কুতায়বা আহসান
– আওয়ারা বাতাসের ঝাকুনি আক্রোশে সাগরের বুকে আছড়ে পড়ছিল। বুভুক্ষু উর্মীমালারা মৃত্যু-ভয়াল গর্জন তুলে সফেন মস্তক তুলে দলে দলে এগিয়ে যাচ্ছিল। নয়া দুনিয়া থেকে সোনা রোপা সহ কিমতী বস্তুবাহী জাহাজগুলো অনুকুল বাতাসে বড় দ্রুত বেগে পূর্ব দিকে এগিয়ে আসছিল। বাতাস অনুকুল থাকায় তাদের দাড়টানা মাল্লারা বিশ্রামের সুযোগ পেয়েছিল। পালের গতি জাহাজগুলোর গায়ে যেন পাখনা গজিয়ে দিয়েছিল।
– হঠাৎ তারা দেখতে পেল সামন দিক থেকে একটা নৌবহর এগিয়ে আসছে। জাহাজগুলোর মাস্তুলে হিস্পানীয় পতাকা পতপত করে উড়ছে। নৌবহরের সামনে রয়েছে বড় আকারের দুটো কিশতী। কিশতীগুলোর ডেকে যে একদু’জন দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের গায়ে হিস্পানীয় সৈনিকের পোষাক। নয়া দুনিয়া থেকে আগত জাহাজের লোকগুলো আনন্দে আন্দোলিত। তাদের জাতীয় নৌবহরের একটা অংশ তাদেরকে স্বাগতম জানাতে এবং তাদেরকে নিরাপত্তা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে আসছে। অথচ বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। নৌকা দুটোর একটিতে ছিলেন হাসান ক্রুসু, আর অপরটিতে ছিলেন কাকাদ। নৌকাতে তাঁদের সাথে ছিল বাঁছাই করা কিছু কমান্ডো। তারা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অগ্রসরমান জাহাজগুলোকে নিরীক্ষণ করে চলছিলেন।
– ওরা আরো কিছুটা কাছে আসতেই হাসান ক্রুসু এবং কাকাদ নৌকা দুটো নিয়ে দুদিকে ছড়িয়ে পড়লেন। তারা দুই দিকে ছড়িয়ে পড়তেই বহরের জাহাজগুলোও দুভাগে বিভক্ত হয়ে দুদিকে ছড়িয়ে পড়ল। নয়া দুনিয়া থেকে আগতরা মনে করল তাদের জাতীয় নৌবহর তাদের চতুর্পাশ নিরাপত্তাবেষ্টনীতে নেবার জন্যেই এভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছে।
– এটা ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের মুহূর্ত। পরিবেশটা দেখার জন্য প্রতিটি জাহাজে যতগুলো লোক ছিল সবাই ডেকে এসে দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করতে লাগলো। তারা হাত উঁচিয়ে কাপড় উড়িয়ে তাদের জাহাজগুলোকে স্বাগতম জানাচ্ছিল।
– জবাবে আচানক ওদিক থেকে ঝাকে ঝাকে তীর ছুটে আসতে লাগলো। মুহূর্তেই ডেকে দাড়ানো লোকগুলোর বেশির ভাগ পাটাতনে লুটিয়ে পড়তে লাগল। তাদের রক্তে নৌকাগুলো বোঝাই হয়ে যাচ্ছিল।
– ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। এরই মধ্যে হাসান ক্রুসু তাঁর নৌকাটিকে বিদ্যুৎ গতিতে একটা জাহাজের কাছে নিয়ে গেলেন। নৌকাটা কাছে যেতেই তিনি আর তাঁর কমান্ডোরা একযোগে সেটিতে লাফিয়ে উঠে বেঁচে যাওয়া সৈনিকদের উপর আজনবী গজব হয়ে আবির্ভূত হলেন। ওদিকে কাকাদও ঠিক একই রকম গজব হয়ে তাদের আরেকটি জাহাজের উপর আছড়ে পড়লেন। তারা তাদের কাজ শেষ করতে না করতেই দেখতে পেলেন তাদের নৌবহরের বাকি জাহাজগুলো এগিয়ে এসে নয়া দুনিয়া থেকে আগত প্রতিটি জাহাজের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে।
– মুসলিম মুজহিদরা হিস্পানীয় সৈন্যদের উপর চোখে কাটা বিদ্ধ হওয়ার মতো ঢুকে পড়ে তাদেরকে শেষ করতে লাগলেন। মুসলিম মাল্লারা হিস্পানীয় সৈন্যদের উপর আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো ভেঙ্গে পড়তে লাগলেন। তাঁদের তরবারিগুলো থেকে আগুনের ফুলকি উড়ছিল। গজবের ভয়ানক ভূত আর বদনসীবির মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওদেরকে একেবারে নিঃশেষ করে দিচ্ছিলেন। হিস্পানীয় সৈন্যদের হাহাকার আর গোঙানির নিচে সাগরের উর্মিমালার আওয়াজ তলিয়ে যাচ্ছিল।
– দেখতে দেখতে প্রতিরোধের শেষ সদস্যটিও লুটিয়ে পড়ল। হাসান ক্রুসুর লোকেরা তখন লাশগুলো সাগরের হাঙরদের জন্য খাবার হিসেবে ছুড়ে মারতে লাগলেন। হাসান ক্রুসু আর কাকাদ নয়া দুনিয়া থেকে আগত প্রতিটি জাহাজের ভেতর ঢুকে সেগুলোতে থাকা মাল সামানার একটা লিষ্ট বানিয়ে নেয়ার পর একটি জাহাজের ডেকে এসে দাড়ালেন। এ পর্যায়ে হাসান ক্রুসু সীমাহীন আনন্দ প্রকাশ করে কাকাদকে উদ্দেশ্য করে বললেন:
– কাকাদ! আমার মুহতাম ভাই। আজকের এই সাগর যুদ্ধের জয় আমার কাছে ভিন্নতর খুশির আমেজ নিয়ে আসছে।
– কাকাদ অনেকটা জোরে হেসে বললেন: আনন্দটা বোধ হয় এ জন্যে যে, ইতোপূর্বে তোমার সাথে যে সব যুদ্ধে অংশ নিয়েছি কোনো যুদ্ধেই এতো বিপুল ও মূল্যবান মাল পাইনি।
– তোমার ধারণা ঠিক, তবে এ ছাড়াও একটা কারণ আনন্দের মাত্রাটাকে বাড়িয়ে তুলেছে।
– কাকাদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন: আর কী কারণ?
– আমরা যখন আক্রমণে এসেছিলাম তখন বতাস ছিল বেশ জোরালো ও আমাদের প্রতিকুলে। আর ওরা ছিল সুবিধাজনক অবস্থানে বাতাসের অনুকুলে। কিন্তু আক্রমণ শেষে আমরা যখন ফিরে যাচ্ছি তখনো বাতাস জোরালো এবং আমাদের যাত্রাপথের অনুকুলে। তাই আশা করছি আমরা খুব তাড়াতাড়িই মনজিলে পৌঁছে যেতে পারবো অথচ আমাদের মাল্লাদেরকে নৌকা বেয়ে নেয়ার কষ্ট করতে হবে না।
– কাকাদ বললেন সেটা আমাদের সৌভাগ্য। আমাদের সাথে অবশ্যই তোমার দাদুর দু’আ ছিল। এরপর তারা নয়া দুনিয়া থেকে আগত জাহাজগুলোকে মধ্যখানে রেখে বাতাসের অনুকুলে পূর্ব দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। চলবে।