হুমায়ুন আইয়ুব :
তথ্যের অভাব বা অজানা থেকেই সাধারণত বিভ্রান্তি ছড়ায়। সাম্প্রতিক সময়ে কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ ক্লাস দাওরায়ে হাদিসকে (ইসলামিক স্টাডিজ ও এরাবিক) স্নাতক মান দিয়েছে সরকার। বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বলা, মতামত প্রকাশ এবং বিচার-বিশ্লেষণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে যারা বলছেন এ সম্পর্কে তাদের বস্তুনিষ্ঠ জানাশোনা থাকা জরুরি। শুধু কানকথা বা গালগল্পে পাওয়া বিষয় নিয়ে কল্পনার ডানা উড়িয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আরোপিত মতামত কিংবা অজানা মতামত সমাজকে বিভ্রান্ত করে। স্বাভাবিক কাজের অগ্রযাত্রায় ব্যত্যয় ঘটে। বিপরীতে আরও একটি ব্যর্থতার দায় নিতে হবে-কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টদের। যারা দুই বা আড়াই শত বছরের এই প্রাচীন শিক্ষাধারাকে মানুষের বুঝের উপযুক্ত করে তুলতে পারেননি এ জন্য। হালে অনেক প্রাজ্ঞ সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী কিংবা মিডিয়াকর্মী যখনই বলতে-লিখতে বসেন তখন এক শ্বাসে অন্তত ১০টি প্রশ্ন করেন। প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয় কওমি মাদরাসা বেচারা! হয়তো একটির উত্তরও তারা জানেন না। কিংবা জেনেও ভনিতা করছেন।
এই না জানার দায় যেমন সাংবাদিক ও টেবিলবাজরা এড়াতে পারেন না; তেমনি কওমি মাদরাসা সংশ্লিষ্টরাও। যেমন ধরুন-কওমি মাদরাসায় কারা পড়ে? তাদের সংখ্যা কত? কওমিতে যারা পড়াচ্ছেন তাদের যোগ্যতা কী? কওমিদের কী পড়ানো হচ্ছে? কওমি মাদরাসার আঙিনায় কখনো যাদের পা রাখার সুযোগ হয়নি; অনুরোধ করব স্বতঃস্ফূর্ত কোনো এক বা একাধিক মাদ্রাসায় ভিজিট করে আসুন। কারা পড়ে কওমি মাদরাসায়? তারা পাকিস্তান না আফগানিস্তানের নাগরিক! তাও দেখে আসুন।
নাকি কওমি মাদরাসার সন্তানদের হৃদয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার-ছবি আঁকা তাও দেখুন। কওমি মাদরাসার প্রতিটি সন্তানই এ দেশের। তাদের হৃদয়জুড়ে দেশপ্রেম, স্বাধীনতাবোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মা-মাটির ভালোবাসার মুগ্ধতা ছড়ানো। কওমির সন্তানরা সমাজের কারও ভাই, কারও বোন কিংবা আত্মীয়-প্রতিবেশী। তিন সন্তানের মধ্যে বাবার দুই ছেলে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও; বাবা-মা একজনকে ধর্মীয় শিক্ষায় উচ্চতর আলেম বানিয়েছেন, পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম-পাড়ামহল্লায় এক বা একাধিক কওমি মাদরাসাপড়ুয়া আলেম-হাফেজ আছেন। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, বাংলাদেশের একটি গ্রামও এমন পাওয়া যাবে না; যে গ্রাম-মহল্লায় কওমিপড়ুয়া কোনো আলেম-হাফেজ নেই? নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের পূর্ব সাধকরা পেটে পাথর বেঁধে এই শিক্ষাধারাকে স্বগৌরবে অব্যাহত রেখেছেন। অক্ষুণ্ন রেখেছেন। দেশের সাড়ে পাঁচ লাখ মসজিদে যারা আজান দেন, নামাজ পড়ান কিংবা জুমার খুতবা দেন তারাও এই কওমি মাদরাসায় পড়েছেন। বছরে দেশে লক্ষাধিক ওয়াজ, তাফসির ও আলোচনা সভা হয় সেখানকার সুবক্তাও এই কওমির আলেমরা। আমার-আপনার মৃত্যুর সংবাদটি যিনি মসজিদের মাইকে ঘোষণা করবেন, খাটিয়া সামনে নিয়ে জানাজা পড়াবেন তিনিও এই কওমি মাদরাসায় পড়ুয়া (যুগ যুগ চলমান রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করে বললাম)।
তারপরও কী চোখ বড় করে প্রশ্ন করা হবে-কারা পড়ে কওমি মাদরাসায়? তারা তো আমাদের সন্তান। এই বাংলা মায়ের আদর পরশেই তাদের বেড়ে ওঠা। সবুজ আঙিনার ধুলাবালিতেই তাদের স্বপ্ন আঁকা। কওমি মাদরাসার ছাত্র সংখ্যা ১৪ লাখেরও বেশি। সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন, বিশ কিংবা বাইশ হাজার ছোট-বড় মাদরাসা এদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ভিতরেই আছে। কারা পড়াচ্ছেন তাদের কী যোগ্যতা আছে? কিংবা কী পড়ানো হয়! সোজাসাপটা যদি বলি, দাঁতের ডাক্তারের কাছে হার্টের চিকিৎসা নিশ্চয় অজানা বিষয়। তাই বলে, তিনি তো হার্টের ডাক্তারের বিরোধিতা বা বিষোদগার করতে পারেন না। কওমি মাদরাসায় যারা পড়াচ্ছেন; তাদের যোগ্যতা যাচাই-বাছাই করার জন্যও যে যোগ্যতার প্রয়োজন, তাও কী আমরা সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরা অর্জন করেছি। আমাদের যেসব সন্তান দীর্ঘ ১৮-২০ বছর, সরকারের ব্যবস্থাপনায় উচ্চতর শিক্ষার ডিগ্রি অর্জন করছেন! কিংবা বাবা-মা জমি জিরাত বিক্রি করে আইনবিদ-ডাক্তার কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বানাচ্ছেন; তারা যখন শুদ্ধ করে কালেমা শরিফ বলতে পারেন না কিংবা বাবা-মায়ের জানাজা পড়ানোর জন্য দাঁড়াতে জানেন না! তখন কি কওমি মাদরাসার কোনো প্রতিনিধি প্রশ্ন করেছেন, কী পড়ানো হয় আমাদের স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে! বাবার জানাজা পড়াতে জানেন না? আমার মেডিকেল পড়ুয়া ছোটবোন আইনি সমস্যা হলে; আমরা কি ওকে বলব-কী পড়েছ এত বছর? নিজের মামলাটা নিয়ে আদালতেই দাঁড়াতে পারবে না? আদালতে দাঁড়াবেন আইনজীবী! রোগীর পাশে থাকবেন ডাক্তার, স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ মুখরিত করবেন রাজনীতিবিদ, খবরের পেছনে ছুটবেন সাংবাদিক, ঘরবাড়ির প্ল্যান করবেন ইঞ্জিনিয়ার। শিল্পী ছবি আঁকবেন। মাদরাসা পড়ুয়ারা মসজিদ মিম্বার ও মানুষের মন আলোকিত করবেন।
ইমাম-খতিব শিক্ষক হবেন। আলেম–মুফতিরা সমাজের মানুষের ধর্মীয় যত সব প্রয়োজন আছে; তাদের পাশে আছেন ও থাকবেন। আলেমকে যেমন ডাক্তারি কেন পড়নি প্রশ্ন করা যাবে না; তেমনি ডাক্তারকে আইন না পড়ার কারণে খাটো করা যাবে না। কারণ হলো, কাজ ও প্রয়োজনের ভিন্নতা। আমাদের দেশের অগ্রযাত্রার জন্য যেমন রাজনীতিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অ্যাডভোকেট কিংবা শিল্পী, সাংবাদিক প্রয়োজন; তেমনি মানুষের যাপিত জীবনের প্রয়োজনেই আলেম, ইসলামিক স্কলার বা ধর্মীয় পণ্ডিত প্রয়োজন। মধ্যপ্রাচ্য আজকে বাংলাদেশ থেকে ধার করে হাফেজ নিয়ে রমজানের তারাবি পড়ায়! শত শত দেশের কোরআন প্রতিযোগিতা- বিজয়ের হাসি হাসে লাল-সবুজের পতাকাধারী বাংলাদেশের হাফেজ।
বাংলাদেশের মানুষ কী শত বছরের চলমান ধর্মীয় ঐতিহ্য রক্ষার প্রাণকেন্দ্র মাদরাসা বা আলেম তৈরি না করে; মধ্যপ্রাচ্য থেকে আলেম হাওলাদ করে নিজেদের ধর্মীয় চাহিদা পূরণ করবেন?
সংঘাত নয়; সম্প্রীতির সমাজ! সব ধর্মের মানুষের বসবাস উপযোগী সমাজ এবং মদিনার নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শান্তিময় মানবতাবাদী ধর্মকে মানুষের জীবনে পৌঁছে দিতে হলে দেশের চলমান কওমি শিক্ষাধারাকে অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
আমাদের এই দেশে ছবি আঁকা জানলে চারুকলা থেকে স্নাতকের সার্টিফিকেট দেওয়া হয়, দেওয়া হয় ভাষা জানলেও। ইসলামের প্রায় সব বিষয় যারা জানেন এবং যাপিত জীবনে চর্চা করেন তাদের কেন ইসলামিক স্টাডিজ কিংবা এরাবিকে স্নাতক মান দেওয়া যাবে না?
অবগতির জন্য বলে রাখি, মাদরাসা পড়ুয়া একজন আলেম মোটা দাগের পাঁচটি ভাষা জানেন। আরবি, বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, উর্দু। পরিপক্বতা বা যোগ্যতা বিচারে কারও কমবেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশে আর কোনো শিক্ষাব্যবস্থা আছে- যারা বলতে পারবেন আমাদের প্রতিটি সন্তানই একসঙ্গে মোটা দাগের পাঁচটি ভাষা জানেন?
কওমি মাদরাসার শিক্ষা সিলেবাস নিয়ে বিস্তারিত লেখার আবেদন রাখে। ত্রিশ পারা কোরআন যারা মুখস্থ করেন, তারা হাফেজে কোরআন হয়। এদিকে কওমি মাদরাসায় ১২ বছরের একজন নিয়মিত শিক্ষার্থী-বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ভূগোল, কিতাবুল আদব বা সমাজবিজ্ঞান, আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান, কিতাবুল বুয়ু বা অর্থনীতি, ইসলামী অর্থনীতি, বাজার-ব্যবসা, আরবি সাহিত্য, ফারসি সাহিত্য, উর্দু সাহিত্য, আর্ট-ক্যালোগ্রাফি, সংগীত ইত্যাদি পড়েন। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা সিলেবাসে- মানতেক-ফালসাফা যুক্তিবিদ্যা, কম্পিউটার বা প্রাথমিক প্রযুক্তি, সেলাই বা কারিগরি ইত্যাদিও পড়ানো হয়। ধর্মীয় শিক্ষার হিসাব যদি করি, ত্রিশ পারা কোরআনের অনুবাদ, তাফসির পড়ানো হয়। আরবি থেকে অনুবাদ শেখানোর জন্য-পড়ানো হয় আরবি ব্যাকরণ-নাহু-সরফ, আরবি অলঙ্কার শাস্ত্র-ফাসাহাত-বালাগাত, তাফসিরের মূলনীতি, আরদুল কোরআন বা কোরআনের ভৌগোলিক মানচিত্র ইত্যাদি। সিলেবাসজুড়ে আছে নবীজীবনী, ইসলামের ইতিহাস, ইসলামী আইন বা ফেকাহশাস্ত্র। ওয়াকফ আইন, বিয়ে-তালাক, উত্তরাধিকার সম্পত্তি আইন, হেবা ইত্যাদির গুরুত্ব আছে কওমি মাদরাসার সিলেবাসে।
সবশেষে হাদিসশাস্ত্রের ছয় কিতাবসহ মোট দশটি হাদিসের কিতাব পড়ানো হয়। তালিকায় আছে, দুই খণ্ডের ত্রিশ পারায় সংকলিত বুখারি শরিফ, দুই খণ্ডের মুসলিম শরিফ, দুই খণ্ডের তিরমিজি শরিফ, আবু দাউদ শরিফ, ইবনে মাজাহ, নাসায়ি শরিফ, মুয়াত্তা ইমাম মালেক, মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ, তহাবি শরিফ, শামায়েলে তিরমিজি ইত্যাদি।
বাংলাদেশের কয়জন সাধারণ শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী কিংবা টিভি টকশোর আলোচকরা একসঙ্গে সব কিতাবের আরবি পাণ্ডুলিপি দেখেছেন তা বলা কিন্তু মুশকিল। তবুও বলি না দেখলেও তর্ক করা, মত প্রকাশ সবই করা যাবে- অনুগ্রহ করে বস্তুনিষ্ঠ তর্ক হলে সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্র অগ্রসর হবে। দীর্ঘ বছর পর বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ ক্লাস দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর মান দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন। আগামীর বাংলাদেশ যখন ফুল-ফল ফসলে ভরা মাঠের সুফল ভোগ করবে; তখন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই হবেন- এই সুফলা মাঠের বীজতলা। কোটি কওমি সন্তানের প্রাণভ্রমরা।
সুত্র: দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন।
লেখক: সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম।