আতাউর রহমান খসরু : কওমি শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতি এ দেশের আলেম-উলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষের বহুদিনের প্রাণের দাবি। আয়-উপার্জন বা সরকারি চাকরি নয়; বরং শিক্ষার স্বীকৃতি ও সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করেই স্বীকৃতির দাবি করেছেন তারা। কওমি মাদরাসার স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই এ স্বীকৃতি চেয়ে আসছেন বারবার। ফলে দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে এ দেশের লাখ লাখ কওমি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে।
উলামায়ে কেরামের দাবি ও আন্দোলনের ফলে বিগত চারদলীয় জোট সরকার কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি প্রদান করলেও নানা প্রতিকূলতায় তা প্রহসনে পরিণত হয়।
অবশেষে দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১১ এপ্রিল কওমি শিক্ষা সনদের মান ঘোষণা করেন। তিনি দাওরা হাদিসকে মাস্টার্স (অ্যারবিক ও ইসলামিক স্টাডিজ) সমমানের ঘোষণা করে বলেন, ‘কওমি মাদরাসার স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এবং দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতি অক্ষুণ্ণ রেখে কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ শ্রেণি দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজ ও অ্যারাবিকে মাস্টার্সের সমমান ঘোষণা করা হলো।’
স্বীকৃতি প্রদানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি স্বীকৃতি দিতে চাই, স্বীকৃতি দিবো কিন্তু কারিকুলাম প্রস্তুতের দায়িত্ব উলামায়ে কেরামের। আপনারা সর্বসম্মতিক্রমে যে কারিকুলাম পেশ করবেন আমরা তার আলোকে আইন প্রস্তুত করবো।’
কওমি শিক্ষা সনদের মান প্রদানের জন্য প্রণীত আইন ও শিক্ষা কারিকুলামে প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার প্রতিফলন দেখতে চান উলামায়ে কেরাম।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর ৬ মাস পর কওমি শিক্ষা সনদের মান বাস্তবায়নের নানা প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। যেমন, সরকার নীতিমালা ও কারিকুলাম তৈরির জন্য ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চতর কমিটি গঠন করেছে, প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব ‘কওমি বিশ্ববিদ্যালয়ে’র জন্য কেরানিগঞ্জে ৩ একর জমি প্রস্তাব করেছেন এবং সরকার স্বীকৃত ‘সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটি’ বা হাইআতুলউলয়া প্রস্তাবিত জমি মূল্যের বিনিময়ে নিতে সম্মত হয়েছে, এ কমিটি তার একটি (খসড়া) গঠনতন্ত্র প্রস্তুত করে তা যাচাইয়ের জন্য ৯ সদস্য বিশিষ্ট উচ্চতর কমিটির নিকট হস্তান্তর করেছে, হাইআতুল উলয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত। ইত্যাদি।
সরকার ও ‘সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটি’র এসব পদক্ষেপ ও প্রক্রিয়া উলামায়ে কেরামের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। উলামায়ে কেরামের কেউ কেউ মনে করছেন, এসব পদক্ষেপে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটেনি এবং তাতে কওমি মাদরাসার স্বাতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ন হতে পারে। তবে সংশ্লিষ্টরা এর সন্তোষজনক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।
(খসড়া) গঠনতন্ত্র : সবাই জানে, জানি না
গত ০২ অক্টোবর’১৭ ঢাকার পীরজঙ্গী মাদরাসায় ‘সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটি’র বৈঠক (নং ৬) অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশে’র একটি (খসড়া) গঠনতন্ত্র উপস্থাপিত হয়। এবং তা পাশ হয়েছে বলে, বৈঠকের রেজুলেশনে (ধারা ৭) উল্লেখ করা হয়েছে।
বৈঠকে উত্থাপন ও আলোচনা হলেও গঠনতন্ত্র সম্পর্কে পূর্ব কিছুই জানতেন না বলে দাবি করেছেন বেফাক ব্যতীত অন্য ৪ বোর্ডের প্রতিনিধিগণ (ইত্তেহাদুল মাদারিসের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয় নি)। তাদের ভাষ্যমতে গঠনতন্ত্র কারা তৈরি করেছেন এবং কিসের ভিত্তিতে তৈরি করেছেন তার কিছুই আমরা জানি না। সিলেটের আযাদ দ্বীনী এদারা বোর্ডের চেয়ারম্যান আল্লামা জিয়াউদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ‘গঠনতন্ত্র প্রণয়নে তাদের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। বৈঠকের উপস্থাপনের আগে তারা বিষয়টি জানতেনও না। তিনি নিজে এখনো গঠনতন্ত্র দেখেন নি।’
আওয়ার ইসলামের কাছে অনুরূপ মন্তব্য করেছেন, বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙ্গা বোর্ডের মহাসচিব মাওলানা শামসুলক, তানযিমুল মাদারিসিল কওমিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাওলানা আরশাদ রাহমানী ও জাতীয় দ্বীনী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বাংলাদেশের মহাসচিব মুফতী মোহাম্মদ আলী।
আওয়ার ইসলাম জানতে পেরেছে, বেফাকের সহ-সভাপতি মুফতী মোহাম্মদ ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি এ গঠনতন্ত্র তৈরি করেছে। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন, মুফতী নুরুল আমীন, মাওলানা ইসমাইল বরিশালী, মাওলানা অসিউর রহমান।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মুফতী মোহাম্মদ ওয়াক্কাস বলেন, ‘সবার সঙ্গে পরামর্শ করে আমরা গঠনতন্ত্র তৈরি করেছি। বৈঠকে গঠনতন্ত্রের উপর বৈঠকে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। সবার সম্মতিতে তা পাশ হয়েছে।’
বৈঠকে উপস্থিত সদস্যরা মৌলিকভাবে গঠনতন্ত্র অনুমোদন করলেও কিছু বিষয় অমিমাংসিত রয়েছে এবং তা পরে আলোচনার কথা রয়েছে বলে দাবি করেছেন বৈঠকে অংশগ্রহণকারী জাতীয় দ্বীনী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশের মহাসচিব মুফতী মোহাম্মদ আলী।
৯ সদস্যের কমিটি কেনো?
কওমি শিক্ষা কারিকুলাম ও আইনি কাঠামো তৈরির জন্য সরকার ৯ সদস্য বিশিষ্ট উচ্চতর কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটিতে রয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বা ইউজিসি থেকে প্রফেসর আবদুল মান্নান (চেয়ারম্যান), প্রফেসর ড. মো. ইউসুফ আলী মোল্লা, প্রফেসর ড. দিল আফরোজ বেগম, প্রফেসর ড. মো. আখতার হোসাইন, প্রফেসর ড. মো. শাহ নেওয়াজ।
ইউজিসির বাইরে থেকে কমিটিতে রয়েছে, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ শফিকুর রহমান।
সরকার স্বীকৃতি ‘সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটি’ অন্যতম সদস্য ও সম্মিলিত কওমি শিক্ষাবোর্ড আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়্যা-তে জাতীয় দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড-এর প্রতিনিধি মাওলানা ইয়াহয়া মাহমুদ মনে করেন ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন নেই। এ প্রক্রিয়াটিই অগ্রহণযোগ্য। ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে কারিকুলাম ও আইনি কাঠামো তৈরি করার জন্য। অথচ প্রধানমন্ত্রী বলেছিনে, কারিকুলাম তৈরি করবে আলেমরাই।
তবে ‘সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটি’র অপর সদস্য মুফতী মোহাম্মদ ওয়াক্কাস মনে করেন এতে ভুল বোঝার কিছু নেই। কোনো কিছুকে সরকারিভাবে আইনি ভিত্তি দিতে হলে রাষ্ট্রীয় যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, এটি তারই অংশ।
তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন এবং যে আশ্বাস দিয়েছেন, তাতে আমরা আস্থা রাখতে চাই। তিনি দেওবন্দের মূলনীতিকে ভিত্তি এবং আল্লামা আহমদ শফীকে মুরব্বি হিসেবে মেনে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং আমাদের সংশয় থাকার উচিৎ নয়।’
‘সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটি’র কো-চেয়ারম্যান আল্লামা আশরাফ আলীর নিকট ৯ সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটি কাজ ও ক্ষমতার পরিধি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ কমিটির সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। কওমি মাদরাসার শিক্ষা সনদের মান বিষয়ক প্রজ্ঞাপন-সরকারি নির্দেশনা এখন তাদের হাতে পৌঁছেছে। আমরাও আমাদের (খসড়া) গঠনতন্ত্র ও কারিকুলাম তাদের হাতে দিয়েছি। তারা সবকিছু পর্যালোচনা করে তা সরকারের নিকট উপস্থাপন করবে। আল্লাহ দয়া করলে তারপর তা আইনে পরিণত হবে।’
৯ সদস্যের কমিটিতে আলেম না থাকাও ও মানুষের ভয়ের কথা উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘তারা তাদের মনমতো কোনো পরিবর্তন আনবেন না। আলোচনা ব্যতীত কোনো হস্তক্ষেপ আমরা মানবোও না। উভয়পক্ষের আলোচনার পর কারিকুলমা ও আইনি কাঠামো চূড়ান্ত হবে।’
সরকারের কাছ থেকে স্থায়ী জমি : সরকারের প্রভাব পড়বে, পড়বে না
প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন হাইআতুল উলয়ার জন্য কেরানীগঞ্জে ৩ একর জমি প্রস্তাব করেছেন। হাইআতুল উলয়ার গত ২ তারিখের বৈঠকে জমির আলোচনা ওঠে এবং মূল্যের বিনিময়ে তা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।
এ জমি গ্রহণকে অনেকেই দেওবন্দের অষ্ট মূলনীতির পরিপন্থী মনে করছে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘সরকার ও সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গের অংশগ্রহণ অত্যাধিক ক্ষতিকর মনে হয়’। তারা মনে করছেন, এতে হাইআতুল উলয়ার উপর সরকারের প্রভাব বাড়বে। আওয়ার ইসলামের সঙ্গে আলাপকালে এমনই মতপ্রকাশ করেন ‘সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটি’র অন্যতম সদস্য মুফতী মোহাম্মদ আলী।
‘সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটি’র কো-চেয়ারম্যান আল্লামা আশরাফ আলীর নিকট বিষয়টি উপস্থাপন করলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি বিবেচনাধীন। জায়গার পজিশন, পরিমাণ ও অর্থের পরিমাণ সবকিছু বিবেচনা করেই তা গ্রহণ করা হবে। তবে আমরা সম্পূর্ণ অনুদান হিসেবে নিবো না। অবশ্যই মূল্য পরিশোধ করবো।’
মুফতী মুফতী মোহাম্মদ ওয়াক্কাস মনে করেন, সরকারের কাছ স্থায়ী জমিগ্রহণে কোনো সমস্যা নেই। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বহু মাদরাসা ও মসজিদ সরকারি জমি গ্রহণ করেছে। সরকারি নিয়ম মেনে আমরা জমি গ্রহণ করবো। প্রতিষ্ঠান বেসরকারি। সরকার জমির মালিকানা প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিচ্ছে। সুতরাং সরকারের প্রভাব পড়ার প্রশ্ন আসে না।’
সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী : চেষ্টা করছি, প্রয়োজন নেই
সম্মিলিত কওমি শিক্ষা বোর্ড আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীনে অনুষ্ঠিত দারুল হাদিসের প্রথম পাবলিক পরীক্ষার সনদপত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে উপস্থিত করার চেষ্টা হচ্ছে।
বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস আওয়ার ইসলামকে এ তথ্য প্রদান করেন। কিন্তু আজ বিষয়টি উপস্থাপন করা হলে, মুফতী মোহাম্মদ ওয়াক্কাস বলেন, ‘আমি বিষয়টি প্রয়োজন বলে মনে করি না। এতোটা সরকারঘেঁষা হওয়া ঠিক হবে না। যদিও আমরা স্বীকৃতির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।’
আল্লামা আশরাফ আলীও এ মুহূর্তে বিষয়টিকে বড় করে দেখতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের লক্ষ্য সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তা আইন হিসেবে সংসদে পেশ করতে পারা। অন্য কোনো বড় আয়োজনের দিকে মনোযোগ দেয়া ঠিক হবে না।’
#আওয়ারইসলামেরসৌজন্যে