মুহাম্মদ নাজমুল ইসলাম :
এবার আমরা মনস্থির করলাম এগুবো হুমায়ূন মাকবারার দিকে। সফরসঙ্গী মুনশি মুহাম্মদ উবায়দুল্লাহ’র সঙ্গে সঙ্গেই দুষ্টুমির সুর-
-এই শুনছো?
-হুম। বলো।
-তাজমহল যাবার ইচ্ছে আছে?
আছেতো কেন?
-এটা তো তাজমহলের মতোই। পরেতো আবার তাজমহল গেলে মজা পাবা না।
-আচ্ছা তাই বুঝি! তাইলে তো খরচটাও বাচলো। আসো যাওয়া যাক।
এবার টিকিট কেটে ভেতরে গেলাম।
হ্যা সত্যিই তো। হুমায়ূম মাকবারা! দেখলে পরে তাজমহল দেখতে মন চাইবে না। দেখে সত্যিই অবাক হলাম। কিছুটা তমকে গেলাম। ভাবলাম আসলে ব্যাপারটা কি! বলল, তাজমহল এর নান্দনিকতা আর হুমায়ূন মাকবারা নান্দনিকতা প্রায় একিরকম। আগে বলিনি? এবার মনোনিবেশ করলাম ইতিহাসের পাতায়।খোঁজলাম তা নির্মাণের ইতিবৃত্ত। হ্যা সত্যিই তো তাজমহল সৃষ্টিরও শতবর্ষ আগে (১৫৬২ সালে) এক মহান মুঘলপত্মী হামিদা বানু বেগম তার প্রয়াত স্বামীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করেন “হুমায়ুন কা মাকবারা” বা হুমায়ুনের সমাধি।
মুঘলরা উদ্যান-সমাধিক্ষেত্র পছন্দ করতো। তারই নমুনা দেখা যায় হুমায়ুন সমাধিতে। এমনকি বাবরের কবরেও (আফগানিস্তানে) এরকম উদ্যান-সমাধিতেই অবস্থিত। তবে, সব মোঘল সম্রাটদের এরকম উদ্যান-সমাধি জোটেনি, বিশেষ করে শেষ মুঘলরা অতি সাধারণ সমাধিতেই আজ শায়িত।
দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ উদ্যান-সমাধিক্ষেত্রের স্থপতি ছিলেন মিরাক মির্জা গিয়াথ। এ জায়গাটি হয়তো হুমায়ুনের পছন্দই ছিলো। তাই তিনি তার জীবদ্দশাতেই এর কাছাকাছি দিনা-পানাহ বা পুরানা কিল্লা নির্মাণ করেছিলেন (১৫৩৩ সালে)।
হামিদা বানু বেগম হয়তো দিল্লিশ্বরের অন্তিম ইচ্ছার কথা জানতেন। তাই মৃত্যুর পর তাকে এখানেই সমাহিত করা হয়।
হুমায়ুনকে এখানে সমাহিত করার আরো কারণ থাকতে পারে। এই বিশাল এলাকার অংশবিশেষে হমায়ূুনের কবর হওয়ারও কমপক্ষে কুড়ি বছর আগে থেকেই কবর স্থান ছিল। বেশকিছু কবর এখনো আছে।
যমুনার তীর ঘেঁষেই এ সমাধিক্ষেত্রের বিস্তার। এ কবরের স্তম্ভের ওপর দাঁড়ালে একসময় দিল্লি শহর এক নজরে দেখা যেতো।মোঘল সম্রাটদের অনেকেই সুফিসাধকদের ভক্ত ছিলেন। কোনো কোনো সম্রাটের চরিত্রে কিছু ত্রুটি থাকলেও হুমায়ুন সম্পর্কে সেরকম বিশেষ কিছু জানা যায় না। তিনি শুধু আফিম খেতেন বলে কোনো কোনো বর্ণনায় আছে। তবে, হুমায়ুন যে খাজা নিজামুদ্দিনের ভক্ত ছিলেন তা অনেকেই বর্ণনা করেছেন।
প্রথম দিকের মুঘল সম্রাটরা খাজা নিজামুদ্দিনের ভক্ত ছিলেন এক ঐতিহাসিক কারণে। অনেকে মনে করেন, নিজাম ভক্ত হুমায়ুনকে তার সুপ্ত ইচ্ছার কারণেই নিজামুদ্দিনের কবরের পাশেই সমাহিত করা হয়। নিজামুদ্দিনের কবরের পাশে শুধু হুমায়ুন না, শাহজাহান কন্যা জাহানারার কবরও আছে।
এতো বিশাল জায়গা নিয়ে অন্য কোনো মুঘল সম্রাটের সমাধি নেই। চারটে গেট পার হয়ে মূল সমাধি সংলগ্ন জায়গায় যেতে হয়। চারপাশটা কয়েক স্তরের সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। একই মুঘল স্থাপত্যরীতির অনুসরণ দেখতে পাই অপরাপর সম্রাটদের সমাধী উদ্যানগুলোতেও।
এ সমাধির চারপাশে রয়েছে একই রকম চারটি ফটক। বর্তমানে শুধু একটি খোলা। বাকি ফটক বা গেটগুলো বন্ধই থাকে।
লাল ও সাদা বেলেপাথর দিয়েই তৈরি এ সমাধিক্ষেত্র। সর্বশেষ গেটটি পার হওয়ার পরও অনেকটা পথ হেটে তবেই পৌঁছা যাবে মূল সমাধি ভবনে। মূল ভবনের চারপাশে রয়েছে অনেকের কবর। এর ওপরের ছাদে রয়েছে তিন-চারটি কবর।
চারপাশের ছাদের ঠিক মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠেছে আরেকটি বর্ধিত ভবন বা মিনার। এর ঠিক মাঝখানেই হুমায়ুনের সমাধি। হুমায়ুনের কবরের চারপাশে রয়েছে আরো কয়েকটি কবর। যা তার স্ত্রী ও অন্যান্য মুঘল পরিবারের সদস্যদের। মূল গম্বুজটিও দু’তলা বিশিষ্ট। কবরের চারপাশে আটটি গেট আছে। চারপাশ থেই এখানে আলো ও বাতাসের আনাগোনা। একই স্থাপত্যরীতি ও প্রযুক্তি তাজমহলেও লক্ষ্য করা যায়। সমাধির বাইরে কোনো বাতাস নেই। অথচ ভবনের ঠিক ভেতরেই হুহু বাতাস।
এখানে আছে হুমায়ুনের পত্নী হামিদা বেগমের কবরও।
ঠিক যেভাবে মমতাজ মহালের পাশেই সমাহিত শাহজাহান। হুমায়ূনের পাশে সেভাবেই হামিদা বানু। শাহজাহানের পুত্র দারাশিকো, আছে জাহান্দার শাহ, ফারুক শিয়ার, ও দ্বিতীয় আলমগীরের সমাধিও আছে এখানে। শাহজাহান যে হুমায়ুনের ভক্ত ছিলেন তারই নজির তার এক কন্যা ও এক পুত্রের কবর এখানে।
যে কেউ তাজমহল ও হুমায়ুনের সমাধিক্ষেত্র ভ্রমণ করলে সহজেই বুঝতে পারবেন শাহজাহান তাজমহলের অনুপ্রেরণাটি কোত্থেকে পেয়েছেন। হ্যাঁ, শাহজাহান তার দাদার (আকবর) মায়ের কাছেই পেয়েছেন এ অনুপ্রেরণা।
হুমায়ুনের কবর মুঘল সাম্রাজ্যের আরো অনেক রাজকীয় স্থাত্রের পূর্বসূরি।