খতিব তাজুল ইসলাম::
ওয়াজ মানে নসীহা উপদেশ। দ্বীনী কথা বার্তার আলোচনা পরামর্শ যেখানে দেয়া হয় তাকে ওয়াজ মাহফিল বলে। দ্বীনী প্রতিষ্ঠানে দিনরাত ২৪ ঘন্টা যে পাঠদান হয় ওয়াজ নসীহত এর বাহিরে কিছু নয়। তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠদানের পরেও আবার ওয়াজ নসীহত কাদের জন্য? স্বাভাবিক এই প্রশ্ন মনের মাঝে উকি মারে। হ্যাঁ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমলিয়াতের জন্য যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন প্রশিক্ষণ ও স্পেশাল দীক্ষার। আর তার জন্য আছেন বুজুর্গানে দ্বীন। যাদের সান্নিধ্যে এবং খানকায় চলে আমলিয়াতের প্রশিক্ষণ। ওয়াজ নসীহতের প্রগ্রামে একদিনে একটানা ১২ ঘন্টা বা বিশ ঘন্টায় তা অর্জন কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। হ্যাঁ সাধারণ পাবলিকের জন্য গ্রামে গঞ্জে শহরে নগরে অলিতে গলিতে যে সমস্ত প্রগ্রাম হয় তাতে হয়তোবা তাদের খোরাক আছে। প্রশ্ন হলো কার জন্য কি ওয়াজের প্রয়োজন কোন মাসআলার দরকার কোন ওয়াইজ কি উপস্থিতি অডিয়েন্সকে জিজ্ঞেস করে নেন? না কখনো না। ওয়াজ হবে ওয়াইজের মর্জি মত। এখানে শ্রুতার কোন মুল্য নেই। শ্রুতার কাজ শোনা ওয়াইজের কাজ ওয়াজ করা। গতবছর যা ওয়াজ হয়েছে এবারও সমান। কেউ একবারও জিজ্ঞেস করে দেখেন না যে গতবারের ন্যায় এবার কোন ইমপ্রোভ উন্নতি হয়েছে কিনা?
এতো গেল গ্রাম গঞ্জের ওয়াজের কথা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়াজ মাহফিলের ধরণ কেমন হওয়া চাই? প্রতিষ্ঠানের একটা ওয়াজ মাহফিলের লক্ষ উদ্দেশ্য আলাদা। এখানে কওমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা বলছি। জনগণের দান অনুদানে চলা প্রতিষ্ঠানগুলো বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের মাধ্যমে ফান্ড সংগ্রহের কাজ চলে। এলাকার মানুষের সাথে গণসংযোগ স্থাপিত হয়। কমিটির লোকগণ সচল হন। বার্ষিক সম্মেলনে থাকে একটা উৎসবের আমেজ। আমরা দেখেছি এলাকার মেয়েরা বাবার বাড়ি নাইওরিতে আসেন ওয়াজ মাহফিলকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ইদানিং সেই সংযোগে যেন ভাটা পড়েছে। স্থানীয় লোকের সম্পৃক্ততা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। বিদেশ নির্ভর দান খয়রাতের প্রভাবও কম নয়। তাছাড়া যেহেতু নামে থাকে এতীম খানা। তাই স্থানীয় শিশুরা কম আসে। দূর দূরান্তের কিশোররা এসে আবাসিক সুবিধা পেয়ে থাকে খায় পড়ে। তাদের অভিভাবকরা কালে ভদ্রে আসেন। নানান পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে লোকালিটি থেকে কওমি দিনের দিন বঞ্চিত হচ্ছে যা সুখকর নয়।
প্রতিষ্ঠানের ওয়াজ মাহফিলকে সাধারণ ওয়াজ মাহফিলের মত সাজানো ঠিক না। এখানে নসীহত বর্ষণের চেয়ে এক্টিভিটিজ বেশি হওয়া জরুরি। ছাত্রদের পারফরমেন্স সহ শিক্ষনীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা থাকা উচিত। না‘ত হামদ কবিতা আবৃতি নাটক প্যারোডি সহ ছাত্রদের নানান কর্মের কারুকার্য দিয়ে সজ্জিত করা। জানি এসব হয়। কখন? নিজস্ব পরিমন্ডলে। প্রতিষ্ঠানের ভিতরে। সর্বসাধারণের জন্য তো আজকের দিনে তাদের দক্ষতা প্রদর্শনের পালা। দেখা যায় বার্ষিক সম্মেলনে ছাত্রদের অংশগ্রহন থাকে নামকা ওয়াস্তে। মানে ইন্তেজামিয়ার বিভিন্ন কাজ নিয়ে তারা ভিজি থাকে। অথচ এদিন থাকার কথা ছিলো তাদের দখলে। পারফরমেন্স যারা দেখান বা আলোচনা যারা করেন তারা এই প্রতিষ্ঠানের কেউনা। দাওয়াতি মেহমান এসে তিনির কেরেশমা দেখিয়ে যান। যারা প্রফেশনাল ওয়াইজ তাদের হায়ার করে আনা হয়। আরে বাবা ওটাতো রাজনৈতিক রঙ মঞ্চ না যে হায়ার করে বক্তা এনে জনগণকে তক্তা বানিয়ে যেতে হবে। আসবেন মেহমান দু‘একজনকে আনুন। তার দিক নির্দেশনা শুনুন। ডজনের ডজন যখন বর্ষাইয়া বখশাইয়া যান তখন কার কথা কে মনে রাখে? এযেন বক্তৃতা প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান। মাঠে ময়াদানে রাত জাগানিয়া প্রগ্রাম থেকে বিরত থাকা ভাল। দিনের আলোতে যা করার করুন। বড়জোর সর্বোচ্চ রাত ১২টা। হ্যাঁ আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানের ওয়াজ মাহফিলকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে নেই। শিশু কিশোরদের জন্য একপার্ট। যুবক যারা গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে দাওরা দিয়েছে পাগড়ি নেবে তাদের জন্য একপার্ট। সাধারণ ওয়াজ ও নসীহা একপার্ট। আর প্রতিটি পার্টে তার উপযোগী বক্তা থাকবে। থাকবে শিশু কিশোর ও যুবাদের অংশগ্রহন।
যুগ পাল্টিয়েছে জামানা আগাইয়া গেছে। মানুষের মন মেজাজেরও পরিবর্তন এসেছে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক ওয়াজ মাহফিল বা বার্ষিক জলসায় বিচক্ষণতা পারঙ্গমতা প্রদর্শন করা খুব দরকার। একই প্রগ্রামে ডজনের উপর বক্তা, তারপর লম্বা সময়, তারপর গভীর রাত। ঠিকাছে, কোন প্রতিষ্ঠানের আয়োজন যদি এভাবে থাকে যে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা ও চাহিদা মোতাবিক ম্যানু সাজানো হয়েছে অসুবিধা নেই। আমরা জানি জামাতের সাথে মসজিদে নামাজ আদায় করা জরুরি। পক্ষান্তরে মাহফিলের নামে বাহিরের পেন্ডালে বার বার নামাজ পড়ার জন্য মানুষকে বাধ্য করা নৈতিকাতর খেলাপ। বড় বড় জমায়েতের চেয়ে ছোট ছোট বিষয় ভিত্তিক জমায়েতে অনেক খয়ের আছে।
অনেক প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় একটিমাত্র দিনের আয়োজনের জন্য দেশ বিদেশ ব্যাপি ওয়াজের কালেকশনের মহরত চলে। লোকে লোকারণ্য হয়ে কিছু খিচুড়ি আর ঠান্ডা বিরিয়ানি খেয়ে ঠেলা ধাক্কা মেরে রাতপার। ওয়াজ মাহফিলের গণ জমায়েতের জন্য গরু খাসির কালেকশন, চাল ডালের আবেদন, পেন্ডালের খরচ চাওয়া ইত্যাদি ইসরাফের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করি। যে দেশে লক্ষ লক্ষ বণি আদম এখনো একবেলা পেট ভরে খাবার পায়না, যাদের পরনে পর্যাপ্ত কাপড় নেই, ঘরহীন বাড়িহীন পথে পথে অসহায় মানুষদের মিছিল রেখে এভাবে ওয়াজ বিলাস নিতান্ত ফাজলামু ছাড়া আর কি?!
ইসলামী মহাসম্মেলন ঘরে ঘরে না করে জেলা ভিত্তিক হউক। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গ্রামে গ্রামে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন না করে ইউনিয়ন ভিত্তিক করুন। যা করবেন অপর ভাইকে নিয়ে করুন। দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যার তার বার্ষিক সম্মেলন করুক। তবে প্রতিষ্ঠানের আকারের সাথে মিল রেখে সম্মেলনের আয়োজন করা উচিত। একেকটি ওয়াজ মাহফিল বা বার্ষিক ইসলামী সম্মেলন হয়ে উঠুক হেদায়েতের আলোক বর্তিকা স্বরূপ,তাই কামনা করি।