রবিবার, ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১২:৩৩
Home / ইতিহাস ঐতিহ্য / সমুদ্র ঈগল ১৬

সমুদ্র ঈগল ১৬

কুতায়বা আহসান :

– এদিকে তুর্কি সালতানাতে এক দিনবদলের পালা চলে এসেছিল। সুলতান সেলিম ইন্তেকাল করেছিলেন, আর তাঁর স্থলে খেলাফতের আসনে সমাসীন হয়েছিলেন তাঁরই সাহেবজাদা সুলতান সুলায়মান। সুলায়মানকে তাঁর গোয়েন্দারা দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়ত সংবাদ জানিয়ে আসছিল। সুলায়মান যখন অনুধাবন করতে পারলেন বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউরোপীয়রা তুর্কদের সাথে মোকাবেলা করতে সক্ষম নয়, তখন অবস্থার চাহিদানুযায়ী তিনি তাঁর নৌবাহিনীকে অধিকতর শক্তিশালী করে তুলার প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। যেন সাগরে একচ্ছত্র প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার পর স্থলে আক্রমণ পরিচালনা সহজতর হয়।
– সে লক্ষে সুলতান দ্রুত গতির ক’জন কাসেদের মাধ্যমে বারবারুসাকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি কুস্তুনতুনিয়ায় ডেকে পাঠান।
– সুলতানের নির্দেশ পৌঁছা মাত্রই বারবারুসা তাঁর অধিকৃত অঞ্চলে একটি শক্তিশালী বাহিনী মোতায়েন করত সুলতানের সাথে মোলাকাতের জন্য কুস্তুনতুনিয়ার দিকে যাত্রা করেন।
– তবে খোদাদাদ তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী এ আমীরুল বহর কুস্তুনতুনিয়ার দিকে যাত্রার উদ্দেশ্যে যে পথ ধরেছিলেন তা ছিল অকল্পনীয় বাস্তবমুখী পদক্ষেপ।
– বারবারুসা প্রথমে উত্তর দিকে রওয়ানা হয়ে ওদিকে অবস্থিত একটি হিস্পানীয় দ্বীপের উপর টাইফুনের গতিবেগে আছড়ে পড়েন। দ্বীপে অবস্থিত হিস্পানীয় বাহিনী স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি এই মুহূর্তে তারা বারবারুসা কর্তৃক আক্রান্ত হতে পারে। সুতরাং অতর্কিত আক্রমণের মুখে তারা নিজেদেরকে সামলে উঠার আগেই তাদের শক্তির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়ে। মুহূর্তের ভেতরই তাদের বাহিনীর বেশীরভাগ নিঃশেষ হয়ে যায়। বাকিদের বন্দী করে নেয়া হয়। এ ছাড়া দ্বীপে যে পরিমাণ সম্পদ ছিল তাও দ্রুত তাদের জাহাজগুলিতে তুলে দক্ষিণ পূর্ব দিকে তুফান বেগে ধেয়ে যেতে থাকেন। কারণ সাগরে ভ্রাম্যমাণ তাঁর গোয়েন্দারা তাঁকে সংবাদ দিচ্ছিল ওদিকে জেনেভা থেকে আফ্রিকার জন্য রসদবাহী ক’টা জাহাজ আসছে।
– জেনেভা থেকে আগত জাহাজগুলো ছিল নিরুদ্বিগ্ন। এখানে তারা বারবারুসা কর্তৃক আক্রান্ত হবে এ ছিল তাদের স্বপ্নেরও অতীত। কিন্তু অপ্রস্তুত অবস্থায় যখন তারা সমুদ্র ঈগলের শিকারে পরিণত হলো তখন তাদের করার কিছুই রইলো না। তাদের বেশিরভাগই মারা পড়ল। অল্প যারা বেঁচে ছিল বারবারুসা তাদের কয়েদ করে নেন। এরপর বিপুল পরিমাণ রসদ হস্তগত করার পাশাপাশি জাহাজগুলোকেও তাঁর বহরের সাথে একীভূত করে নেন।
– বারবারুসার এহেন ঝড়োগতির আক্রমণ স্পেনিশদের অন্তরে আতঙ্ক ধরিয়ে দিয়েছিল।
– এরপর তিনি মাল্টাকে মধ্যখানে রেখে দীর্ঘ একটা চক্কর দেন। মাল্টার নাইটবাহিনী যাদেরকে অপরাজেয় মনে করা হতো তারাও কিন্তু তখন তাঁর নৌবহরের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস করতে পারে নি।
– খাইরুদ্দীন বারবারুসার সৌভাগ্যই বলতে হবে— ইতোমধ্যে তিনি একজন মুখলিস সাথী, একজন নির্ভিক কমান্ডার, সাগরের প্রতিটি বাঁক আর অব্যক্ত ভাষা সম্পর্কে অতিঅভিজ্ঞ একজন কাপ্তান পেয়ে যান। তাঁর নাম ছিল তুরগুত। তবে ইউরোপীয়রা তাঁকে ড্রাগুত নামেই ডেকে থাকতো। ইনি ছিলেন আনাতুলিয়ার বাসিন্দা। প্রথম জীবনে ছিলেন একজন পহলোয়ান। এ পেশায় যথেষ্ট অর্থ কামানোর পর একটা জাহাজ ক্রয় করে সাগরে নেমে পড়েন। সাগরে নামার পর ধীরে ধীরে একটা শক্তিশালী দল গড়ে নির্যাতীত স্পেনীয় মুসলমানদের সেখান থেকে উদ্ধারের প্রচেষ্টায় নিবেদিত হয়ে ওঠেন। যেহেতু তাঁর ও খাইরুদ্দীনের জীবনের মাকসাদ ছিল এক ও অভিন্ন তাই খাইরুদ্দীন যখন মাল্টাকে চক্কর কেটে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক সে সময় তুরগুত তাঁর সাথে সাক্ষাত করত নিজের ছোট নৌবহরটি আমীরুল বাহরের হাতে তুলে তার সাথে একীভূত হয়ে যান। তুরগুতের একীভূত হয়ে যাওয়ায় খাইরুদ্দীনের শক্তি যেমন বেড়ে গিয়েছিল তেমনি সাগর যুদ্ধে অমূল্য এক রত্ন পেয়ে যান।
– ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন তুরগুত ছিলেন সীমাহীন দুঃসাহসী ঝানু একজন কাপ্তান। যখন তাঁর সঙ্গী সাথী ছিল অল্প, নৌবহরও ছিল অতি মামুলী, তখনও তিনি ইউরোপের বড় বড় নৌবহরকে সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন।
– মাল্টাকে একপাশে রেখে কুস্তুনতুনিয়া অভিমুখে যাত্রার প্রাক্কালে খাইরুদ্দীন বারবারুসা জানতে পারেন স্পেন সম্রাট চার্লস তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যাবার জন্য বিশাল এক নৌবহর ইউরোপ সেরা এডমিরাল আন্দ্রে ডুরিয়ার নেতৃত্বে পাঠিয়ে দিয়েছে।
– সংবাদটি জানতে পেরে বারবারুসা গর্কির তীব্রতায় পিছন ফিরে আন্দ্রে ডুরিয়ার দিকে এগিয়ে যান।
– এদিকে আন্দে ডুরিয়া যখন জানতে পারল খাইরুদ্দীন বারবারুসা তার দিকে ধেয়ে আসছেন তখন সে সাগরের এক নাম না জানা দ্বীপে নিজেকে লুকিয়ে নেয়।
– খাইরুদ্দীন বারবারুসা ক’দিন ধরে সাগরে খুঁজে ফিরেও যখন আন্দ্রে ডুরিয়ার দেখা পাননি তখন তিনি কুস্তুনতুনিয়ার দিকে পথ ধরেন।
– গিলিপুল পৌঁছে তিনি তাঁর নৌবহরের জাহাজগুলোতে রঙ দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এরপর সেখান থেকে কুস্তুনতুনিয়ায় সুলতান সুলায়মানের খেদমতে গিয়ে পৌঁছেন।
– খাইরুদ্দীনের জাহাজ যখন কুস্তুনতুনিয়ার উপসাগরে প্রবেশ করে তখনকার অবস্থাটা ছিল সত্যিই দেখার মতো। কালো রঙের জাহাজগুলোতে রংবেরঙের পাল পতপত করে উড়ছিল। জাহাজের ডেকগুলো থেকে কামানগুলো শূন্যে গোলা নিক্ষেপ করে সুলতানকে সালামী প্রদান করছিল। কুস্তুনতুনিয়ায় আসার পথে জেনেভার নৌবহর সহ যে সব নৌবহর তিনি কব্জা করে নিয়েছিলেন সেগুলো ছিল তাঁর নৌবহরের পেছনে সারিবদ্ধভাবে সাজানো। সেগুলো ছিল রসদে পরিপূর্ণ।
– খাইরুদ্দীন যখন শাহী ইওয়ানে প্রবেশ করেন তখনকার তাঁর শান শওকত ছিল সত্যিই দেখার মতো। তাঁর সাথে ছিলেন তাঁর অভিজ্ঞ ১৮ জন কাপ্তান। খাইরুদ্দীন এবং তাঁর সাথীরা অত্যন্ত সম্ভ্রমের সাথে সাগরযুদ্ধ থেকে লব্ধ মালে গনীমত সুলতানের হাতে তুলে দেন।
– সুলতান সুলায়মানের সাথে ঐতিহাসিক সে সাক্ষাতটিও ছিল ইতিহাসের এক মোড় নির্ধারক ঘটনা। ভূভাগের সব চেয়ে বড় তাজদার অত্যন্ত সম্ভ্রমের সাথে তাঁর পাশে ডেকে বসান সেই সাগর সম্রাটকে জগতের ইতিহাসে যার শৌর্যের তুলনা অত্যন্ত বিরল।
– সুলতান অপলক চেয়ে দেখছিলেন সাগরের এই জীবন্ত কিংবদন্তীকে। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন তার শরীরে বয়সের ভার যথেষ্ট। তবে তাঁর মধ্যে কেমন যেন একটা অস্তিরতা কাজ করছিল। রোদে পুড়ে তার গৌড়বর্ণ চেহারাটা যেন তামাটে হয়ে গেছে। তার ঘণ শশ্রুরাজিতে একদুটোয় বার্ধকের প্রতীক শুভ্রতা যেন খিলখিল করে হাসছে। কিন্তু তারপরও তার পেটা পেশীগুলো দেখে তাঁকে একজন পহলোয়ানই মনে হচ্ছিল। উঁচু নাকের ডগাটি ছিল ছুরির অগ্রভাগের মতো সুঁচালো। সুলতানকে বলা হয়েছিল বাহ্যত তাকে রুক্ষ দেখা গেলেও তাঁর অন্তরে বসবাস করে মিল্লাতের জন্য এক দরদী নরোম আত্মা। রাগের মুহূর্তে কিন্তু সেই নরোম আত্মাটা হয়ে যায় চাটানের চেয়েও শক্ত। তিনি একজন সহজাত মাল্লা। সাগরের কোন দিক থেকে কখন কেমন ঝড় আসছে তা তিনি আগে থেকেই আন্দাজ করে নিতে পারেন।
– সুলতান সুলায়মানও তাঁকে তদীয় পিতার মতো নতুন করে ‘আমীরুল বাহার’ ও ‘পাশা’ খেতাবে বিভূষিত করেন। সুলতান সুলায়মান তাঁর জিম্মায় এই দায়িত্ব অর্পণ করেন যে, আপনি ইউরোপীয়দের সাগর যুদ্ধে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখবেন যাতে আমরা স্থলভাগে এশিয়া ও ইউরোপীয় অঞ্চলে ওদের উপর শক্ত আঘাত হানতে পারি।
– সাক্ষাতকালে সুলতান বারবারুসা এবং তাঁর সাথীবৃন্দকে সোনা রোপায় সাজানো তলোয়ার উপঢৌকনস্বরূপ প্রদান করেন। এতদ্যতীত তিনি তাঁর অস্ত্র উৎপাদন স্থাপনার চাবি তুলে দিয়ে বলেন, আপনি আপনার তত্ত্বাবদানে অস্ত্রপাতি ও নতুন একটা নৌবহর গড়ে নিন।
– সুযোগ পেয়ে বারবারুসা প্রথমেই একটি শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তুলার প্রতি মনোযোগ দেন। পুরণো জাহাজগুলোকেও মেরামত করে নতুনের মতো করে নেন। বাদবানদের জন্য প্রচুর রশি বানিয়ে নেন।
– খাইরুদ্দীন নৌবহরের কাজে হাত দিলে সুলতান সুলায়মান নিজের তত্ত্বাধানে তাঁর মিস্ত্রীদের সামনে প্রয়োজনীয় লোহা, তামা, কাঠ এবং আলকাতরার পাহাড় জমিয়ে তুলেন।
– খাইরুদ্দীন বারবারুসা সুযোগের সদ্যবহার করে বড় মাজারী ও ছোট মিলিয়ে ৮৪টি জাহাজের এক বিশাল নতুন নৌবহর গড়ে নেন।

আরও পড়ুন : সমুদ্র ঈগল ১৫

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...