খন্দকার হাসান মাহমুদ ::
বেসরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠান স্বৈরাচারের আখড়া। সাধারণ মানুষ তথা জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিতরা স্বৈরাচারী আচরণ করলেও মেনে নেয়া যায়। কেননা তারা দীনি শিক্ষায় শিক্ষিত না। তাছাড়া এটা তার ব্যক্তিগত সম্পদ কিন্তু জনগণের প্রতিষ্ঠানে এরকম আচরণ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। যারা কওমি মাদরাসার সাথে জড়িত আছেন তারা আমার সাথে একমত হবেন আশাকরি।
কিছুদিন আগে যখন এ ব্যাপারে পোস্ট করেছিলাম তখন অনেকেরই গায়ে লেগেছিল।লাগার কথা। কওমি মাদরাসায় নিয়োগ পদোন্নতি ও বিদায় নির্ভর করে সম্পূর্ণ মুহতামিম হুজুরের সন্তুষ্টির ওপর। বড়হুজুর খুশি তো আপনার উন্নতি অগ্রগতির পথে অন্তরায় নাই। আর বড়হুজুর অসন্তুষ্ট হলে আপনার জীবন বরবাদ হয়ে গেছে। আপনি কিছুতেই এগুতে পারবেন না।
আমি নিজের অভিজ্ঞতাই শেয়ার করি। এক মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে। এখানে বর্তমানে এমন শিক্ষকও আছেন যিনি বোর্ড পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছেন। শীর্ষ ফলাফল অর্থাৎ মুমতাজ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এমন শিক্ষক থাকার পরও একজন নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে উপরে উঠানো হবে। অথচ যাকে নতুন করে আনা হবে তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ ছাত্র। চিন্তা করে দেখুন মুমতাজ প্রাপ্ত শিক্ষককে নিচে রেখে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ ও নতুন শিক্ষককে উপরের দিকে পড়ানোর জন্য আনা হয়।
ভালো শিক্ষককে পড়ানোর সুযোগ দিলে ছাত্রদের উপকার হবে বেশি। কিন্তু তারা হিংসা করে কাউকে নিচে রেখে অন্য অযোগ্য অথবা তুলনামূলক কম যোগ্যকে উপরে দেয়। তাদের কাছে প্রতিষ্ঠান বড় বিষয় নয়, বড় বিষয় হলো কে তার আপনজন আর কে পর। আমাদের কওমি মাদরাসাগুলোতে এই ব্যাধি মহামারির আকার ধারণ করেছে। এটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কীভাবে বের হয়ে আসা যায় এবং পড়াশোনার মান বাড়ানো যায় এ নিয়ে আমার কিছু এলোমেলো চিন্তা শেয়ার করলাম। আপনাদের কাছে আরো উন্নত পরামর্শ থাকলে সেটা শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
১. শিক্ষক নিয়োগ
শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের স্বর্গ রাজ্যে পরিণত হয়েছে আমাদের মাদরাসাগুলো। এখানে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। বিশেষ করে মুহতামিম পরিবারের সদস্যদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার পর বাইরে থেকে নিয়োগ দেয়া হয়।
এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ করা আবশ্যক। মাদরাসা কমিটির সভাপতি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবেন। আগ্রহীরা আবেদন করবেন। খুব বেশি আবেদন জমা হলে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে এরপর মৌখিক পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। আর কম হলে সরাসরি মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ দেয়া হবে। পরীক্ষা কমিটিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান, তার মনোনীত এক বা একাধিক শিক্ষক, পরিচালনা কমিটির সভাপতি- সেক্রেটারি ও শিক্ষাবোর্ডের প্রতিনিধি থাকবেন।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারির সময়ই কোন মানের শিক্ষক প্রয়োজন তা উল্লেখ করা প্রয়োজন যাতে প্রত্যেকে জেনে শুনে যোগ দিতে পারেন। এবং পরে পদোন্নতি নিয়ে ফেতনা সৃষ্টি না হয়। অতঃপর যদি কখনো পদোন্নতি দেয়া হয় তখন সিনিয়র দেখে পদোন্নতি দেয়া হবে।
২. পদোন্নতি
সকল মানুষ উপরে উঠতে চায় কিন্তু সবাইকে দেওয়া যায় না। সবার যোগ্যতাও সমান হয় না। পদোন্নতির ক্ষেত্রে আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহেও এত দুর্নীতি হয় না যত দুর্নীতি হয় নীতি ও আদর্শের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত কওমি মাদরাসাসমূহে। এই দুর্নীতি বাদ দিতে হবে।
পদোন্নতির ক্ষেত্রে চামচা ও আপনজন বিবেচনা মারাত্মক ভুল। শুধু ভুল নয় এটা দুর্নীতি, এটা হারাম। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন তোমরা মানুষকে তার অবস্থান বুঝে মর্যাদা করো। যে প্রতিষ্ঠানে সারাদিন কোরআন- হাদিসের তালিম দেওয়া হয় সেখানে কোরআন- হাদিস কেন অবহেলিত? যে হাদিসের কিতাবে যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মান দিতে বলা হয়েছে সেই হাদিস পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় হাদিসের বিপরীতধর্মী ব্যক্তিকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ম আছে যত বেশি যোগ্যতার অধিকারী হোক না কেন প্রথমে তাকে লেকচারার হিসাবেই যোগ দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে একের পর এক ধাপ অতিক্রম করে অধ্যাপক হন। আর আমাদের মাদরাসায়! সেটা বলে বুঝানো লাগে না। মুহতামিম হুজুরের সন্তান হলে প্রথমেই মুহাদ্দিস হয়ে যায়।
কাকে কোন পদে রাখতে হবে, কার কতটুকু যোগ্যতা তা বুঝার জন্যও একটা যোগ্যতা লাগে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের বেশিরভাগ মাদরাসার মুহতামিম ইলমের বিবেচনায় একেবারে শূন্যের কোঠায়। তবুও সমস্যা নাই। মুহতামিম বড় আলেম না হলেও চলে। অন্তত শিক্ষাসচিব যদি যোগ্য হয়ে থাকেন। কিন্তু যখন উভয়েই অযোগ্য হয়ে থাকেন এবং চামচাদের কথায় চলেন তখন উন্নতির আশা করা যায় না। কিছু মাদরাসায় এই সমস্যা আছে।
এক মাদরাসায় মুহতামিম হুজুরের ছেলেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ক্লাস দেওয়ায় ছাত্ররা চলে গেছে। তবুও মুহতামিম হুজুরের টনক নড়ে নি। মাদরাসা ধ্বংস হলে কী হবে, তার সন্তানের মর্যাদা রক্ষায় যত কিছু করার তিনি করবেন। এটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। মাদরাসায় ক্লাস দু-একটা না থাকলে সমস্যা নাই। কমিটি না থাকলে এমনটাই হয়। এবারও এক মাদরাসার সর্বোচ্চ দুই দুইটা ক্লাস খালি। সমস্যা নাই, ক্লাস খালি হলেও পদ তো খালি হয় নি। হুজুর তার পদ মোবারকে বহাল তবিয়তে আছেন।
৩. বিদায়
বিদায় সম্পর্কে কী আর বলবো! তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বছরের পর বছর ধরে সেবা দেওয়া শিক্ষককে বিদায় করে দেয়া হয়। মুহতামিম হুজুরের সন্তুষ্টির জন্য সবকিছু করতে হবে। তিনি হারাম কাজ করলেও তাকে সমর্থন করে যেতে হবে।
এক মাদরাসার খবর শুনলাম। সেই মাদরাসায় একজন জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। ছাত্রদের জন্য প্রচুর মেহনত করতেন। স্বাভাবিক কারণেই ছাত্ররা সেই শিক্ষকের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিল। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে মাদ্রাসার পড়াশোনার মান উন্নয়ন হয়েছিল।
ঘটনা হলো, শিক্ষক মহোদয় রমজানের ছুটিতে বাড়িতে গেলেন। হঠাৎ মুহতামিম হুজুরের ফোন আসলো। হুজুর জানালেন আপনি আর আসার দরকার নাই। অন্যকোথাও দেখে নিন। একজন মানুষ এতো কষ্ট করে এই প্রতিদান পেলে পরে কি আর কোনদিন মেহনত করতে মন চায়?
কী কারণে হঠাৎ তাকে অব্যাহতি দেওয়া হলো? বাহ্যত কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষপর্যন্ত কারণ খুঁজে পাওয়া গেল। বছরের মধ্যখানে একদিন মিটিং-এ এই হুজুর মুহতামিম হুজুরের কথার ওপর কথা বলেছিলেন। এটা এতই তুচ্ছ ও সামান্য ছিল যে দুদিন পর কেউ মনেই রাখেনি। কিন্তু বড়হুজুর মনে রেখেছেন। তার স্মরণশক্তি সাংঘাতিক। হুজুরের মাথায় ১৬ র্যাম ও ২৫৬ টেরাবাইট মেমরি। সাথে তাকাব্বুর প্রোডাকশনের হাই পাওয়ারের প্রসেসর।
একজন শিক্ষক বিদায় হলে নতুন জায়গায় স্থান করে নিতে কত কষ্ট হয় তা ভূক্তভোগিরাই কেবল জানে। চাকরি হয়তো পাওয়া যায় কিন্তু চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে কষ্ট হয়। সুতরাং কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এক্ষেত্রে একাধিক সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করতে হবে। কমিটিতে শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি থাকবেন।
এখানে একটা কথা বলতে হয়। শিক্ষকদের বিদায় করা হয় না। তারাই বরং বিদায় নেন। অফিসিয়াল ফর্মালিটিজ অনুসারে দরখাস্তে লেখা থাকে ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে বিদায় নিচ্ছেন। এটা যে একটা মিথ্যা তা সকলেই জানে। কারণ এটা না বলে যদি বলে কর্তৃপক্ষের আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে বিদায় নিচ্ছি তখন বিশাল সমস্যা আছে। এমতাবস্থায় তাকে বরখাস্ত করা হতে পারে। তাই সম্মান রক্ষার জন্য এভাবে বলা হয়।
নতুবা সবদিক থেকে এমন অপমানজনক ব্যবহার করা হয় যেন তিনি নিজে থেকেই চলে যেতে বাধ্য হন। কমিটি যদি কিছু বলেও তখন একটা জবাব দেওয়ার পথ থাকে। কিন্তু মুহতামিম যদি একক ক্ষমতার মালিক না হয়ে ক্ষমতা বন্টিত থাকে তাহলে কারো ওপর জুলুম করা সম্ভব হবেনা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের বেশিরভাগ মাদরাসায় মুহতামিম হুজুর শতভাগ ক্ষমতার মালিক। তার এই ক্ষুদ্ররাজ্যে তিনি স্বেচ্ছাচারী সম্রাট।