আন্তর্জাতিক: সিরিয়ার কুর্দি গেরিলাদের কাছে আমেরিকা যেসব অস্ত্র দিয়েছে তা ফেরত নিতে ওয়াশিংটনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তুরস্ক। মার্কিন সমর্থিত সিরিয়ার কুর্দি গেরিলাদেরকে তুরস্ক সন্ত্রাসী বলে মনে করে এং তুরস্কের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে আংকারা।

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হামি আকসয় আজ (মঙ্গলবার) এক  সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আগামী ৮ ও ৯ তারিখে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে আংকারা এ বিষয়ে বিশেষ জোর দেবে এবং কুর্দি গেরিলা গোষ্ঠী ওয়াইপিজি-কে দেয়া অস্ত্র ফেরত নেয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হবে।

আকসয় বলেন, তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভুলত চাভুসওগ্লু আগামী ১২ থেকে ১৪ মার্চ রাশিয়া সফর করবেন এবং পরে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের সঙ্গে ১৯ মার্চ বৈঠক করবেন। ধারণা করা হচ্ছে- এসব বৈঠকে কুর্দি ইস্যু গুরুত্ব পাবে। ওয়াইপিজি-কে সমর্থন দিয়ে আসছে আমেরিকা এবং এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গত ২০ জানুয়ারি থেকে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। তার আগে আমেরিকা সিরিয়ার আফরিন এলাকায় ৩০ হাজারর কুর্দি গেরিলা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছিল।

সিরিয়ায় গুম-ধর্ষণ চলছে সমানতালে

একদিকে চলছে সরকার ও মিত্র বাহিনীর অত্যাচার- গুম অভিযান। অপরদিকে বিদ্রোহীগোষ্ঠী, ইসলামী উগ্রপন্থীদের পাল্লা দিয়ে নারী ধর্ষণ লালসা। এক ভয়ানক খেলায় মেতে উঠেছে সরকার-বিদ্রোহীগোষ্ঠী। শিকারে পরিণত হচ্ছে নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিক। নিজের বাড়ির উঠোনে ধর্ষিত হচ্ছে মা, যুবতী বোন। চোখের সামনে ধর্ষণ হতে দেখেও অসহায় বাবা, জওয়ান ভাইগুলোও চিৎকার-আর্তনাদ ছাড়া কিছুই করতে পারছে না।

রুখতে গেলেই বুটের নিচে ফেলে বেধড়ক মারা হচ্ছে। ক্ষোভ, লজ্জা, ঘেন্নায় অতিষ্ঠ মানুষগুলো আর বেঁচে থাকতে চাইছে না। মুক্তি চাইছে এই নরক যন্ত্রণা থেকে। চৌদ্দ-পনেরো বছরের ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সামনে থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তাদের বাবাকে।

সদ্যবিবাহিতার সামনে থেকে তার স্বামীকে যেতে না চাইলে বন্দুকের নল নিয়ে মাথায় আঘাত করে রক্তাক্ত করা হচ্ছে। এরপর নিস্তেজ শরীর টেনে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর হয়তো কোনোদিন ফিরেও আসবে না তাদের প্রাণপ্রিয় বাবা। তারপরও বাস্তুহারা পরিবারগুলো আশা ছাড়তে নারাজ। বসে বসে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে- কবে ফিরে আসবে তাদের বাবা? কখন আসবে স্বামী।

সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদের সময় গুম, অত্যাচার, হত্যা- এসব মানবতাবিরোধী কাজ দণ্ডনীয় অপরাধ ছিল। এ নিয়ম ২০০০ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল।

২০১১ সালে দেশে সরকার-বিদ্রোহীদের মাঝে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই বাড়তে থাকে এ জঘন্যতম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের? (এসওএইচআর) তথ্য মতে, এ পর্যন্ত সরকার ও তার মিত্রবাহিনী প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার মানুষকে ধরে নিয়ে গেছে। যার মধ্যে ৯৫ হাজার বেসামরিক নাগরিক। বাকি ৫০ হাজার বিভিন্ন বিদ্রোহী ও ইসলামী উগ্রবাদী দল।

এদের মাঝে আছে আইএস, ফাতেহ আল সাম, কুর্দি বাহিনীর সদস্য। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মোট নিখোঁজের সংখ্যা বলছে ১ লাখ ১৭ হাজার। তবে বেসামরিক নাগরিকের সংখ্যাটা একই আছে। সংস্থাটি অবশ্য জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাওয়া মানুষের একটা হিসাব দিয়েছে। সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজারের কাছাকাছি। এখনও নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজারের মতো।

সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সংস্থা দুটি একটি ভিন্নধর্মী তথ্য প্রকাশ করে। এতে ধরে নিয়ে যাওয়া মানুষের ফাঁসির মাধ্যমে মৃতের সংখ্যার হিসেব দেয়। যাদের ধরে নিয়ে কারাগারে আটকে রাখা হতো। সারা দিন অকথ্য অত্যাচার চালানো হতো তাদের ওপর। শেষ পর্যন্ত কোনো তথ্য বের করতে না পারলে মাঝরাতে কারাগার থেকে বের করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারত। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাগুলোর দাবি, এ পর্যন্ত যত গুম, অত্যাচার হয়েছে তার বেশিরভাগই করেছে সরকার ও তার মিত্রবাহিনী।

২০১১ সালের শেষের দিকে এ গুমের বিরুদ্ধে একটি শান্তিপূর্ণ প্রচারণা চালায় বেসামরিক নাগরিক ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল। তারপর আসাদ বাহিনী তার মিত্রদের প্ররোচনায় কয়েক হাজার মানুষ ধরে নিয়ে যায়। বেসামরিক নাগরিকসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সদস্যও ছিল। বিরোধী দলের কর্মী, ডাক্তার, সমাজকর্মী, সাংবাদিক, বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী, অনেক ত্রাণদাতা প্রতিষ্ঠানের কর্মীসহ প্রায় সব পেশাজীবী ছিলেন।

ধরে নিয়ে যাওয়ার পর কেউ কেউ ফিরে এলেও বেশিরভাগই এখনও নিখোঁজ। সেই থেকে শুরু করে আজ সাত বছর হতে চলল- এখন পর্যন্ত গুম অভিযান অব্যাহত রেখেছে সরকার (অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল)। সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসা অনেক শরণার্থী ইউরোপ, আমেরিকার মতো বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। তারা প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাওয়া সদস্যদের ফিরে পেতে ইউরোপের রাস্তায় রাস্তায় মানববন্ধন করছে। ইতিমধ্যে তারা ফ্যামিলিস ফর ফ্রিডম নামে একটি সংগঠন খুলেছে। এদের আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে দ্য সিরিয়া ক্যাম্পেইন, উইমেন ফর ডেভেলপমেন্ট, দাওলাতি নামের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

২০১৩ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে যুদ্ধের সময় ধর্ষণ বন্ধে একটি বৈঠকে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল বিশ্বের শীর্ষ শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৮। বৈঠকে বলা হয়, যুদ্ধের সময় নারী এবং শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন, ধর্ষণকে যুদ্ধের একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা এখনও বড় ধরনের একটি সমস্যা।

এ সমস্যা নিরসনে এই প্রথম উন্নত দেশগুলো একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিল। কোথায় গেল আজ সেই সিদ্ধান্ত? ২০১১ সালে শুরু হওয়া ক্ষমতা দখলের এই লড়াইয়ের আজ সাত বছর। যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে সিরিয়ার নারী ও শিশুদের ওপর ব্যাপক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণের শিকার হয়ে বা এর আতঙ্কে অনেক সিরীয় পার্শ্ববর্তী জর্ডান ও লেবাননে পালিয়ে গেছে।

সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজারের বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে সিরিয়াতে ৭৫ লাখ মহিলা ও কম বয়সী নারী ‘ধর্ষণ’ ঝুঁকিতে আছে।

অবরুদ্ধ পূর্ব গৌতায় প্রবেশ করেছে ত্রাণবহর

দামেস্কের কাছে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত পূর্ব গৌতায় প্রবেশের জন্য আল ওয়াফিদিন চেকপয়েন্টে অপেক্ষমাণ সিরিয়ান রেড ক্রিসেন্টের ত্রাণবাহী যানবহরের পাশে প্রহরারত এক সিরীয় সৈন্য : এএফপিদামেস্কের কাছে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত পূর্ব গৌতায় প্রবেশের জন্য আল ওয়াফিদিন চেকপয়েন্টে অপেক্ষমাণ সিরিয়ান রেড ক্রিসেন্টের ত্রাণবাহী যানবহরের পাশে প্রহরারত এক সিরীয় সৈন্য : এএফপি

অবরুদ্ধ পূর্ব গৌতায় ৪৬টি ট্রাকের একটি ত্রাণবহর প্রবেশ করেছে। প্রায় এক মাস পর চার লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই বিধ্বস্ত ছিটমহলে প্রথম ত্রাণবহর প্রবেশ করল। রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটির (আইসিআরসি) এই ত্রাণবহর সরকার নিয়ন্ত্রিত ওয়াফিদিন চেক পয়েন্ট দিয়ে সেখানে প্রবেশ করে।

আইসিআরসির মধ্যপ্রাচ্য অপারেশনের প্রধান রবার্ট মারডিনি গতকাল এক টুইটে বলেন, পূর্ব গৌতার হাজার হাজার লোকের জন্য অতি জরুরি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে অন্তত একটি ত্রাণবহর সেখানে রওনা দিয়েছে। আইসিআরসিএর একজন মুখপাত্র বলেন, বহরটিতে চিকিৎসাসামগ্রী এবং ৫৫০০টি খাবারের বস্তা রয়েছে, যা সাড়ে ২৭ হাজার মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে।

বহরটির সাথে থাকা জাতিসঙ্ঘের সিনিয়র কর্মকর্তা আলী আল-জাতারি বলেন, বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ছিটমহলটিতে পৌঁছতে অনেক সময় লাগবে এবং বহরটির পূর্ব গৌতা ত্যাগ করতে অনেক রাত হয়ে যাবে।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পূর্ব গৌতায় সিরিয়া সরকার ও রাশিয়ার বিমান হামলায় সাত শ’রও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে বিদ্রোহীরা অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করছে।

এদিকে সিরিয়ার পূর্ব গৌতায় পিছু হটছে বিদ্রোহীরা। বিদ্রোহীদের দমনে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর হামলার পরিপ্রেেিত হাজার হাজার মানুষ শহর ত্যাগ করছে। সন্ত্রাসবাদ উৎপাটনের আগ পর্যন্ত অভিযান চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। এ দিকে বিমান হামলার মধ্যেই সিরিয়ার পূর্ব গৌতায় জরুরি মানবিক সহায়তা পৌঁছেছে।

সিরিয়ান অবজারভেটরি অব হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে পূর্ব গৌতার এক-চতুর্থাংশ অঞ্চল অধিকৃত করেছে সরকারি বাহিনী। সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, রাশিয়ান বিমানবাহিনীর সহায়তায় বেশ কিছু গ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিতে সম হয়েছে সরকারি বাহিনী।

একটি সমর্থিত সেনা সূত্রে জানা গেছে যে, দামেস্কের আল নাসিবিয়াহ এবং ওতায়াসহ বেশ কিছু অঞ্চলে বিদ্রোহীদের হটিয়ে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সরকারি বাহিনী। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটরি বলেছে, গৌতার মধ্যাঞ্চলের মেসরাবা শহরের সীমান্তে পৌঁছে গেছে সিরিয়ান বাহিনী। পূর্ব গৌতায় ভারী গোলাবারুদ ছুড়ে ও আকাশপথে বিমান এবং হেলিকপ্টার ব্যবহার করে সাঁড়াশি আক্রমণ চালাচ্ছে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী। ফলে বিদ্রোহীরা পিছু হটতে বাধ্য হলেও তারা পুনর্গঠিত হচ্ছেÑ এমনটিই জানিয়েছে বিদ্রোহীদের একটি দল ‘জাইস আল ইসলাম’। এক অডিওবার্তায় দলটির মুখপাত্র হামজা বিরকদার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন যে, অধিকৃত অঞ্চল থেকে সরকারি বাহিনীকে উচ্ছেদ করা হবে। তিনি আরো বলেন, সরকারি বাহিনীকে মোকাবেলা করতে তারা দলের শক্তি বৃদ্ধি করছেন।

সুত্র: এরাবিয়ান জার্ণাল