ইলিয়াস মশহুদ :
মাওতুল আলিমে মাওতুল আলমে। ওহে পৃথিবী! তুমি কি জানো না- তুমি মৃত? তোমার মৃত্যু হয়ে গেছে! ওহে প্রাণহীন নশ্বর ভূমি? তোমাতে এই আমি থেকে আর কী লাভ? তুমি না মৃত!
ঝরে পড়লো একটি নক্ষত্র। ইলমে হাদিসের উজ্জল এক তারকা। একজন অভিভাবক। হারিয়ে ফেলেছি লেখার ভাষা। আমি আজ অভিভাবকহারা। আমি হতবাক। আমি নির্বাক।
মানুষ মরণশীল। সবাইকে মরতেই হবে একদিন। এ আল্লাহর চিরবিধান। মরা লাগবেই। জোর করে কেউ এ ধরায় চিরকাল থাকতে পারবে না। আজরাঈল আ.’র থাবা থেকে কেউ রেহাই পাবে না। নির্ধারিত সময়ে তাঁর কাছে ধরা দিতেই হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই। পালানোরও পথ নেই। কারণ, মৃত্যু অবধারিত এক বিষয়। তবে কেউ মরবে আগে, কেউ পরে। বিধাতার খাতার ক্রমাণুসারে।
জগতে যাদেরই আগমন হবে, প্রস্থান এক সময় তার ঘটবেই। প্রতিদিন কতোশতো মানুষ এই পৃথিবীতে শুভাগমন করছে আবার প্রস্থান করছে, তার হিসাব কে রাখে? এই ‘আসা যাওয়া’র মিছিলে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হয়না। তবে কিছু মানুষ এমন আছেন, যাদের আগমনে পৃথিবী আনন্দিত হয় আর প্রস্থানে ব্যথিত হয়। তাদের বিদায়ে আর সবার সাথে পৃথিবীও কাঁদে। কারণ, মাওতুল আলিমি মাওতুল আলমে। একজন আলেমের মৃত্যু মানে পৃথিবীর মৃত্যু! ঠিক তেমনই একজন বিদ্ব্যান আলেম হলেন হযরত শায়খে দলইরগাঁও হুজুর রাহ.।
যে সকল পীর বুযূর্গের আবির্ভাবে ধন্য হয়েছে বাংলার ভূমি, যারা নিজেদের সর্বস্ব মানবকল্যাণে উৎসর্গ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন, আধ্যাত্মিক জগতে যারা অমর আসন দখল করে নিয়েছেন, হযরত শায়খে দলইরগাঁও হুজুর রাহ. নিঃসন্দেহে তাদেরই একজন।
তাদের মত মহামানবদের মৃত্যুতে জগতবাসীর হৃদয়ে রক্তকরণ ঘটায়। কারণ, তাঁরা ভালোবাসার রাজপথ দিয়ে মানুষের আত্মার আত্মীয় হয়ে মনের গভীরে স্থান করে নিয়েছিলেন। মোমবাতির ন্যায় নিজেকে বিলিয়ে অপরকে আলো বিকিরণ করেছেন। তেমনই একজন আলোকিত মানুষ হলেন হযরত শায়খে দলইরগাঁও হুজুর রাহ.।
দুনিয়ার এই জীবন ক্ষণিকের। পরকালের জীবন অনন্ত, অসীম। যার শুরু আছে শেষ নেই। কিন্তু দুনিয়ার জীবনে রয়েছে সূচনা ও সমাপ্তি। অতএব, ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীতে আগমনকারী প্রতিটি আত্মাকেই মৃত্যুর তিক্তস্বাদ আস্বাদন করতে হবে। এটাই অনিবার্য এক বাস্তবতা। আর সেই বাস্তবতার স্বীকার হযরত শায়খে দলইরগাঁও হুজুর রাহ.।
ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়ার বুকে কত হাজার কোটি মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, ক্ষণজন্মা কত মনীষীর পদদূলিতে ধন্য হয়েছে এই পৃথিবী। কিন্তু কেউ চিরদিন বেঁচে থাকেন নি। স্রষ্টার চিরায়ত নিয়মের মধ্য দিয়েই একদিন তাকে চলে যেতে হয়েছে পরপারে। ভক্ত-মুরিদ, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, যশ-খ্যাতি, ধন-সম্পদ সব কিছুই বিসর্জন দিয়ে। লাব্বায়েক বলতে হয়েছে মহান মাওলার ডাকে সাড়া দিতে। পৃথিবীর বুকে বিচরণশীল প্রত্যেক প্রাণীকেই একদিন না একদিন তাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে। সে যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন। এজন্য বুযুর্গরা কখনো মৃত্যুকে ভয় করতেন না। মহান মাওলার সান্নিধ্য লাভের আশায় তারা সদা-সর্বদা ব্যাকুল থাকতেন। তেমনই আল্লাহপাগল এক বুযূর্গ হলেন হযরত শায়খে দলইরগাঁও হুজুর রাহ.।
কিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মতের একটি জামাত হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, তিরস্কারকারীদের তিরস্কার তাদের কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না। কথাগুলো বলে গেছেন স্বয়ং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছে, হচ্ছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত হতেই থাকবে। হক ও হক্কানিয়্যাতের একটি কাফেলা দরদভরা রাহনুমায়ীর মাধ্যমে উম্মতকে সত্যের পথে ডেকেই যান। উম্মতের কল্যাণ চিন্তায় অহর্নিশি তারা জার জার করে কেঁদেই যান। পার্থিব লোভ লালসা, ভয়ভীতি কিংবা কারো চোখ রাঙানী ক্ষণিকের জন্যও তাদেরকে বিচ্যুত করতে পারে না। যাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলেই হকের আওয়াজ আজো স্বগৌরবে ঠিকে আছে এবং ইসলামের সুশীতল শামিয়ানার নীচে এখনও আমাদের স্থান রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে সেই কাফেলার অসংখ্য মনীষীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ক্ষণজন্মা এমন সব মহামনীষীদের অন্যতম একজন হলেন হযরত শায়খে দলইরগাঁও হুজুর রাহ.।
প্রতিটি মানুষের জীবনে মৃত্যু অনিবার্য। একদিন না একদিন সবাইকেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পরপারের অনন্ত উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে হয়। চলমান এ নশ্বর ধরা কারো বিদায়ে থেমে থাকেনা, এগিয়ে চলে তার আপন গতিতে সামনের পথপানে। তো পৃথিবীর গতিধারা যেমন থেমে থাকছেনা, তেমনি যারা চলে যাচ্ছেন তাদের স্মৃতি ধারণ করে কেউ আজীবন বসেও থাকছেনা। কিন্তু তারপরও এই অগনিত-অসংখ্য মানুষের ভেতরে এমনও কিছু মানুষ থাকেন যাদেরকে মানুষ ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারেনা। তাঁরা মানব স্মৃতিতে হয়ে থাকেন চিরঞ্জীব, থাকেন চিরঅম্লান। ইতিহাস সৃষ্টিকারী এ সমস্ত মানুষকেই বলা হয় “মরেও অমর” জাতি তাদের গুণের কদর করে, মর্যাদা দেয়। তাদের আদর্শ মেনে চলে এগিয়ে যায় সম্মুখ পানে। ক্ষণজন্মা এই সব মহামানব তারাই হয়ে থাকেন, যারা আল্লাহপাকের অপর করুণায় লালিত হয়ে জ্ঞানে-গুণে, সততায়-দক্ষতায়, দয়ায়-মায়ায়, চরিত্রে ও সামাজিক আচার-আচরণে, এক কথায় জীবনের সার্বিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় একনিষ্টতায় নিজেদের জীবনকে গড়ে তুলতে পারেন। এমনি একজন ওলীয়ে কামিল হলেন হযরত শায়খে দলইরগাঁও হুজুর রাহ.।
ইতিহাসের পাতায় যে সকল খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব, ক্ষণজন্মা মহামনীষীদের জীবনেতিহাস লিপিবদ্ধ আছে; যাদের আলোচনা পর্যালোচনা মানুষের মুখে মুখে যুগ যুগ ধরে উচ্চারিত হয়ে আসছে, যাদের সুদূর প্রসারী চিন্তা-চেতনা, ভাব-ভাবনায় পরবর্তী প্রজন্ম অমূল্য কিছু পেয়ে থাকে, যাদের কথায় কাজে সুন্নাতী আমেজের সুঘ্রাণ ঝরে, ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া হিসেবে যাদের মানুষ শ্রদ্ধা করে, তেমনই একজন খাঁটি আবেদ হলেন হযরত শায়খে দলইরগাঁও হুজুর রাহ.।
কোন মানুষ আজীবন বেঁচে থাকেনি। বেঁচে থাকবার চাইলেও পারবে না। কেননা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘কুল্লু নাফসিন যা ইক্বাতুল মাউত’ প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে মহান মাওলার সান্নিধ্যে। তাঁর ডাকে একদিন সাড়া দিতেই হবে। কেউ রেহাই পায়নি; রেহাই পাবে না। এটাই চরম বাস্তবতা। প্রতিটি মানবই মৃত্যুর পরেও যুগ যুগ বেঁচে যাকে তার সৃষ্টিশীল কর্মের মধ্যে। বয়সের মধ্যে নয়। কর্মেই ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ পায়। আদর্শবান এই সব মহা মনীষীদের ত্যাগ, সংগ্রাম, কর্ম ও সাধনা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুস্মরণীয় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। সুন্নাতে নববীর বাস্তব নমুনা হিসেবে সমাজে তাদের পেশ করা হয়। তাদের জীবনালোচনায় পরবর্তীরা সঠিক পথে এগিয়ে যাবার দিশা পায়। এসবেরই বাস্তব প্রতিকৃত হলেন হযরত শায়খে দলইরগাঁও হুজুর রাহ.।
তিনি চলে গেলেন। না ফেরার দেশে। হাসতে হাসতে। তিনি হাসলেন আর কাঁদলো জগৎবাসী। অঝোর ধারায় কেঁদে উঠল আকাশ-ভুমি। সেদিন আকাশ এভাবে কেঁদে উঠবে, এর পূর্বাভাস ছিল না। কিন্তু কাঁদল, কাঁদল একই সঙ্গে বাংলাদেশের উপরে ছাদ হয়ে থাকা পুরো আকাশ। কাঁদল অজস্র মানুষ। কারণ, তিনি ছিলেন একাধারে একজন খ্যাতিমান হাক্কানি আলেম, ছিলেন শায়খুল হাদিস। ছিলেন একজন আপাদমস্তক আবেদ। ছিলেন মুত্তাকি।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন আকাবির আসলাফের রেখে যাওয়া আমানত জমিয়তের অন্যতম দিকনির্দেশক, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা জমিয়তের আজীবন সভাপতি। এত বড় বুযুর্গ হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে সর্বদা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তা প্রকাশ পেয়ে যায় ইন্তেকালের পর। সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে তার জানাযায়।
তিনি এখন আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। বেঁচে আছে বর্ণাঢ্য জীবনেতিহাস। আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর কর্মময় আল্লাহওয়ালা জীবনের সোনালী অধ্যায়। আজ এর সব কিছুই শুধু স্মৃতি। স্মৃতি আর স্মৃতি। তিনি চলে গেলেও রেখে গেছেন তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের ছাপ, মহব্বতের অনুপম লক্ষণ। আজীবন খেদমত করে গেছেন দ্বীনের তরে। হাজারো তালেবকে ঝপিয়েছেন ওয়াবিহী কালা হাদ্দাছানা…। তাঁর এসব মহান কীর্তি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- তিনি মরেও অমর। তিনি দুনিয়াতে বেঁচে নেই, কিন্তু বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে।
রাব্বে কারীম যেনো তাঁকে জান্নাতের সুউচ্চ মাক্বাম দান করেন। আমীন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।