শামসীর হারুনুর রশীদ::
তাঁরা পশুর মতো দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে, দাঁড়িয়ে হাঠিয়ে খায়, যখন ইচ্ছে-যেভাবে ইচ্ছে ঘুমায়, মন যখন যেটা চায় তা করে, ভাদ্রমাসেরে কুকুর কিংবা মৌসুমি জীব-জন্তুর পালের মতো দলবদ্ধ হয়ে কখনও এক মেয়ের, কখনও একাধিক মেয়ের পেছনে ঘোরাঘুরি করে, যেন একটা জঙ্গল, জঙ্গলি প্রাণীরা যখন যার সাথে যা ইচ্ছা, যেমন করে ইচ্ছা, খাহেশ পূর্ণ করেই যাচ্ছে, কোন বাধা বিপত্তি নেই? যেন আস্ত একটা হায়ওয়ানি জগত বা পশুত্বের রাজধানী?
দেখলাম ইবলিশকে ওখান থেকে দৌড়ে পালাচ্ছিল! জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপার কি এভাবে পালাচ্ছ কেন? বলছিল এটাকে আমি ভয় করি! এখান থেকে আমার কষ্টের তৈরি নেতা-কর্মীরা আমার মিশনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ঘোষণা করে, ভেতরে একটু ঘুরে আসেন, এমনিতেই বুঝবেন? বলছিলাম মুসলিম বাচ্চাদের উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য প্রতিষ্ঠিত, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা’। গত 2012 সালের 20 রামজান, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর জানাযা থেকে ফেরারি পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সময় অবস্থানের কথা । খুব ইচ্ছে ছিল কিছু ঘোরাঘুরি করে দেখব, রোজা নষ্টের ভয়ে তড়িঘড়ি করে এ বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করি!
তারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে শিক্ষিত হয় কিন্তু মানুষ হতে পারেনা! শিক্ষিতরা যখন মানুষ হতে পারেনা, তখন এমন হিংস্র ও ভয়ঙ্কর হয় যে, মানুষের কাজগুলো আর পছন্দ হয়না! জ্ঞানের ভারে নিজের অজান্তে ভূত-ফেরত-ইবলিশের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে! তারা মনস্তাত্ত্বিক মিল খুঁজতে খুঁজতে এক পর্যায়ে নিজেকে শয়তানের উস্তাদ বানিয়ে ফেলে! শয়তান হা হা হে হে করে বলে এখন তুমি যুক্তিবাদী-মুক্তবুদ্ধিওয়ালা শিক্ষিত হয়েছ! তোমাকেই তো খুঁজছি, তোমার ধারা অনেক কাজ হবে!!
চিন্তা করনা তোমাদের মতো জ্ঞানীদের খুঁজছে দাজ্জালের পৃথিবী । তোমরা তো মানুষ না, তোমরা এখন শিক্ষিত পণ্ডিত! তোমাদের আবিষ্কার করতেই হাজার হাজার বছর ধরে মেহনত! মানুষের বিরুদ্ধে তোমাদের একটা অবস্থান তোমাদের গুরুরা আবিষ্কার করেছে, নাম দিয়েছে ‘সেক্যুলারিজম’। রূপ বদলাও নাম বাংলাদেশে ধর্মনিরপক্ষেতাবাধ। তাড়াতাড়ি ওদের সাথে মিলাও হাত, তোমরা তো শিক্ষিতের যাত! ধর্ম-ইবাদত-উপাসনা তো মানুষ করে, এদের আক্কেল-বুদ্ধি আর কতটুকু? তাঁরা তো চিন্তা-চেতনা-মননে-ক্ষমতায়নে-আধুনিকতা ও পরিধি সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে? এদের ধমিয়ে রাখতে আমার সবটুকু শক্তি তোমাদের পিছনে আছে ।
এই দেখ কোরআন-হাদীসে বর্ণিত প্রচার মাধ্যম মিডিয়া তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছি! তাদের বদলে এটা এখন তোমাদের হাতিয়ার! তাদের মনস্তাত্ত্বিকতায় শুধু ব্যক্তি কেন্দ্রীক এবাদতকে আসল বানিয়ে দিয়েছি! তারা নিজে কিছু নামাজ-রোজা-জিকির-আজকারকেই ইসলামকে সীমিত করার সফল মিশনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে! তাঁরা ফিতনা বলে বাহিরে আর উকি দেয়ার চিন্তা করবে না!
তারা তোমাদের বাজারে পরিণত হবে এবং একপর্যায়ে তারা মানুষ থেকে বের হয়ে যাবে! তারা ইসলাম ধর্মকে এমন সীমিত করবে যে জনগণ বলবে যাদের খাইয়া কোন কাজ নাই, পরনির্ভরশীল, তারাই ইসলাম ইসলাম বলছে, এখন দেখি ইসলাম ধর্ম এতো এক বোঝা?
কিয়ের ইসলাম! সাম্প্রদায়িক মতবাদ! বাদ দেউ এটা?
শুন হে শিষ্যরা! ওরদের মাঝে ইখতেলাফ আর নির্দিষ্ট একটা গণ্ডি তৈরি করে দিয়েছি, তারা ওখান থেকে বের হতে পারবেনা!
ওদের মাকুলাত-মাসরুবাত-মালবুসাত-মাসনুআত হারাম মিশ্রয়ে তোমরা বানিয়ে দিবে, তাঁরা তোমাদের তৈরি খেয়ে অন্তসার শুন্য ইবাদত আর লম্বা লম্বা ওয়াজ-ফতোয়ায় ব্যস্ত থাকবে! এটাকে বলবে মহা সফলতা কি কোন টেনশনের কারণ আছে?
ওরা মাদরাসায় লেখাপড়া করে মানুষ হয় এবং যতটুকু পারে জ্ঞানী হয় ! এরা আর কখনও তোমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার চিন্তা করবে না! কারণ এখানে মানুষের পরিবেশ নেই! আর প্রতিদিন নতুন নতুন শিরক বেদাত আবিষ্কার কর আমি দেব পুরস্কার, তাঁরা তিরস্কার করে 500হাত দূরে থাকবে, তোমরা সম্পূর্ণ নিরাপধ নয় কী? যে মতাদর্শিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা করেছিল গিরগিটের মতো রূপ বদলিয়ে তারা এখন নেতৃত্বে! আর যাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছিল পরিবেশ বিপর্যয়ে তাঁরা আজ বাউরি বা অন্য কিছু?
ইতিহাসে ঢাবি:
১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারী ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় এলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে মুসলিম শিক্ষাবিদদের একটি প্রতিনিধি দল পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের জন্য এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী জানান। লর্ড হার্ডিঞ্জ এ দাবীর যৌক্তিকতা অনুভব করে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ১৯১২ সালের ২৭মে বেঙ্গল গভর্নমেন্ট ব্যারিষ্টার রবার্ট নাথানকে সভাপতি করে ১৩ সদস্যের কমিটি গঠন করে। এই কমিটির উল্লেখযোগ্য সুপারিশ ছিল: (এক) বিশ্ববিদ্যালয়টি হবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ও সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃক পরিচালিত। (দুই) এটি হবে আবাসিক ও শিক্ষাদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়। (তিন) ইসলামি শিক্ষা ও গবেষণা – এর শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত হবে। সে সময় পূর্ব বঙ্গে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। পূর্ব বঙ্গ মুসলমান অধ্যূষিত বলে পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের জন্য উচ্চ শিক্ষার দরোজা খুলে যাওয়ার সুযোগ ঘটে।
অতপর ১৯২১ সালের ১লা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৩টি অনুষদ ( কলা, বিজ্ঞান, আইন); ১২টি বিভাগ (সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, শিক্ষা, ইতিহাস, আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ, ফার্সী ও উর্দু, দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতি, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, এবং আইন); ৩টি ছাত্রাবাস (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা হল এবং জগন্নাথ হল) নিয়ে তার যাত্রা শুরু করে। (বিস্তারিত পরবর্তীতে)
এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন হিন্দুসম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ । রাষ্ট্রভাষা বাংলার মতো রবীন্দ্রনাথও বিরোধিতা করেছিলেন!
পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা মনে করেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ কমে যাবে। সুতরাং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চলবে কীভাবে? এই ভয়েই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।
হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন সে সময়ে। ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ তার ঢাকা সফর শেষে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করলে ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতামূলক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কী মূল্যে অর্থাৎ কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন? শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে তার বিরোধিতার অবসান করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন পর্যায়ের বিশিষ্ট মুসলিম শিক্ষাবিদরা নানাপ্রকার প্রতিকুলতা অতিক্রম করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাব নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। কিন্তু, হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহের মৃত্যু ঘটলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ ধরনের সংবাদ সম্প্রতি সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে। এমন অভিযোগকারীদের মধ্যে আছেন ঢাকা থেকে প্রকাশিত কয়েকটি ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক। কিছু কিছু কলামলেখকও নানা সময়ে সংবাদপত্রে এ ধরনের তথ্য প্রকাশ করছেন। ২০০০ সনে আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’ নামে একটি বইয়ে মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন, বীরপ্রতীক, পিএসসি (তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) একটি তথ্য জানান যে, ”১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়।” তিনি অভিযোগ করেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে এই ধরনের একটি অভিযোগের উল্লেখ পাওয়া যায়।
মেজর জেনারেল (অবঃ) আব্দুল মতিন এই গ্রন্থ থেকেই তথ্যটি ব্যবহার করেছেন। বিশিষ্ট কলামিষ্ট এরশাদ মজুমদার বলেন, ‘১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিস্ঠার বিরুদ্ধে হিন্দুরা প্রতিবাদ সভা ডাকে। প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। কারণ তিনি ছিলেন জমিদার। তিনি মুসলমান প্রজাদের মনে করতেন লাইভ স্টক বা গৃহপালিত পশু’( শ্রী নীরদ চৌধুরী, দি অটোবায়োগ্রাফী অব এ্যান আননোন ইন্ডিয়ান)।
09/ 05/ 2017