খতিব তাজুল ইসলাম :: আমাকে এক বিদগ্ধ দায়িত্বশীল তরুণ আলেমে দ্বীন বললেন যে, ভাই মেহেরবাণী করে কওমি মাদরাসা বোর্ডগুলো নিয়ে কিছু লিখুন। কেন লিখবো ? কী জন্য লিখবো? বললেন, “উনারা আমাদের প্রজন্মকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন! সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সত্তুর-পঁচাত্তর বয়সীগণ শাদা কাপন পরানোর আগে যুবক, তরুণ মেধাবীদের কাজ, চিন্তা, গবেষণাকে এগিয়ে নিতে দিচ্ছেন না।”
আমি এবার লন্ডন ফেরার পথে দেখা করি বেফাকের সম্মানিত মহাসচিব ও যুগ্ম মহাসচিবদ্বয়ের সাথে। প্রায় ২ঘণ্টা ভিডিও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বেফাকের মহাসচিব হযরত আব্দুল জব্বার সাহেব দা.বা.। এডিটিং শেষ হলে অবশ্যই মিডিয়ায় পেশ করা হবে।
তার আগে আমি বলতে চাই, আমি যখন হযরতের কাছে জানতে চাইলাম, বেফাকের অধীনে কোনো শিক্ষা-গবেষণা বিভাগ আছে কিনা? বললেন ‘আমরা এ বিষয়ে ফিকিরমন্দ।’ মানে আপাতত নেই; ভবিষ্যতে দেখা যাবে। লন্ডন ফেরার একমাস পর আবার ফোনে কথা বললাম। সালাম বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করলাম, হযরত! কমাশিসা বইটি কি পড়া হয়েছে? বললেন, না ! সময় পাইনি; খুব ব্যস্ততায় কাটছে। আচ্ছা, ঐ যে গবেষণা বা রিসার্চ বিভাগ নিয়ে ভেবেছেন কি? ‘হু… দেখি কি করা যায়!’ বললাম, প্রয়োজনে আমরা ফাইন্যান্স করবো তবুও এরকম একটি বিভাগ চালু করুন। তরুণ-মেধাবী আলেমেদ্বীনদের কাজ ও গবেষণা করার সুযোগ দিন। বললেন, ‘শুকরিয়া।’
বেফাক অফিসের অভ্যন্তরীণ নোংরা পরিবেশ কিংবা অযত্নে-অসর্তকতায় রাখা পরীক্ষাপত্রের ফাইলের কথা না-ই বললাম; কিন্তু সাত-আটহাজার মাদরাসার প্রতিনিধিত্বকারী এই বোর্ডের শিক্ষা নিয়ে কোনো গবেষণা বা রিসার্চ বলতে কিছু থাকবে না তা কি করে হয়?
একপর্যায়ে তিনি বলেও ফেলেছেন যে, ‘আমাদের কাজতো শুধু পরীক্ষা নেয়া।’ যখন পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তাহলে বেফাক্বের পক্ষ থেকে সিলেবাস, বই-পুস্তক কেন প্রিন্ট-প্রকাশনা হয়? -থেমে গেলেন।
আমি জানি, ভালো করেই জানি, আমাদের সম্মানিত আকাবির জীবিত বুজুর্গ আসাতেযাগণ কবরে শায়িত হওয়ার আগ পর্যন্ত দারসে মশগুল থাকেন। থাকতেই হয়। নতুবা কে তাঁর চুলায় আগুন জ্বালাবে? পেনশন-টেনশন দূর কী বাত, সাধারণ বেতনটুকুও নেই নিয়মিত। এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে কে কার গদি ছাড়ে? কে তাহলে তার পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে? ধনী আলেম, গায়রে আলেমরা কি এগিয়ে আসবেন?
গহরপুর জামেয়া হুসাইনিয়া মাদরাসার বার্ষিক জলসায় শুনলাম, বেফাকের মহাসচিব হযরত মাওলানা আব্দুল জব্বার সাহেব বয়ান দিচ্ছেন। বলছেন, আমরা মাদরাসায় পড়ি-পড়াই আল্লাহকে রাজি এবং খুশি করার জন্য। অতএব, আমাদের সনদের কোনো প্রয়োজন নেই ! বক্তব্য শোনে যারপরনাই আক্ষেপ জাগলো। এই বেফাক এবং অন্য বোর্ডগুলো তাহলে কি ঘোড়ার ঘাস কাটার জন্য? তারা কি সনদ বিতরণ করেন না? মাদরাসায় মাদরাসায় পরীক্ষার ইন্তেজাম করেন না? এতে কি আল্লাহ রাজি এবং খুশি হন? তাহলে সনদের স্বীকৃতির জন্য এতো দৌড়ঝাঁপ কেন? আচ্ছা, যারা স্কুল-কলেজে পড়ে এবং সরকারিভাবে যাদের সনদের স্বীকৃতি আছে তাদের উপর কি আল্লাহ তাআলা নারাজ হয়ে আছেন? তারা কি সেখানে পড়ে আল্লাহ পাবে না? তখন প্রশ্ন জাগে, যদি তাদের উপর আল্লাহ নারাজ থাকেন তাহলে সেই অভিশপ্ত (?) গোষ্ঠীদের কেন ইংলিশ বিজ্ঞান ও অংকের জন্য মাস্টার হিসেবে মাদরাসায় চাকুরি দেয়া হয়?
এবার বলুন, এই মাদরাসাগুলো কার টাকায় চলে? ইমাম, মুয়াজ্জিন, মুহাদ্দিস, হাফিজ, ওয়াইজ মুহতামিমগণের টাকা কোত্থেকে আসে? স্কুল-কলেজ, ভার্সিটি পড়ুয়া ব্যবসায়ীদের টাকা তখন হালাল হয় কি করে? সেই তথাকথিত অভিশপ্তদের টাকা ছাড়া আপনি চলতে পারবেন? কার গরু-মহিষ ছাগলের চামড়াগুলো কালেকশন করে নিয়ে আসছেন, একবার কি ভেবে দেখেছেন?
বলছিলাম মহাসচিব সাহেবের কথা, সেই তিনি গতবছর হুংকার দিলেন যে, এভাবে কওমি সনদের স্বীকৃতি দিলে লাখ লাখ লাশ পড়বে! আচ্ছা, এবার যখন হযরতের সাথে আমার মোলাকাত হলো, তখন জিজ্ঞেস করলাম, এই যে হাজার হাজার কওমি শিক্ষার্থীরা আজ আত্মপরিচয়হীনতায় ভুগছে। লেখাপড়া করেও সরকারের খাতায় মুর্খ-অশিক্ষিত, এ বিষয়ে আপনাদের ভাবনা কি? বললেন, হ্যাঁ, ‘আমরা চিন্তাভাবনা করছি’। এসব ডিপ্লমেটিক জবাব। জান বাঁচানোর রাস্তা। কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া।
এখন শোনা যাচ্ছে উনারা শংকায় আছেন যে, মাদরাসার ছাত্ররা দলে দলে স্কুল, কলেজ ও আলিয়ামুখী হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে অনেক আলিয়া মাদরাসাই এখন কওমি ছাত্রনির্ভর। কওমির ছাত্রদের রিজাল্ট দিয়েই তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখছে। তাই তাদেরকে হাতে পায়ে ধরে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফিরিয়ে রাখতে হবে। নতুবা মাদরাসাগুলো ছাত্রশূন্য হয়ে যাবে। আমার আফসুস যে, এরপরও হযরত দায়িত্বশীল মহোদয়গণের টনক নড়ছেনা!
আল্লাহর রাসূল সা. এক মাহফিলে মশগুল আছেন। এমতাবস্থায় হযরত জারির ইবনে বজলী নামক তরুণ সাহাবি এসে উপস্থিত হলেন। সারা জাহানের সরদার নিজের চাদর মোবারক বিছিয়ে দিয়ে বললেন, হে জারির ! তুমি এখানে বস। হযরত জারির রা. তখন উত্তরে বললেন ‘আপনাকে আল্লাহ তাআলা আরো সম্মানিত করুন, যেভাবে আপনি আমাকে সম্মানিত করলেন হে রাসুল!’ এভাবে তরুণদের প্রতি ছিলো আল্লাহর রাসূল সা.’র আলাদা মহব্বত ও ভালোবাসা। কারণ তরুণরাই কেবল পারে পুরাতনকে ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়তে।
কিন্তু আমাদের সমাজে তরুণরা
কুনটাসা। পেছনের সারিতে বস। নামাযে মসবুকের সফে দাঁড়াও। ভালো আরবি জানা ছাত্র
-উস্তাদের জায়গা কোনো মাদরাসায় নেই। মেধাবীরা আমাদের বোঝা। ছোটরা ভালো কিছু বললেও উনারা এই বলে উড়িয়ে দেন যে, ‘সব ঠিকই আছে; তবে অমুক হযরত, তমুক বুজুর্গ কিছু বলছেন না যে।’ আপনি নিরেট কুরআন-হাদিসের কথা বলুন, সাহাবা, আসলাফ-আকাবিরের কথা বলুন, কোনো কাজ হবে না; যতক্ষণ না গ্রহণকারি দেখবে যে তার স্বার্থ হাসিল হচ্ছে কি না? এই হলো আমাদের অবস্থা।
আল্লাহ তাআলা আলিমুল গাইব। তিনি ভাল করেই জানতেন আমাদের এই ইফতেরাক্ব ও ইজতেরাবের কথা। তাই কুরাইশ বংশে ৫৭০ সালে আরব উপদ্বীপেই রাসূল সা.কে প্রেরণ করেছেন। যদি খোদা নাখাস্তা আমাদের মতো এই নাকাল পরিস্থিতির মাঝে পাঠাতেন, কী যে পরিণতি দাড়াতো! সম্মিলিত কওমি বোর্ডের মতো সম্মিলিত নবি বোর্ড গঠন করতে হতো উনাদের খুশি করার জন্য!
আজাদ দ্বীনি এদ্বারা বা তানজিমুল মাদারিস, বেফাক যাই হোক, আমরা আপনাদের হুজুরে করজোড়ে অনুরোধ করি, দয়া করে একত্রে বসুন। সময়ের জরুরতের কথা ভাবুন। আমাদের এই প্রজন্মকে আত্মপরিচয়হীনতার দিকে আর ঠেলে দিবেন না। জনগণের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত উম্মাহর সন্তানদের মন যেভাবে চায় সেদিকে নিয়ে গেলে এ জাতির বিপর্যয় ঘটবে, সময়ের অপচয় হবে। কারণ হাদিস শরিফে এসেছে ‘আলা কুল্লুকুম রা‘য়ীন ওয়া কুল্লুকুম মাসউলুন আন রা‘য়ীয়াতিহি’।তরজমা আপনাদের ভালো জানা আছে তাই আশা করি কষ্ট হবে না।