আসিফ আযহার
অখণ্ড ও অসাম্প্রদায়িক ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা সংগঠন ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ এর ইতিহাস অনেকেরই অজানা। অনেকে অল ইন্ডিয়ান কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের সভাপতি ও স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে চিনলেও হুসাইন আহমদ মাদানীকে চিনেন না। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন হুসাইন আহমদ মাদানীর শিষ্য। হুসাইন আহমদ মাদানী ছিলেন ভারতবর্ষের সর্বস্তরের মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা ও কংগ্রেসের বন্ধু সংগঠন ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ চেয়েছিল অখণ্ড ও অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন ভারত। এজন্য হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ভিত্তিতে স্বাধীন ভারতের জন্য কংগ্রেস ও জমিয়ত ঘনিষ্ঠভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। কিন্তু ব্রিটিশের ষড়যন্ত্র, সামন্তবাদী মুসলিম লীগের প্রতারণা ও ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু নেতাদের চক্রান্তে শেষ পর্যন্ত অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন ভেস্তে যায় এবং ভারতবর্ষের মুসলমানরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তান নামক এক প্রতারণাকে চাপিয়ে দেওয়া হয় ভারতবর্ষের অর্ধেক মুসলমানদের ওপর আর বাকী অর্ধেক হয়ে পড়ে ‘নিজেদের মাটিতে পরদেশী’।
পরবর্তীতে মুসলীম লীগের প্রতারণার ফসল ‘পাকিস্তান’ কমপক্ষে ২০ টিরও বেশী মুসলিম গণহত্যা সংঘটিত করে ইতিহাসের পাতায় এক কুৎসিত প্রতারণার অধ্যায়ে পরিণত হয়। মুসলিম জনগণের ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে সামন্তবাদী মুসলিম লীগের এলিট গোষ্ঠী কী ধরণের মুসলিম রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিল সেটা শুরুতেই টের পেয়ে গিয়েছিলেন মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী। তাই তিনি ভারতবর্ষের মুসলমানদেরকে সামন্তবাদী মুসলিম লীগের ‘পাকিস্তান’ নামক প্রতারণার ব্যাপারে সতর্ক করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আবেগপ্রবণ মুসলমানরা ধর্মের নামে মুসলিম লীগের প্রতারণায় ঠিকই ফেঁসে যায়। জন্ম হয় নিপীনবাদী আধা-সামন্ততান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের। কিছু ভন্ড মুসলিম নবাব-জমিদার হয়ে পড়ে এই রাষ্ট্রের প্রভূ। নবাব-জমিদারদের সাবেক লাঠিয়াল বাহিনীকেই নতুন রাষ্ট্রের সেনা-পুলিশে পরিণত করা হয়। এসব সেনা-পুলিশরা পাকিস্তানের হর্তাকর্তা নবাব-জমিদারদের হুকুমে যেভাবে খুশি সেভাবে পাকিস্তানের ‘প্রজাদের’ ওপর ঝাপিয়ে পড়ত। লারকানার জমিদার ভুট্টো ও তার সঙ্গপাঙ্গরা পাকিস্তানের বৈধ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে ক্ষমতা না দিয়ে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের ওপর লাঠিয়াল বাহিনী লেলিয়ে দেয়। এর কিছুদিন আগে বেলুচিস্তানে সংঘঠিত হয়েছিলো আরেকটি গণহত্যা।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের চরিত্র যে নিপীড়নবাদী হবে তা আগেই ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ এর নেতা হুসাইন আহমদ মাদানী টের পেয়েছিলেন। তাই তিনি ভারতের মুসলমানদেরকে পাকিস্তান বর্জনের আহবান জানান। তৎকালীন আসাম প্রদেশের অংশ সিলেট জেলা পাকিস্তানের সাথে থাকবে নাকি ভারতের সাথে থাকবে এ নিয়ে তখন একটি ভোটাভোটি হয়। এটি ৪৭-এর রেফারেন্ডাম নামে পরিচিত। হুসাইন আহমদ মাদানী নিজে সিলেটে এসে নগরীর নয়াসড়ক মসজিদে অবস্থান করে কংগ্রেস ও ভারতের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য মুসলমানদেরকে আহবান জানান। কিন্তু মুসলমানরা পাকিস্তানী প্রতারণার ফাঁদ থেকে বের হতে পারেনি। তাই পাকিস্তানের পক্ষেই ভোট পড়ে বেশী এবং সিলেটের বড় অংশ পাকিস্তানের সাথে চলে যায়। করিমগঞ্জসহ কিছু অংশ চলে যায় ভারতের সাথে। অনেক সিলেটীদের বাড়ীর আঙ্গিনা বিভক্ত হয়ে যায় দুই দেশের মধ্যে। এর পরবর্তীতে পাকিস্তান রাষ্ট্র চেপে বসে মুসলমানদের ঘাড়ে। ঘাড়ে বসে ধর্মের কলা দেখিয়ে যেভাবে খুশী সেভাবে মুসলমানদের শোষণ করেছে। শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানীরা বিদ্রোহ করে নতুন দেশ সৃষ্টি করেছে। অথচ যদি ভারতবর্ষের মুসলমানরা হুসাইন আহমদ মাদানীর আহবানে অখন্ড দেশে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতেন তাহলে অন্তত নিজেদের সাথে যুদ্ধ করতে হতো না।
হুসাইন আহমদ মাদানী অখন্ড ভারতের পক্ষে মুসলমানদেরকে সংঘবদ্ধ হওয়ার যে আহবান জানিয়েছিলেন তা আজও সমানেই প্রাসঙ্গিক। ৪৭-এর রেফারেন্ডামের সময় আমাদের পূর্বপূরুষরা হুসাইন আহমদ মাদানীর আহবানের বিরোধিতা করে যে ভূল করেছিলেন তা স্বীকার করার জন্য গিয়েছিলাম হুসাইন আহমদ মাদানীর সংগঠন ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ এর আসাম প্রদেশের বর্তমান সভাপতি মাওলানা বদর উদ্দিন আজমলের কাছে। মাওলানা বদর উদ্দিন আজমল কাসিমী আসামের পার্লামেন্টের সদস্য এবং বর্তমান ভারতের অন্যতম মুসলিম নেতা। মাওলানা বদর উদ্দিনের আত্মীয়রা বিভক্ত ভারতবর্ষের আলাদা রাষ্ট্রে বিভক্ত। তিনি এদেশে দুই যুগ পরে এসেছেন তাঁর আত্মীয়দের সাথে দেখা করার জন্য। তাঁর আত্মীয়ের বাসায় তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, একজন ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলমান হিসেবে তিনি পাকিস্তানকে প্রয়োজনীয় মনে করেন কিনা। তিনি অত্যন্ত পরিস্কারভাবে জবাব দিয়েছেন, ভারতবর্ষের মুসলমানদের কোন ‘পাকিস্তান’ এর প্রয়োজন ছিল না বরং মুসলমানদের প্রয়োজন অবিভক্ত ভারত।
যাই হোক, মাওলানা বদর উদ্দিনকে ভারতের সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পেন ক্লাবের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়েছি। যে কোন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন ও কর্মসূচির প্রতি পেন ক্লাবের নিরংকুশ সমর্থন ও একাত্মতা অব্যাহত থাকবে। ভন্ড ইসলামী নেতা ও ভন্ড স্যাকুলার বুদ্ধিজীবীদের কবল থেকে বর্তমান প্রজন্মকে মুক্ত করার জন্য পেন ক্লাবের জ্ঞানতাত্ত্বিক কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে আরও কিছু ধারণা দেওয়ার জন্য আমার ‘বিংশ শতকের ইসলাম ও মার্কসবাদ প্রবন্ধে’র একটি ক্ষুদ্র অংশ তোলে দিচ্ছি। ভাল লাগলে পড়তে পারেন।
“…………………. আমরা দেখেছি কীভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন সেসময়ের রাজনৈতিক ইসলামকে একটি নজীরবিহীন সংকটের মুখোমুখি করেছিল। আমরা এটাও দেখেছি যে, ওসমানীয় সাম্রাজ্য যদিও প্রকৃত অর্থে কোন ইসলামী খিলাফত ছিল না তবুও তার গায়ে রাজনৈতিক ইসলামের আবরণ থাকায় তা অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করত। তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পরাজয়কে অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ইসলামেরই বিপর্যয় হিসেবে দেখা হতে থাকে। সে পরিস্থিতিতে কোন ভূখন্ডে নতুনভাবে রাজনৈতিক ইসলামের উত্থানের কোন আশা ছিল না। ইখওয়ানুল মুসলিমুন সংগঠন, ওমর মুখতারের রাজনৈতিক জিহাদ এবং সাঈদ নূরসীর শৈল্পিক ইসলাম তৎকালীন পশ্চিমা পরাশক্তিকে হটিয়ে দেয়ার মত কোন শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। তাই পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল হতে মুক্তি অর্জনের কোন জিহাদী দৃষ্টান্ত তখন সামনে ছিলনা।
এ ব্যাপারটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী ইসলামী আন্দোলনকেও কমবেশী প্রভাবিত করে যদিও এখানকার রাজনৈতিক ইসলামের ধারা ছিল আরব হতে স্বতন্ত্র। ওসমানীয় খিলাফতের বিলুপ্তিতে ব্রিটিশ বিরোধী মুসলিম স্বাধীনতাকামীদের অনেকে হতবাক হয়ে পড়েন এবং খিলাফত আন্দোলনের সূচনা করেন। বলাই বাহুল্য ওসমানীয় খিলাফত ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার কোন আদর্শ ছিল না এবং এর পুনরাবর্তনের কোন সম্ভাবনাও ছিলনা। তাই খিলাফত আন্দোলনের কোন ভবিষ্যৎ ছিলনা। অন্যদিকে সিপাহী বিপ্লবে পরাজয়ের ফলে ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী জিহাদে বিপর্যয় নেমে আসার ফলশ্রুতিতে যে নিয়মতান্ত্রিক ইসলামী শিক্ষা ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তা বিংশ শতকের প্রথমদিকে এসে আরও কিছু সংকটের মুখোমুখী হয়। ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত জমিয়তুল আনসার ও পরবর্তীতে এর ধারাবাহিকতায় ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ কংগ্রেসী নীতি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম রুপকার শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান এবং তাঁর শিষ্য হুসাইন আহমদ মাদানী বুঝতে পারেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও অখন্ডতার জন্য হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের কোন বিকল্প নেই। ভারতবর্ষের বিচিত্র পরিস্থিতি তাদেরকে বাধ্য করে পরাধীন ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য এমন একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক ইসলামের পথ খুজতে যা এদেশের হিন্দু ও অমুসলিম জনগোষ্ঠির জন্যও সুসংবাদ বয়ে নিয়ে আসবে। গর্বের কথা মাহমুদুল হাসান এতে সফল হয়েছিলেন। তাঁর ইসলামী স্বাধীনতাকামী আন্দোলন তথা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক জিহাদের সাথে হিন্দুরাও সম্পৃক্ত ছিলেন। হিন্দু রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ শাইখুল হিন্দের আন্তর্জাতিক মিশনে সাঁড়া দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগিতা আদায়ের জন্য জার্মানির দ্বারস্থ হন। অন্যদিকে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উবায়দুল্লাহ সিন্ধি এ মিশনের অংশ হিসেবে রাশিয়ার মার্কসবাদী বিপ্লবের সফল নায়ক লেনিনের সাথে দেখা করেন।
লেনিন ইসলামের বিপ্লবী রাজনৈতিক চরিত্র দেখে বিস্মিত হয়ে যান। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার মার্কসবাদী আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনের প্রশ্নে নানামূখী তাও্বিক ও প্রায়োগিক সংকটে জর্জরিত লেনিন ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা খিলাফতের একটি বাস্তব মডেল দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু সেসময়ের পৃথিবীতে কোন খিলাফতের অস্তিত্ব ছিল না। বস্তুত পঞ্চম খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযীযের পর পৃথবীতে কোন সত্যিকারের খিলাফত গড়ে ওঠে নি এবং কোন সত্যিকারের খলিফারও জন্ম হয় নি। তাই ইসলামী রাজনৈতিক দর্শন লেনিনের কাছে অনেকটা বায়বীয় মনে হয় এবং ভারতবর্ষের ইসলামঘেষা স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন প্রদানের ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। অন্যদিকে ব্রিটিশে হাতে তাড়া খেয়ে ভারতবর্ষীয় খিলাফত আন্দোলনের যেসব জিহাদপন্থী কর্মী মধ্য এশিয়া হয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন ও লেনিনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তারাও ইসলামী বিপ্লবী দর্শনের সাথে মার্কসবাদের কিছু অদ্ভূত মিল দেখতে পেয়ে বিস্মিত হয়ে যান এবং বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার পূনর্গঠন প্রক্রিয়া দেখার জন্য রাশিয়ায়ই থেকে যান। শোনা যায়, এদের কয়েকজনকে লেনিন নিজের দেহরক্ষী হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। …………………”