ইমরান আহমাদ
জেরুজালেম। পৃথিবীর একমাত্র নগরী, যা তিনটি ধর্মের কাছেই সমান পবিত্রময়। ধর্মীয় তীর্থস্থান। প্রিয় নবীজী সা. এর মহিমান্বিত মি’রাজের স্মৃতিবিজড়িত এবং প্রথম ক্বিবলা হওয়ায়, মুসলমানদের কাছে এটি মক্কা-মদিনার পরেই তৃতীয় পবিত্রতম শহর। বনি ইসরাইলের অসংখ্য নবীদের জন্ম ও কর্মভূমি হবার কারণে ইহুদিদের কাছেও এটি তেমনি এক পবিত্র নগর। হযরত ঈসা আ. এর জন্মস্থান ও মরিয়ম আ. এর ইবাদতগাহ হিসেবে এ শহরকে খৃস্টানদের আঁতুড়ঘরই বলা যায়।
তাই এ শহরকে নিয়ে যুগে যুগে এতো দ্বন্ধ-সংঘাত, কাড়াকাড়ি। বিশ্ব ইতিহাসের রক্তক্ষয়ী অনেক যুদ্ধের দগদগে ক্ষত লেপ্টে রয়েছে শহরটির ঐতিহ্যে। আর অাগত দিনের অনিবার্য সংঘাতের আভাস তো এখনি পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমান অগ্নিগর্ভ প্রেক্ষাপটও ঐতিহাসিক এ সূত্রতারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
১২৪৪ সাল। মুসলমানরা দ্বিতীয় বারের মতো ক্রুসেডারদের হাত থেকে উদ্ধার করলো পবিত্র জেরুজালেম। ইউরোপীয়রা এটা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। পারার কথাও নয়। ইউরোপজুড়ে চললো তোলপাড়। চাপা উত্তেজনা সর্বত্র। নয়া ক্রুসেডের পদধ্বনি শোনা গেলো ভূমধ্যসাগরের পশ্চিম পাড়ে। প্রস্তুতি চললো পুরোদমে।
❏
১২৪৯ সাল। পোপ ডাক দিলেন অনুমিত ধর্মযুদ্ধের। ঘোষিত হল সপ্তম ক্রুসেড। কিন্তু অন্যবারের মতো এবার আর তেমন সাড়া পড়লো না। সাজসাজ রব উঠলো না ইউরোপের রাজধানী গুলোয়। এর কারণ হিসেবে প্রথমত বলা যায়—বিধ্বংসী মোঙ্গল ঝড়! এশিয়া তছনছ করে যা এবার ইউরোপমুখী। পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ তখন মোঙ্গল উত্তাপ ভালোই টের পাচ্ছিল। নিজেদের ভৌগলিক নিরাপত্তাই যেখানে হুমকির মুখে, সেখানে মিডল ইস্টের ভূত চাপবে কী করে!
দ্বিতীয়ত: ১৫৪ বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা। ইতিপূর্বে ছয়-ছয়টি হিংস্র ক্রুসেডের নেতৃত্ব দিয়েছে মূলত পশ্চিম ইউরোপ। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে তারা কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছে না। টানা দেড়শ’ বছর ধরে এতো এতো যুদ্ধ, লক্ষ লক্ষ ক্রুসেডারদের প্রাণহানী আর আকাশচুম্বী সামরিক ব্যায়; অথচ প্রাপ্তি হল লেভান্টের কিছু অংশ। লাভের তূলনায় লোকসানটা তাই শতগুণ বেশি।
এসব কারণেই তাদের এবারের এই নিরাবেগ নীরবতা। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে দেখা দিল ফ্রান্স। ক্রুসেডের ঝাণ্ডা এবার এককভাবে তুলে ধরলো ফিরিঙ্গীরা। অন্যরা দায়সারার জন্যই শুধু শরীক থাকলো।
❏
লুই নবম। বিখ্যাত ফরাসি সম্রাট {১২৩৪-১২৭০}। অন্যান্য ইউরোপীয় সম্রাটদের থেকে তিনি ছিলেন একদম আলাদা। জোচ্চড়ি, লাম্পট্য, অনাচার ও অমিতাচার থেকে ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত। সেইসাথে ছিলেন একজন ধার্মিক খৃস্টান। ধর্মীয় সকল রীতিনীতি তিনি পুরোপুরি পালন করতেন। একারণে গণমানুষের কাছে তিনি ছিলেন সেন্ট লুই নামে পরিচিত। তাকে সর্বস্তরের জনগণ হৃদয় থেকে শ্রদ্ধা করতো। তার প্রতি তাদের ছিল অগাধ আস্থা। সেই মহান রাজা নবম লুই এবার নামলেন ক্রুসেডে। আশাহত ইউরোপ তাই নতূন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো।
১৩ মে। ১২৪৯ সাল। নবম লুইয়ের নেতৃত্বে ফরাসি সেনাদের সাথে সম্মিলিত ক্রুসেড বাহিনী ইউরোপ ছাড়লো। ১২০ টি বিশালাকৃতির জাহাজ ভর্তি সেনা ও অস্ত্র নিয়ে নামলো ভূমধ্যসাগরে। তারা জেরুজালেম দখলের অভিপ্রায়ে পূর্বমুখী হলেও, এবার রোখ করলো আইয়ূবীয় মিসরের দিকে। সেনাপতি বাইবার্সের কায়রো পানে।
ক্রুসেডের দেড়শ’ বছরের তেতো অভিজ্ঞতায় তারা এটা অন্তত বুঝে নিয়েছিল, জেরুজালেম বা পুরো শাম কব্জা করতে হলে সর্বাগ্রে মিসর অধিকার করতে হবে। কারণ, তখন শাম ছিল মিসরীয় আইয়্যূবী সালতানাতের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রদেশ। তাই যতোবারই শামে আক্রমণ হয়েছে, ততোবারই মিসরীয় বাহিনীর তোপের মুখে ক্রুসেডারদেরকে বিপর্যস্ত হতে হয়েছে। গাজী সালাহ্উদ্দিন আইয়ূবী এই মিসর থেকেই অভিযান চালিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাস পূণর্দখল করেছিলেন। সুলতান আস-সালিহ্ও মিসর থেকে আক্রমণ চালিয়েই দ্বিতীয়বার বাইতুল মুকাদ্দাস পূণরুদ্ধার করেন। তাই মিসরে মুসলিম শাসন বহাল থাকলে শামকে কখনোই জবরদখল করা যাবে না। আর করা গেলেও; তা হবে সাময়িক। এজন্যেই এবারের ক্রুসেডের প্রধান টার্গেট হলো মিসর। ক্রুসেড বাহিনী ধেয়ে চললো কায়রো অভিমুখে।
❏
ভূমধ্যসাগর থেকে কায়রোর পথে দু’টি বন্দরের যে কোন একটি ব্যবহার করতে হয়। আলেকজান্দ্রিয়া না হয় আদ্ দামিয়াত। অপেক্ষাকৃত কম সুরক্ষিত হওয়ায় ক্রুসেডাররা আদ্ দামিয়াত অবতরণ করলো। সেখানে ছোট্ট একটি দুর্গ ছিল। যার কেল্লাদার ছিলেন ফখরউদ্দিন। তিনি ছিলেন দুঃসাহসী যোদ্ধা। ততক্ষণাৎ কায়রোয় সেনা সাহায্য চেয়ে দূত পাঠালেন। সেই সাথে নিজের স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়েই বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ালেন ক্রুসেডের এই নতূন তুফানের বিরুদ্ধে। অনেকদিন ঠেকিয়ে রাখলেন খৃস্টান সয়লাব। কিন্তু বারবার সেনা সাহায্য চেয়েও কায়রো থেকে যখন কোন সাড়া পেলেন না, তখন তিনি হাল ছেড়ে দিলেন। এমন অসম যুদ্ধকে আত্মহত্যার নামান্তর ভেবে কেল্লা ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন কায়রো। পরে জানলেন, সুলতান মৃত্যুশয্যায় থাকায় সেনা সাহায্যের বিষয়টি তাকে অবহিত করা হয়নি। আদ্ দামিয়াত বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই শুরু হলো সপ্তম ক্রুসেড। এ বিজয়ের ফলে ক্রুসেডারদের মনোবল অনেকটাই বেড়ে গেলো। তাই কায়রো আক্রমণে তারা আরো উদগ্রীব হয়ে ওঠলো।
❏
২৬ নভেম্বর। ১২৪৯ সাল। সম্মিলিত ক্রুসেড বাহিনী কায়রোর উদ্দেশ্যে আদ্ দামিয়াত ত্যাগ করলো। এর তিনদিন আগেই সুলতান আস্ সালিহ মৃত্যু বরণ করলেন। অথচ এহেন দুর্যোগময় মুহুর্তে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রয়োজনটাই সবচে’ বেশি ছিল। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, সুলতানের এই মৃত্যুর খবর চেপে রাখা হলো বেশ কয়েকদিন। ক্রুসেড আগ্রাসনের মুখে অাইয়ূবীয়রা ক্ষমতার দ্বন্ধে জড়িয়ে পড়ুক, এটা চাইতেন না একজন নারী। তার এই ইচ্ছাতেই নিয়মতান্ত্রিক ভাবে রাষ্ট্রীয় সব ফরমালিটি চলতে লাগলো। এমনকি সুলতানের ঘরে নিয়মিত খাবারও পাঠানো হতে লাগলো। রাজকীয় ফারমানও জারী হলো, তাতে সুলতানের স্বাক্ষরও দেওয়া হতে লাগলো! বাহ্রী মামলুকদের যে দলটি সুলতানের ঘর পাহারায় ছিল, তারাও জানতো না সুলতানের মৃত্যুর খবর! এসবের নেপথ্যে যে নারীর ভূমিকা ছিল, তিনি ছিলেন মূলত এক আর্মেনীয় দাসী। আব্বাসী খলিফাহ মুসতাসিম বিল্লাহ এ দাসীকে উপহার স্বরুপ সুলতান আস্-সালিহ’র কাছে প্রেরণ করেন। সেই দাসী এতোটাই রূপবতী ছিল যে, তাকে দেখেই সুলতান অভিভূত হয়ে যান। ফলে দাসী হিসেবে না রেখে ততক্ষণাৎ বিয়ে করে তাকে সুলতানার মর্যাদা দেন। ইতিহাসে তার সঠিক নাম জানা না গেলেও; তিনি শাজারাতুদ্ দুর নামেই সমধিক পরিচিত। মানে মুক্তাবৃক্ষ। অাগুনে রূপের সাথে তিনি গুণেও ছিলেন অনন্যা। ধাবমান ক্রুসেডারদের মোকাবেলায় সুলতানের নামে ফরমান জারী করে সৈন্যদের দ্রুত প্রস্তুত করিয়ে নেন। মসুলে থাকা আস্ সালিহপুত্র তুরান শাহ্কে সিংহাসনে এসে বসার আহবান জানিয়ে চিঠিও লিখেন। মূলত তার এই দূরদর্শীতায়-ই সুলতানের মৃত্যুতে কোন ধরণের রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়নি। আগত ক্রুসেডারদের জন্য অনুকূল মাঠও তৈরী হয়নি।
❏
২১ ডিসেম্বর। ১২৪৯ সাল। ক্রুসেডার বাহিনী অবশেষে বাহরুস্ সাগীরের তীরে এসে পৌছায়। খৃস্টানরা ছিল তিনভাগে বিভক্ত। একাংশের নেতৃত্বে আছেন সম্রাট নবম লুইয়ের তৃতীয় ভাই আলফানসো। আরেক অংশের নেতৃত্বে অপর ভাই রবার্ট। বাকি অংশ থাকলো অন্য ভাই চার্লস ও স্বয়ং নবম লুইয়ের নেতৃত্বে।
বিখ্যাত নীলনদের একটি শাখা হচ্ছে এই বাহরুস্ সাগীর। নীলনদের চেয়ে আকারে ছোট হওয়ায় এর নাম বাহ্রুস্ সাগীর বা ছোট নদী। এই নদীর ওপর তীরেই মানসুরাহ্ শহর। মানসুরাহ মিসরের একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি। এর পতন ঘটাতে না পারলে কায়রো দখল করা অসম্ভব।
ক্রুসেড বাহিনী নদীর পাড়ে এসে দেখলো পরলোকগত সুলতানের মায়ের নেতৃত্বে মিসরীয় বাহিনী প্রস্তুত বাহ্রুস্ সাগীরের অপর তীরে। নদী পেরুবার জন্য কোন সাঁকো না থাকায় খৃস্টানরা নদী ভড়াট করতে শুরু করলো। জবাবে মুসলিম বাহিনী বৃষ্টির মতো তির নিক্ষেপ করতে লাগলো। তিরবৃষ্টির মুখে খৃস্টানরা পিছু হটলো। এবার কাঠের চলন্ত ঘরের আড়াল নিয়ে খৃস্টানরা পূণরায় বাঁধ দিতে চেষ্টা করলো। মুসলিম বাহিনী এবারে নদীর পাড় কাটা শুরু করলো। খৃস্টানরা বাঁধ নিয়ে যতোই আগায়, মুসলিমরা ততোই পিছিয়ে দেয়। সেই সাথে তিরবৃষ্টি তো আছেই। এভাবেই চলতে থাকলো প্রায় ছয় সপ্তাহ। কোন ফল আসছে না দেখে ক্রুসেড বাহিনী আদ্ দামিয়াত ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। ঠিক এসময়েই স্থানীয় এক খৃস্টান এসে সম্রাট লুইকে জানালো মাত্র তিন মাইল ভাটিতেই নদী পারাপারের সাঁকো রয়েছে!
❏
৮ ফেব্রুয়ারি। ১২৫০ সাল। টানা ছয় সপ্তাহ নদীর ওপারে হাসফাঁস করার পর, বিশ্বাসঘাতকের দেখানো পথে অত্যন্ত গোপনীয়তায় ক্রুসেডারদের তিনটি বাহিনীর একটি, রবার্টের নেতৃত্বাধীন বাহিনী নদী পেরিয়ে চলে এলো মুসলিম বাহিনীর ঘাড়ের ওপর। এবং অজান্তেই ক্রুসেডারদের অশ্বারোহী বাহিনী টুটে পড়লো পদাতিক মুসলিম তিরন্দাজ সৈন্যদের ওপর। ফলাফল যা হবার, তাই হল। সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেলো ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীটি। অপর দু’টি ক্রুসেড বাহিনী তখনও নদী পেরুতে পারেনি। টানা দ্বিতীয় জয় পেলো ক্রুসেড বাহিনী। খৃস্টানদের বিশ্বাস জন্মে গেলো, এবার তারা সঠিক পথেই হাঁটছে! এখন টার্গেট মানসুরাহ। কিন্তু তারা জানতো না, সেখানে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে! তারা কার মুখোমুখী হতে যাচ্ছে! তিনি আর কেউ নন, ক্রুসেডের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা—সেনাপতি রুকনুদ্দিন বাইবার্স। দ্য প্যান্থার। চলবে