অনলাইনে-অফলাইনে কারো সমালোচনা করার ঘোর বিরোধী আমি। তাই ইচ্ছায় অনিচ্ছায় নিজেকে কারো সমালোচনা থেকে বহু দূরে রাখতে চেষ্টা করি সব সময়। বিভ্রান্তিকর, উদ্দেশ্যমুলক কোন লেখা তো দূরের কথা, কোন কোন প্রয়োজনীয় ছবি পোষ্ট করতেও আমি বিব্রতবোধ করি। তবে এই মুহূর্তে আমি দৃশ্যমান ছবি সংশ্লিষ্ট যে দুটো কথা বলার চেষ্টা করবো, তাতে হয়তো অনেকেই আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন না, তবে সত্য বলার ঝুঁকি তো কাউকে না কাউকে নিতেই হয়। তাই আমার এ প্রয়াস।
মুফতী রফীউদ্দীন মাহমুদ নূরী :: ছবি দুটি দেখে আপনি হয়তো ভাবছেন এটা জাতিসংঘ, ওআইসি বা রাবেতার মতো কোন সংঘঠনের ব্রিফিং রুম, আন্তদেশীয় কোন ক্লাবঘর। ক্রিকেট বা ফুটবল প্রেমিরা এক দেখায় ভাবতে পারেন এটা ফিফা বা আইসিসির রিসিভসন। ট্রাভেলস ব্যবসায়ীরা হয়তো বলবেন, কোন নামীদামী ট্রাভেলসের অফিস বা বিমানের টিকিট কাউন্টার। না, আপনি ভুল বললেন। ভুল ভাবলেন। এটা রাজধানীর একটি হেফজ খানার অফিসের চিত্র। তবে আপনি চাইলেই এখানে আপনার সন্তানকে কুরআন শিক্ষার জন্য ভর্তি করাতে পারবেন কি না জানি না। কারণ, আপনার সন্তানকে এখানে পড়াতে হলে কাড়ি কাড়ি টাকার প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বলে কথা! টাকা তো লাগবেই। আর সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দিবেন, দুনিয়া আখেরাতের সম্বল তৈরি করবেন, টাকা ছাড়া কি করে সম্ভব! আন্তর্জাতিক এ প্রতিষ্ঠানে পড়ে আপনার সন্তান দেশ-বিদেশে খ্যাতি কুড়াবে। কত কত পুরস্কারে আপনার ঘরের শোকেস ভরে উঠবে। আপনার সন্তান রেডিও-টিভিতে তেলাওয়াত করবে। আপনি জান্নাতে সুরম্য প্রাসাদের মালিক হবেন। অন্য এক আনন্দ উপভোগ করবেন। আহ! কি আরাম!!
রাজধানীতে তথাকথিত এরকম আন্তর্জাতিক মাদরাসার সংখ্যা কত? এই মুহূ্র্তে হাতে গুণে বলা মুশকিল। তবে যাত্রাবাড়ী থেকে নিয়ে সায়েদাবাদের গলির মোড় ও চিপাচাপার মধ্যে কম করে হলেও এক ডজন আন্তর্জাতিক হেফজখানা স্ব-মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। সবগুলোতে জুয়েলারী দোকানের ডেকোরেশন না হলেও টার্গেট সবগুলোরই এক। অর্থাৎ খরপোশ দিয়ে কয়েকটি মেধাবী ছাত্রকে লালন-পালন করে এদেরকে নানা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী করার মাধ্যমে অভিভাবক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এর পর ভর্তি ফি ৭০০০/- বোডিং চার্জ ৪০০০/- আয়রন বিল ২০০/- ভাতরুম পরিস্কার ১০০/- কাপড় ধোয়া ৩০০/- ইত্যাদি ইত্যাদি মোট:৯৯৯৯/- একেবারে বাটার দামে হেফজ পড়া!
আচ্ছা, ‘আন্তর্জাতিক’ এর সজ্ঞা কি? কোন রকম একটি ছাত্র নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দু-একটি দেশ ঘুরে আসলেই কি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক হয়ে যায়? সিসি টিভি আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলিই কি মাদরাসাকে আন্তর্জাতিক বলা যায়? থাকগে, বোর্ডিংএ সকালে পাতিহাঁস, দুপুরে কবুতর আর রাতে অশ্বডিম্ব খাওয়ালেই কি আন্তর্জতিকের লেভেলটা খাপ খায়? তা না হলে কোনো রকম ভাড়াটে একটি ফ্লোরে বা ফ্ল্যাটে বিশাল সাইনবোর্ডধারী এসব প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানের হয় কীভাবে? নাকি ডালমে কুচ কালা হায়?
অভিভাবক মহল বাহ্যিক ডাক-ঢোল আর হম্বি-তম্বি দেখে এসব মাদরাসায় সন্তানদের ভর্তি করলেও বেশ নিরাশ হয়েও কথা বলতে চান না এই ভয়ে যে, না জানি কুরআন বা আলেমদের শানে বেয়াদবি হয়ে যায়! চিন্তার বিষয় হলো, আমরা আমাদের সন্তানদের হাফেজ বানাতে চাই কেন? নিশ্চয় এক বাক্যে বলবেন, কুরআন হেফাজতের মাধ্যমে দ্বীনের এশায়াত ও সংরক্ষণ এবং সন্তানকে একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্টিত করতেই হাফেজ বানাই বা হেফজখানায় পড়াই। যুগ যুগ ধরে এই মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাসহ পৃথিবীর দেশে দেশে আহলে হক উলামায়ে কেরাম কুরআন হেফাজতের এ মহান খিদমাত করে আসছেন। কই? তাদের তো এরকম সাদ্দাদী বালাখানা, দেশি-বিদেশী পতাকার বাহার, তরে তরে সাঝানো ক্রেস্টে সুশোভিত শোকেস, বডিগার্ডসহ প্রাডো গাড়ি ছিল না? তাদের কুরআনের খিদমাত আর আজকের তথাকথিত আন্তর্জাতিক হেফজখানাগুলোর খিদমাতের মধ্যে এটিও অন্যতম একটি ফারাক। তবে মৌলিক পার্থক্য এখানে নয়, আরো দূরে। অনেক গভীরে। তারা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তি রাখতেন এখলাসের উপর আর আন্তর্জাতিকবাদীরা রাখেন পুরস্কার, খ্যাতি, লোভ-লালসার উপর। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসা, ঢাকার আরজাবাদ, ফরিদাবাদ, লালবাগ মাদরাসাসহ আমাদের পুরানো ধারার মাদরাসাগুলুর হেফজখানা থেকে যে রকম মেধাসম্পন্ন, চরিত্রবান, বাআমল, নেকসুরত ও নেকসিরতের অধিকারী দ্বীনের তরে নিবেদিত আলোকময় হাফেজে কুরআন বেরুচ্ছে, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আন্তর্জাতিকবাদীরা কি তা পারছে? আমাদের আকাবিরদের প্রতিষ্ঠিত এসব মাদরাসার ছাত্ররা খেয়ে না খেয়ে, রোধে পোড়ে, জলে ভিজে কওম ও মিল্লাতের জন্য নিজেকে যেভাবে প্রণোৎস্বর্গী করে গড়ে তুলছেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসবাসকারী, অশ্বডিম্বের হালুয়ায় হৃষ্টপুষ্ট এসব তারাকারা কি আদৌ তা কল্পনাও করতে পারবেন?
কয়েক লেহেনে কুরআন পড়তে পারা আর মনু্ষ্যত্ব বিকশিত হওয়া কিন্তু এক নয়। কুরআন নূরে এলাহী। এই নূর দিয়ে তারাই তাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে আলোকময় করতে পারেন, যাদের আত্মা থাকে দুনিয়ার মুহ মুক্ত। আন্তর্জাতিক নামধারীরা সেই শৈশবেই আমাদের অনুজ সোনার টুকরোদেরকে পুরস্কার আর প্রতিযোগিতার নামে ছাই ধরা শিখিয়ে ফেলছেন। ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য তো ব্যাহত হচ্ছেই, পাশাপাশি আমরা বঞ্চিত হচ্ছি আালোকময় একটি ভবিষ্যত থেকে। কিছু মানুষের পকেটভারী আর উড়োজাহাজে দেশ বিদেশ ঘুরে ক্রেস্ট সংগ্রহের জন্য আমরা আমাদের প্রজন্মের ভবিষ্যত এভাবে বিনষ্ট করতে পারি না। এজন্য উলামায়ে কেরামদের মুখ খুলতে হবে সবার আগে। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথের সন্ধান দিন। আমিন!
:
ইলিয়াস মশহুদ