মাওলানা মামুনুল হক :
জামাতে ইসলামীকে দুর্বল করার আরো একটি পদক্ষেপ সফলভাবে বাস্তবায়ন করল বর্তমান সরকার ৷ যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে প্রথম সারির নেতাদের ফাঁসি ও সারা দেশের নেতা-কর্মীদের মামলা-মোকাদ্দমা, জেল-হুলিয়া দিয়ে এক রকম কোনঠাসা করে রেখেছে বাংলাদেশে সব চেয়ে সংঘবদ্ধ ক্যাডারভিত্তিক দলটিকে ৷ এরপর দলীয় নিবন্ধন বাতিল, নির্বাচনী প্রতীক বাতিলসহ আইনীভাবে নিষিদ্ধ করার যাবতীয় আয়োজনও সম্পন্ন প্রায় ৷ রাজনৈতিকভাবে প্রবল এই প্রতিপক্ষকে কাবু করার পর সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল জামাতের অর্থনৈতিক ভিত দুর্বল করা ৷ জামাতে ইসলামের অর্থনৈতিক মজবুতির অন্যতম বুনিয়াদ মনে করা হয় ইসলামী ব্যংককে ৷ শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার সর্ব বৃহৎ এই ব্যংকটি গড়ে উঠেছিল জামাতে ইসলামীর সাংগঠনিক নেটওয়ার্কের উপর ভর করেই ৷ সেই সাথে জামাতে ইসলামীর সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ ছিল ইসলামী ব্যংকের উপর বরাবরই ৷ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের পক্ষ থেকে জামাতের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য ভেঙ্গে দেওয়ার দাবি ছিল বহু দিন ধরেই এবং সে প্রেক্ষিতে প্রথম অঙ্গুলি নির্দেশ ছিল ইসলামী ব্যংকের প্রতিই৷
একটি শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে নিপুনভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে ইসলামী ব্যংককে জামাতের প্রভাবমুক্ত করার কাজ ৷
ব্যাপক রদবদল ও নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা:
জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, গত ৫ই জানুয়ারি রাজধানীর এক হোটেলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের সভায় প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয় ৷ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান এবং পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোস্তফা আনোয়ারকে অপসারণ করা হয় ৷
ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন আরাস্তু খান। সভায় মেজর জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মতিনকে এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান, ড. মো. জিল্লুর রহমানকে অডিট কমিটির চেয়ারম্যান এবং মো. আবদুল মাবুদকে রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনেও পরিবর্তন আনা হয়। বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মহাপরিচালক ও ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক সামিম মোহাম্মদ আফজাল ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
ব্যংকের প্রধান নির্বাহী পদ ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় মো. আবদুল হামিদ মিঞাকে ৷ এর কিছুদিন আগে ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে মোহাম্মদ মুনিরুল মওলা, মুহাম্মদ মোহন মিয়া, মোহাম্মদ আলী ও আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া পদোন্নতি পান। এর আগে তাঁরা ব্যাংকটির এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ইসলামী ব্যাংকের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান আরাস্তু খান এর আগে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে মানিকগঞ্জ জেলার গরপাড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসএস ডিগ্রি এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
আবদুল হামিদ মিঞা এর আগে ইউনিয়ন ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও শিল্প ব্যাংক (বর্তমানে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ টি বোর্ড, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকে বিভিন্ন পদমর্যাদায় দায়িত্ব পালন করেন।
দেশের সর্ব বৃহৎ এই ব্যংকটির এমন আমূল পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘এটি হঠাৎ করে হয়নি। ব্যাংকটি বিপুল মুনাফা কী কাজে ব্যবহার করে তা নিয়ে একটি প্রশ্ন ওঠে বিভিন্ন মহলে। হয়তো এসব কারণেই এই পরিবর্তন হয়েছে।’
যেভাবে ঘটল নীরব অভ্যুত্থান:
ব্যংকের পরচালনা ও ব্যবস্থাপনার মূল চাবিকাঠি থাকে বোর্ড অব ডাইরেক্টর্সের হাতে ৷ ইন্ডিপেন্টেড ডাইরেক্টরের কোটায় সাতজন ডাইরেক্টর নিয়োগ দিয়ে সরকারী নিয়ন্ত্রণের পথ সুগম করা হয় ৷ এ ছাড়া স্পন্সর ডাইরেক্টর কোটায়ও সুপরিকল্পিতভাবে সরকারের আস্থাভাজনদের অন্তর্ভুক্তি ঘটানো হয় ৷ এজন্য পরিশোধিত মূলধনের শতকরা দুইভাগ শেয়ারের মালিকানা অর্জন করেন তারা ৷ বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে একটা আতংক ছড়ানো হয় ৷ ব্যাংকটির সাথে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উত্থাপননের প্রেক্ষিতে সরকারী হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা রয়েছে এমন আশংকা থেকে বিদেশি কিছু বিনিয়োগকারী নিজেদের শেয়ারগুলো স্টক মার্কেটে বিক্রি করে দেয় ৷ বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের এবং স্টক মার্কেটের অন্যান্য শেয়ার কিনে নিয়ে নতুন কিছু স্পন্সর ডাইরেক্টর যুক্ত হন বোর্ড অব ডাইরেক্টর্সে ৷ আর অপর দিকে বোর্ড অব ডাইরেক্টর্সের সাবেক চেয়ারম্যানসহ আরো কাউকে কাউকে চাপ প্রয়োগ করে পদত্যগে বাধ্য কিংবা অপসারণ করে তদস্থলে সরকারের আস্থাভাজনদেরকে নির্বাচিত ও মনোনিত করা হয় ৷
অবশ্য ব্যাংকের বর্তমান কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিবর্তন হয়েছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ৷ নেতৃত্বে ব্যাপক রদবদল প্রসঙ্গে নতুন চেয়ারম্যান দাবি করেন, ‘এখানে কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয়নি। এটা চেইঞ্জ অব গার্ডস। প্রতি বছর জানুয়ারি এলে ব্যাংকে পরিবর্তন হয়। এটা খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ভয়ের কোনো কারণ নেই। ব্যাংকটি কোয়ালিটি কাজ করছে। তাদের অনেস্টি নিয়ে আমার প্রশ্ন নেই। আমার মনে হয় কারো নেই। আমরা সামনের বছর আরো ভালো টার্গেট দিয়েছি। আশা করছি আরো ভালো হবে ৷ চেয়ারম্যান অভয় দিলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ব্যাংকটির সাধারণ গ্রাহক এমনকি ব্যাংক কর্মকর্তাদের মাঝেও অজানা ভীতি কাজ করছে ৷ মানুষ এখন ইসলামী ব্যাংকে লেনদেন করতে ভরসা পাচ্ছে না ৷
পেছন ফিরে দেখা:
বিশ শতকের ষাটের দশকে মিসরের মিটগামারে প্রথম সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে বাংলাদেশেও এরূপ একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সক্রিয় হয়। ১৯৭৪সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক বা আইডিবির চার্টার স্বাক্ষরিত হয় ৷
১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং উইং বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকেরঅভিমত জানতে চায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে তৎকালীন গবেষণা পরিচালক এ এস এম ফখরুল আহসান ১৯৮০ সালে ইসলামি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য দুবাই ইসলামি ব্যাংক, মিসরের ফয়সাল ইসলামি ব্যাংক,নাসের সোশ্যাল ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যাংক সমিতির কায়রো অফিস পরিদর্শন করেন। ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন।
১৯৮০ সালের ১৫-১৭ ডিসেম্বর ইসলামী অর্থনীতি গবেষণা ব্যুরোর উদ্যোগে ঢাকায় ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮১ সালের মার্চে ওআইসিভূক্ত দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের সম্মেলন সুদানের খার্তুমে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে পেশকৃত এক প্রতিবেদনেবাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান, বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। ১৯৮১ সালে এপ্রিল মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে লেখা এক পত্রে পাকিস্তানের অনুরূপ বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর শাখাগুলোতেও পরীক্ষামূলকভাবে পৃথক ইসলামি ব্যাংকিং কাউন্টার চালু করে এ জন্য পৃথক লেজার রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ওপর এক মাস ব্যপি এক প্রশিক্ষণ কোর্স অনুষ্ঠিত হয়। এ কোর্সে বাংলাদেশ ব্যাংক, সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বিআইবিএম ও প্রস্তাবিত ঢাকা আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড)-এর ৩৭ কর্মকর্তা অংশ নেন।
১৯৮২ সালে নভেম্বর মাসে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকেরএকটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় তারা বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে যৌথ উদ্যোগে একটি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আইডিবির অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করার ব্যাপারে ‘ইসলামী অর্থনীতি গবেষণা ব্যুরো’ (আইইআরবি) এবং বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক সমিতি (বিবা) অগ্রণী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বহুমাত্রিক চেষ্টার ফলস্বরূপ ১৯৮৩ সালের ১৩মার্চ ঢাকা আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড নামে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম সুদমুক্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে।১৯৮৩ সালের২৮ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড নামে বাংলাদেশের প্রথম ইসলামী ব্যাংকের প্রস্ত্ততিমূলক কাজ করা হয় এবং এ নামেই তখন পর্যন্ত ব্যাংকের সাইনবোর্ড ও প্রচার-পুস্তিকা ব্যবহার করা হয়। আলহাজ্ব মফিজুর রহমান ২৯ মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। এরপর ৩০ মার্চথেকে এ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড নামে কার্যক্রম শুরু করে। এক্ষেত্রে ১৯জন বাংলাদেশি ব্যক্তিত্ব, ৪টি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান এবং আইডিবিসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের১১টি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থা এবংসৌদি আরবের দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় উদ্যোক্তারূপে এগিয়ে আসেন।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে ১৯১৩ সালের কোম্পানি আইন অনুযায়ী ১৩ মার্চ ১৯৮৩ সালে নিবন্ধিত হয় এবং ২৮ মার্চ ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স প্রাপ্ত হয়ে ৩০ মার্চ ১৯৮৩ থেকে দেশের তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম সুদমুক্ত ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। ব্যাংকটির দেশি-বিদেশি স্পন্সরগণের মধ্যে আছেন ২২ জন বাংলাদেশী ও বাংলাদেশ সরকার এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহের ১৩টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর মূলধনের ৫৯.৫৮ ভাগ অংশীদার ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও কয়েকটি বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ৪০.৪২ ভাগ অংশীদার বাংলাদেশী উদ্যোক্তা ও শেয়ারহোল্ডারগণ। ব্যাংকটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ-এ তালিকাভুক্ত।
প্রতিষ্ঠাকালে অনুমোদিত ৫০০ মিলিয়ন টাকা এবং পরিশোধিত ৬৭.৫০ মিলিয়ন টাকা মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ইসলামী ব্যংক। বর্তমানে যা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে অনুমোদিত দুই হাজার মিলিয়ন টাকা এবং পরিশোধিত ১৬ হাজার ৯৯ দশমিক ৯১ মিলিয়ন টাকায় পৌছেছে ৷ আর ব্যংকটির গ্রাহক সংখ্যা বর্তমানে এক কোটি বিশ লাখ ৷
জামাতে ইসলামীর সংশ্লিষ্টতা ও সুবিধা গ্রহনের অভিযোগ:
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠার পেছনে জামাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সম্পৃক্ততা অনস্বীকার্য ৷ তারা উদ্যোগী হয়ে দেশি বিদেশী বিনিয়োগকারী সংগ্রহ করে গড়ে তোলে ব্যাংকটি ৷ ব্যাংকটির সূচনাকালে বাংলাদেশের কোনো কোনো মন্ত্রী মহোদয়সহ অনেকেই নাক সিটকে ছিলেন ৷ ব্যাংকিং খাতে ইসলামের প্রবেশকে তারা ভালো চোখে দেখেন নি ৷ এমনকি অনেকে উপহাসও করেছিলেন ৷ কিন্তু তিন যুগের কাছাকাছি সময় পাড়ি দিয়ে ইসলামী ব্যাংক সাফল্যের এমন উচ্চতায় পৌছেছে যে, বাংলাদেশে একক কোনো ব্যাংকের পক্ষে তার ধারেকাছে ভেরাও কঠিন ৷ আর এ সাফল্যের পেছনে জামাতের সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই ৷ জামাতের সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক তিনভাবে কাজ করেছে ৷ প্রথমত ব্যাংকের কর্মকর্তা ও ব্যাংকারদের মধ্যে রয়েছে জামাতের বিপুল পরিমাণ সাংগঠনিক জনশক্তি ৷ যারা কোয়ালিটি সার্ভিসের মাধ্যমে ব্যাংকটির অগ্রযাত্রায় অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে ৷ দ্বিতীয়ত সূচনাকাল থেকেই সাংগঠনিক নেটওয়ার্কের বিপুল সঞ্চয়কারী গ্রাহক পেয়েছে ব্যাংকটি ৷ আর তৃতীয়ত সাংগঠনিক নির্ভরযোগ্য বড় রকমের বিনিয়োগ গ্রহীতাও পেয়েছে ব্যাংকটি সূচনাকাল থেকেই ৷ আর নিঃসন্দেহে এসকল সুবিধাগুলো ইসলামী ব্যাংক পেয়েছে জামাতে ইসলামীর সাংগঠনিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ৷ সুতরাং ইসলামী ব্যাংকের আজকের অবস্থায় আসার পেছনে জামাতের বড় ভূমিকা রয়েছে একথা বলে দেয়া যায় নির্দ্বিধায় ৷
ইসলামী ব্যাংকের অগ্রযাত্রায় যেমন জামাতের অবদান অনস্বীকার্য তেমনি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে জামাতে ইসলামীর অর্থনৈতিক সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টিও ওপেন সিক্রেট ৷ কোনো ধরনের অনিয়ম বা সরকারের নিয়ম-নীতি ভঙ্গ না করেই এ সুবিধা পাওয়া সম্ভব ছিল জামাতের জন্য ৷ জামাতের জনশক্তির কর্মসংস্থান তৈরিতে ইসলামী ব্যাংকের বড় ভূমিকা রয়েছে ৷ এটা পরোক্ষ সুবিধা ৷ আর নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের আয় থেকে একটা অংশ এয়ানত হিসাবে জামাতে ইসলামীর ফাণ্ডে জমা হয় ৷ সাংগঠনিক জনশক্তির প্রদত্ত এই এয়ানতই মূলত প্রত্যক্ষ সুবিধা ৷ এর বাইরে ব্যাংকের মোট উপার্জিত লাভ থেকে নীট লাভ বন্টনের পূর্বে একটা অংশ বোর্ড অব ডাইরেক্টর্সের সিদ্ধান্তের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও বিভিন্ন সামাজিক কাজে অনুদান হিসাবে দেয়া হয় ৷ এই অংক বন্টনের হিসাব যেমন ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটি কর্তৃক যাচাই হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও তার হিসাব দিতে হয় ৷ সুতরাং এখানেও প্রত্যক্ষ কোনো সুবিধা কোনো সংগঠনকে দেয়ার সুযোগ নেই ৷ তবে পরোক্ষভাবে এমন ক্ষেত্রে বন্টন করা সম্ভব যাতে সাংগঠনিক লোকজন সুবিধা প্রাপ্ত হয় ৷ আর তৃতীয় আরেকটি বড় ফাণ্ড রয়েছে যা ইসলামী ব্যাংকগুলোতেই তৈরি হয় ৷ সেটা হল, শরীয়াহ অননুমোদিত আয় বা বিভিন্ন অর্থদণ্ডের টাকা ৷ এই টাকা শরীয়াহর আলোকে সমাজকল্যাণে ব্যয় হয় ৷ মূলত এই টাকা দিয়েই পরিচালিত হয় ইসলামী ব্যাংক ফাউণ্ডেশন ৷ এই ফাউণ্ডেশনের মাধ্যমে বহুমুখী সমাজকল্যানমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয় ৷ ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল চলছে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৷ এ সকল ক্ষেত্রে জামাতে ইসলামীর সাংগঠনিক ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের ঘনিষ্ঠজনেরা চিকিৎসাসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা পায় ৷ স্বাভাবিকভাবেই ব্যপক রদবদলের পর এ দুয়ারগুলো এখন অনেক সংকুচিত হয়ে পড়বে ৷ মনে করা হচ্ছে এতে জামাতের সাংগঠনিক তৎপরতাও ব্যহত হবে ৷
কেমন হবে ইসলামী ব্যাংকের ভবিষ্যৎ?
পরিচালনা পর্ষদে ব্যপক রদবদল এবং শীর্ষ নির্বাহী পদগুলোতে আমূল পরিবর্তনে ব্যাংকটির ভেতর-বাহির সব জায়গায় চলছে নানা জল্পনা কল্পনা ৷ অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে অজানা আতংক ৷ আর এ থেকে অনেকে ইসলামী ব্যাংকে লেনদেন পরিহার করে চলছে ৷ কেন্দ্রীয় ব্যংকের দায়দয়িত্বের কারণে গ্রাহকদের সঞ্চয় ও আমানতের ব্যপারে যদিও কোনো রকম ঝুঁকির কিছু নেই, তথাপি মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না ৷ তা ছাড়া ব্যাংকটির অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই সংহত, এর রয়েছে নিজস্ব বিশাল রিজার্ভ, বিপুল অংকের পরিশোধিত মূলধন ৷ তাই সহসাই এর বিরূপ অবস্থা প্রকাশ পাওয়ার ভয় নেই ৷ এর বিনিয়োগও রয়েছে ষাটহাজার কোটি টাকার উপরে এবং এই বিনিয়োগগুলো খুবই মানসম্মত ৷ পরীক্ষিত বিনিয়োগ গ্রহিতাদেরকেই বিনিয়োগ দেয়া হয়েছে ৷ এসকল কারণে ব্যাংকটির নতুন ম্যানেজমেন্টকে সহসাই কোনো বড় ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে না ৷ তবে অনেকে আশংকা করছে বড় বড় ঋণ ছাড় করিয়ে ব্যাংকের টাকা অপব্যবহার করা হতে পারে ৷ তা ছাড়া ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অনেকের উপর ছাঁটাইয়ের খড়গ নেমে আসতে পারে ৷ ইতোমধ্যে অমুসলিম ও নারী জনশক্তি নিয়োগের পরিকল্পনা ঘোষনা করেছেন নতুন ব্যবস্থাপনা বিভাগ ৷ এতে এই আশংকা তৈরি হয় স্বাভাবিকভাবেই যে, ব্যাংকটির বিরাজমান ন্যুনতম দ্বীনী পরিবেশও বিনষ্ট হয়ে যাবে ৷ শরীয়াহ পরিপালনের ক্ষেত্রে আগে থেকেই অভিযোগ রয়েছে, আর নতুন ম্যানেজমেন্ট এমন কি স্বয়ং জেনারেল ম্যানেজারের ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে ৷ বাংলাদেশের মধ্যে তুলনামূলক শরীয়াহ পালনের ক্ষেত্রে এযাবৎকার সবচেয়ে অগ্রগামী ইসলামী ব্যাংকটি যে আগেকার সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারবে সেটাও প্রশ্ন স্বাপেক্ষ বিষয় ৷ এসকল বিষয়গুলো ব্যাংকটির উপর সুদূর প্রসারে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করতেই পারে ৷
সৌজন্যে: মাসিক রাহমানী পয়গাম
ফেব্রুয়ারী ‘১৭