফিজাহুল্লাহের হাতে বাইয়াহ দিয়েছে। অপরদিকে আইএস তাদের আমীর হিসেবে জনাব বাগদাদির হাতে বাইয়াহ দিয়েছে।
নিম্নে পত্র-পত্রিকার সূত্রে সরলভাবে উভয়গ্রুপের পার্থক্য খুঁজে বের করি।
১- দুনোদলের আমীরের মধ্যে পার্থক্য:
গত রমজানের আগে রমজানের শুরুতে, তখনকার আইএস আইএস মুখপাত্র জনাব আদনানি ‘এটা আল্লাহর অঙ্গীকার’ শিরোনামে একটি অডিওবার্তা রিলীজ করেন। ওই বার্তার মধ্যে তিনি একসময়ের ইসলামিক স্টেট ইরাকে(isi)র প্রধান, পরবর্তীতে ইসলামিক স্টেট ইরাক ও সিরিয়া(isis)র প্রধান জনাব বাগদাদিকে মুসলিম উম্মাহের খলীফারূপে ঘোষণা করেন।
এরপরের শুক্রবারে মসুল জামে মসজিদ বাগদাদি জাতির উদ্দেশ্য ভাষণ দেন, তা ভিডিও আকারে প্রকাশিত হয়, এটাই তাঁর প্রথম প্রকাশিত ভিডিও। কিন্তু তার বাইয়াত গ্রহণের ভিডিও দেখা যায় নি।
অপরদিকে চলতি রমাজানের পর ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের প্রধান হিসেবে আমীরুল মুমিনীন মোল্লা আখতার মুহাম্মদ মনসুর হাফিজাহুল্লাহ একটি মসজিদে জনসম্মুখে বাইয়াহ নেন।
এবার উভয় নেতার মধ্যে একটু পার্থক্য খুঁজুন।
জনাব বাগদাদী খলীফা হিসেবে বাইয়াহ নিলেন, অথচ জনসম্মুখে বাইয়াহ নেওয়ার ভিডিও নেই, এমনকি আজও উনার অনুসারীরা জানে না উনি কোথায়। এটা কেনো? এজন্যে যে, উনার নিরাপত্তার জন্যে হুমকি, তাই না? আচ্ছা যিনি মুসলিম উম্মাহের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিলেন, অথচ নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত নন, তিনি কীভাবে মুসলিম উম্মাহের খলীফা হতে পারেন? দেখাতে পারবেন, ইসলামের ইতিহাসে কোনো খলীফাকে যিনি বাগদাদির মতো আত্মগোপনে ছিলেন। এমনকি ইসলামের সর্বশেষ দুর্বলতম পদচ্যুত উসমানি খলীফা আব্দুল মজিদও তো এরকম ছিলেন না।এই বাগদাদি নাকি আবার নবুওয়তের আদলের খলীফা। অথচ একজন খলীফার দায়িত্ব হচ্ছে, প্রতিটি মুসলিম জান-মাল, ইজ্জত আব্রু এমনকি মুসলিমভূমির একটি ডিমেরও সংরক্ষণ করা। আর যদি খলীফাও লুকিয়ে-চুপিয়ে থাকেন, তাহলে জনসাধারণ কার শরণাপন্ন হবে? আর যদি প্রকাশ্যে আসার সামর্থ্য না থাকে, তাহলে কেনো খিলাফাহ ডিক্লেয়ার করলেন? খিলাফাহ তো শুধু তাঁর উপর নয়, সমস্ত মুসলিম উম্মাহের উপর ওয়াজিবে কিফায়ী। কী প্রয়োজন সামর্থ্য না থাকার পরও এই গুরু দায়িত্ব নেওয়ার? আর ফিতনা সৃষ্টি করার।
অপরদিকে যদি আমরা ইমারাতে ইসলামিয়্যাহ আফগানিস্তানের প্রধান মোল্লা আখতার মুহাম্মদ মনসুর হাফিজাহুল্লাহের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই যে, উনি প্রকাশ্যে মসজিদে বাইয়াহ নিয়েছেন। যা ভিডিও আকারেও প্রকাশিত হয়েছে। তাহলে বোঝা গেলো যে, তাঁর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বাগদাদি থেকে শক্তিশালী, অথচ আফগানিস্তানে এখনো মার্কিন সৈন্য বিদ্যমান, এরমধ্যেও তিনি এই বাইয়াহ নিয়েছেন। আর বাগদাদির বাইয়াহর সময় ইরাকে মার্কিন সৈন্য ছিল না, তারপরও এই ভয়?
২- পাবলিক সাপোর্ট :
আইএসের দখলে এখনপর্যন্ত ইরাক ও সিরিয়ার বেশ কিছু ভূমি রয়েছে। এমনকি বলা হয়, যে, সিরিয়ার প্রায় ৫০% এলাকা তাদের দখলে। কিন্তু জনসমর্থনের অবস্থা কী? ইরাক-সিরিয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে সুন্নী মুসলমানরা পালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের আমীর বাগদাদি একবার্তায় ইরাকের আনবার, দিয়ালা থেকে মানুষ পালিয়ে না যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন। এই যে দেখছেন, সিরিয়া থেকে লাখো লাখো মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে, তারা কার এলাকা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে? বাশারের এলাকা থেকে যারা পালিয়ে যাবার ছিলো তারাতো ২০১১-১২ তেই পালিয়ে গেছে। যদি আইএসের অধীনের ৫০% এলাকা থাকে তাহলে তারা কী এদের এলাকা থেকে পালিয়ে যায় নি? এমনকি মৃত আয়লানও ছিলো আইএস ভূমির বাসিন্দা!
আচ্ছা খিলাফাহ যদি হয় মুসলিমদের রক্ষার জন্যে, তাহলে কেনো মুসলমানরা তাদের এলাকা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে?
এর দুটি কারণ হতে পারে। ১- তারা মুসলিমদের নির্যাতন করেন। ২-তারা জনগণকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। যদি এ দুটির যেকোনো একটি পাওয়া যায়, তাহলে এ খিলাফাহ হচ্ছে একটি ব্যর্থ খিলাফাহ। যা আদৌ কোনো খিলাফাহও নয়।
অপরদিকে আপনি যদি তালেবানদের দ্বারা কুন্দুজ বিজয় দেখেন, তাহলে দেখবেন যে, কেউ তালেবানদের ভয়ে পালিয়ে যায় নি, বরং জনতা তাদেরকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে।
তাহলে জন সমর্থন কার বেশি? আইএসের? না ইমারাতে ইসলামিয়্যাহের?
৩- বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম:
ইতোমধ্যে আলকায়েদা এবং আইএস উভয়ই বাংলাদেশে বিভিন্ন হত্যাকান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। পত্রিকা তাই বলছে, বাকী আল্লাহ ভালো জানেন। এবার আমরা উভয়দলের হামলার ধরনের উপর একটু চোখ বুলাই।
আলকায়েদা এখনপর্যন্ত যেসব হত্যাকান্ডের দায়িত্ব স্বীকার করেছে, সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে- অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, অনন্ত, নীলয়।
আলকায়েদা যাদেরকে মেরেছে তাদের অপরাধ সুস্পষ্ট, শরীয়াহের আলোকেও এ হত্যা বৈধ। এজন্য এসব পোকা-মাকড়ের হত্যার পর অনলাইনে-অফলাইনে নবীপ্রেমীদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে।
কিন্তু আইএস কাদের হত্যার দায়িত্ব নিয়েছে? এইতো বিদেশী নাগরিক ইটালীর ত্রানকর্মি তাবেলা ও জাপানিকে। এই হত্যায় কি এদেশের লোক অভিজিৎ হত্যার মতো আনন্দিত হয়েছে? আচ্ছা তাদের অপরাধ কী তা কি আইএস স্পষ্ট করেছে?
তাদেরকে কি একারণে হত্যা করা হয়েছে যে, তারা বিদেশি নাগরিক? না, একারণে যে, তারা কাফির? যদি কাফির হওয়ার কারণে খুন করা হয় তাহলে বাংলাদেশেতো কাফির আছে, এমনকি খৃষ্টান মিশনারীও আছে। আর যদি এ কারণে হত্যা করা হয় যে, তারা বিদেশী নাগরিক। তাহলে বলবো, যে, শুধু বিদেশী হলেই হত্যা করতে হবে এটা কোন শরীয়তে পেয়েছেন? আর যদি বলেন, এরা হারবী! তাহলে বলুন, জাপান কোন মুসলিম দেশের সাথে যুদ্ধে আছে?
না, এ কারণে হত্যা করা হয়েছে যে, সারা দুনিয়া জানুক যে, বাংলাদেশে ‘আইএস’ আছে? জিহাদ কার জন্যে, দুনিয়াবাসীর জন্যে, না আল্লাহর জন্যে?
যাদের নেতা গোপনে থেকেও নিজেকে খলীফা বলেন, যাদের ভয়ে জনতা দেশ ছেড়ে পালায়, তাদের শাসনের তুলনায় পানিতে ডুবে মরাকে পছন্দ করে, যারা সুস্পষ্ট কোনো কারণ ছাড়া মানুষকে হত্যা করে, তারা দাঈশ হোক, আর খারিজি হোক, কিন্তু মুজাহিদ হতে পারে না।
অনেকে বলবেন, যে, আইএসতো নিজস্ব মুদ্রা চালু করেছে। আমি বলবো, মুদ্রা চালু করলেই যে, খিলাফাহ হয়ে যায় এটা কই পাইলেন? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে, খিলাফাতে রাশেদার যুগেও ইসলামের নিজস্ব মুদ্রা ছিল না, ইসলামের নিজস্ব মুদ্রা সর্বপ্রথম উমাইয়্যাহ খলীফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের সময় চালু হয়েছে। তাহলে নবীজীর শাসনকাল আর খিলাফাতে রাশেদাকে কী বলবেন?
(দেখুন, বেদায়াহ ওয়ান নেহায়াহসহ ইসলামের ইতিহাস সম্বলিত যেকোনো নির্ভরযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থ)
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট