অনলাইন ডেস্ক : হাতে কলম আর টেবিলে রাখা সাদা কাগজে চেয়ারে বসে লেখা পত্র গুলো আজ উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এবং কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে। আসলে এটাই বাস্তব, এই সময়টাই যে কবিতা, চিঠি, আবেদন কিংবা পত্রিকা অফিসে সংবাদ পাঠানোর জন্য এখন আর কাগজ-কলম নয়, এর ব্যবহারটা এখন কম্পিউটারের মাধ্যমে ইন্টারনেট, এসএমএস, ই-মেইলসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিতে আদান-প্রদান চলছে। অবশ্য চিঠি লেখার সময়ই বা কোথায়? মুঠোফোন, ইন্টারনেট, চ্যাট, ই-মেইল, এসএমএস এবং ফেসবুকের গতির ধাক্কায় কাগজ-কলমে হাতে এখন আর লেখা হয় না। সময়সাপেক্ষ বলে এ যুগে আর খাপ খাইছে না। যে কারণে ‘নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন, নাইরে টেলিগ্রাম,বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পৌঁছাইতাম’ গানগুলোও যেন তার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলছে। একসময় বাবার কাছে টাকা চেয়ে পুত্রের চিঠির যে আবেদন ছিলো, তা এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়ের কাছে অজানাই থেকে যাচ্ছে। পুত্রের কাছে মায়ের একটা চিঠি কিংবা মায়ের কাছে পুত্রের একটা চিঠির কী আবেদন তা বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির আলোয় বেড়ে ওঠা একটি ছেলে বা মেয়ের অনুভূতিতে কখনোই স্পর্শ করবে না। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমরা যখন অভ্যস্ত ছিলাম না তখন চিঠিই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো, এই চিঠিই কখনও বিনোদনের খোড়াক যোগাত, কখনও ব্যথাতুর হৃদয়ে কান্না ঝরাতো, কখনও উৎফুল্ল করত, কখনও করত আবেগে আপ্লুত কী যে সেই অদ্ভুত টান কালি ও কাগজে লেখা চিঠিতে।
কিছু কিছু চিঠি বারবার খুলে পড়ে আবার ভাঁজ করে রাখতে রাখতে ভাঁজের অংশগুলোই ছিঁড়ে যেত। বিশেষ করে প্রেমের চিঠি, চিঠি পাওয়ার আকুলতা কিংবা চিঠি পড়ার আনন্দ সব ইন্টারনেটের এ যুগে কাগজ-কলমে লেখা চিঠির প্রচলন অনেক কমে গেলেও তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। অনেক অফিসিয়াল চিঠি এখনও প্রতিদিন ডাক বিভাগের মাধ্যমেই আসে। তবে প্রযুক্তির ছোঁয়া ডাক বিভাগেও লেগেছে। ফেসবুক টুইটার কিংবা মেইলে চিঠি বা তথ্যের আদান-প্রদান যত দ্রত হোক না কেন কাগজে লেখা চিঠির সেই আবেগময়তা যেন আজও ভুলবার নয়।বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে নিত্য নুতন সব প্রযুক্তি। আজ পকেটে পকেটে মোবাইলফোন। নিমিষেই প্রিয়জনের কাছে পৌঁছে যায় হৃদয়ের কথা। কাগজে চিঠি লিখে আবার তার জবাবের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকা সেই সময়টুকুও আজ হারিয়ে গেছে। আগের দৃশ্যটা কেমন ছিলো। একটা সময় ছিল একটি কাগজে চিঠি লিখে তার জবাব পাবার জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রিয় মানুষকে। চাতক পাখির মত পথের পানে চেয়ে থাকতে হয়েছে। কখন আসবে সেই চিঠি! কখন ডাক পিয়ন জোরে দরাজ কণ্ঠে বলবে চিঠি এসেছে চিঠি, বাড়িতে কে আছেন? প্রিয় মানুষের কাগজে লেখা খামে ভর্তি চিঠি হাতে পেয়ে খুশিতে একেবারে আটখানা।
আজ নিজের স্ট্যাটাস বাড়ানোর জন্য, যোগাযোগের জন্য কিংবা বন্ধু খোঁজার জন্য কত না প্রযুক্তি। আজ পত্র মিতালি গাইডের মাধ্যমে বন্ধু খোঁজার দরকার নেই। মার্ক জুকারবার্গ হয়তো বিষয়টি বুঝতে পেরেই ফেসবুক বানিয়েছেন। তারপরও একসময় মার্জিন টানা কাগজে বলপেন কিংবা রেডলিপ কলম দিয়ে লেখা একটি চিঠির আনন্দই ছিলো আলাদা। চেয়ার-টেবিলে বসে হাতে কলম আর সাদা কাগজে চিঠি লেখার শুরুতে ভাষা হতো এমন- এলাহী ভরসা। পাকজনাবেষু ভাইজান, আমার শত কোটি সালাম গ্রহণ করিবেন। সকলকেই আমার সালাম ও ভালবাসা পৌঁছাইয়া দিবেন। পর সমাচার এই যে… ফিরতি ডাকে পত্রের উত্তর দিবেন। বি.দ্র. গত বছর হাটে কেনা গাই গরুটির বকনা বাছুর বিয়াইছে। প্রতিদিন চারসের করিয়া দুধ দিতেছে। সাধু ভাষায় লিখিত এইসব কাগজের চিঠি প্রবীণদের কাছে আজ শুধুই স্মৃতি। প্রজন্মের কাছে অনেকটাই বিস্ময়। তারা বিশ্বাসই করতে চায় না, এভাবে কাগজে চিঠি লেখা হতো। সেদিনের চিঠির ভাষায় শ্রদ্ধেয়দের ‘আমার কদমবুচি গ্রহণ করিবেন’ বাক্যে কদমবুচি শব্দের অর্থ (পায়ে ছুঁয়ে সালাম করা) অনেকেই জানে না। একটা সময় সাদা অথবা রঙিন কাগজে কালির কলম (দোয়াতের কালি কলমে ভরে) দিয়ে লেখা চিঠি ডাকঘরের (পোস্ট অফিস) হলুদ খামে ভরে ঠিকানা লিখে ডাকবাক্সে ফেলে দিলে দূরত্ব অনুযায়ী দিন কয়েক পরে গন্তব্যে পৌঁছত। চিঠির প্রাপক একইভাবে উত্তর দিতেন। পরিবার, অফিস ও প্রতিষ্ঠান তথা মানুষে মানুষে যোগাযোগের মাধ্যম এই চিঠি জীবনের নানা বিষয় তুলে ধরত। কাগজে চিঠি লেখার বাক্য চয়ন, ভাষার প্রায়োগিক ব্যবহার, চিঠির কথা সব মিলিয়ে চিঠির নান্দনিকতায় স্নেহ ভালবাসার পূর্ণতায় এক অপার মমত্ত¡ উঠে আসত। হাতের লেখা একটি চিঠি হৃদয়ের শত সহস্র কথাই শুধু বলতনা, আবেগ আকুলতা ও ব্যাকুলতা সবই প্রকাশ পেত। মা-বাবা যখন সন্তনের হাতের লেখা চিঠি পড়তেন, তখন লেখার মধ্যে হৃদয় দিয়ে সন্তানের মুখ দেখতে পেতেন। অবচেতনে চিঠি বুকে জড়িয়ে আদর দিতেন। প্রণয়ের চিঠি তো ছিল একেকটি প্রেমের হতিহাস। প্রেমিক-প্রেমিকা হৃদয়ের আকুলতা-ব্যাকুলতা প্রতীক্ষার প্রহরের খুঁটিনাটি ভাষার মাধুর্যে এমনভাবে লিখত, যা পড়ে মনে হতো শত ফুল দিয়ে গাঁথা একটি গল্প বা উপন্যাস।
প্রণয়ের কাগজে চিঠি লিখতে কত পাতা যে ভরে যেত, তার কোন সীমারেখা থাকত না। বেশি পাতার চিঠি হলে খামের ওপর বাড়তি টিকিট লাগাতে হতো। বাড়তি মাশুল না দিলে প্রাপককে তা পরিশোধ করতে হতো। খামের ওপর অর্ধচন্দ্রের সিলমোহর আঁটা এই চিঠিকে বলা হতো বেয়ারিং। হাতে লেখা চিঠি পরিবারের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক ও ভালবাসায় গভীরতার সেতু গড়ে দিত। পোস্ট অফিসের খাকি বুশ শার্ট পোশাকের পিয়ন দরজায় কড়া নেড়ে যখন উচ্চস্বরে হাঁক দিত চি…ঠি, তখন কে আগে ছুটে গিয়ে চিঠিটি নেবে, এমন ছোটখাটো দৌড় প্রতিযোগিতা হয়ে যেত। দীর্ঘদিন পিয়নের এমন হাঁকডাক না শুনলে অর্থাৎ চিঠি না এলে মনে নানা ভাবনার উদয় হতো। প্রণয়ের চিঠি তো ছিল তারুণ্যের উচ্ছাস। হৃদয়ের আবেগের এক মধুময় পাঠশালা। যেখানে লেখার সঙ্গে মিশে থাকত সৃষ্টিশীল ভাবনার প্রকাশ। ভাষা ও জ্ঞানের কত শৈলি দিয়ে একে অপরের (প্রেমিক-প্রেমিকা) হৃদয়ের কত গভীরে পৌঁছা যায়, তার প্রতিযোগিতা শুরু দেখা। চিঠি পাঠানোর সময় কখনও কাগজের ভাঁজে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দেয়া, কখনও পারফিউমের দুই এক ফোঁটা ফেলে সুগন্ধী করা ছিল বাড়তি অনুভূতির বিষয়। প্রেমের এই চিঠি আদান-প্রদানও ছিল এ্যাডভেঞ্চারাস। লুকিয়ে চিঠি লিখে তা খামে ভরে পোস্ট অফিসের বাক্সে ফেলার পর শুরু হতো ফিরতি চিঠির প্রহর গোনা। এই ক্ষেত্রে পিয়ন ছিল প্রণয় গভীর করে দেয়ার অনুঘটক। প্রেমিক-প্রেমিকা উভয়ই সুসম্পর্ক রাখত পিয়নের সঙ্গে। হাতের লেখা চিনিয়ে দিত পিয়নকে। খামের ওপর ঠিকানায় এমন লেখা থাকলে তা যেন অভিভাবকের হাতে না পড়ে তার ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ ব্যবস্থা ছিল। এভাবে অনেক সফল প্রণয়ের নীরব স্বাক্ষী হয়ে থাকত ডাকপিয়ন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় তারাও নিমন্ত্রণ পেত। প্রেম উপাখ্যানে এতদিন যে পিয়ন প্রণয়ের মানুষদের কাছ থেকে বখশিশ পেত অনুষ্ঠানে তার ছিল উপহার দেয়ার পালা। প্রণয়ের সফল মানুষদের আশীর্বাদ করতে গিয়ে কত পিয়নের চোখে আনন্দের জল গড়িয়ে পড়েছে।আবার প্রেমের ব্যর্থতায় ব্যথিত হয়েছে। পরিবারের চিঠিই হোক আর প্রেমের চিঠি হোক, যে চিঠি যত নান্দনিকতার সৃষ্টিতে লেখা তা কতবার যে পড়া হতো! কোন চিঠি পড়ে হৃদয় জুড়িয়ে যেত। কোন চিঠি পড়ে আনন্দে মুখ হাসি ফুটত। আবার কোন চিঠি পড়ে চোখের জলও গড়িয়ে পড়ত। পারিবারিক চিঠিগুলো অনেক সময় খবরের কাগজের বিকল্প হিসাবে কাজ করত।
কোন চিঠিতে গ্রামের কোন ঘটনা, আবাদের খবর, প্রকৃতিক দুর্যোগের খবরসহ নানা খবর লেখা থাকত। আগের দিনে কোন চিঠি ফেলে দেয়া হয়নি। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সাইকেলের স্পোকের মাথায় বড়শির মতো করে তার মধ্যে গেঁথে রাখা হতো। অনেক চিঠি ছিল নীরব স্বাক্ষী। বাজারে রাইটিং প্যাড (চিঠি লেখার প্যাড) মিলত। বনেদী বাড়িতে টেবিলে এই প্যাড থাকত। বিদেশে চিঠি পাঠাতে বিশেষ ধরনের নীল রঙের এয়ার মেইল পার এ্যাভয়েন ছাপাঙ্কিত খাম পাওয়া যেত। অনেক সময় নীল কাগজে ও খামে লেখা চিঠি ছিল প্রেমের চিঠির প্রতীক। পোস্ট অফিসের এসব চিঠিকে
ঘিরেই এসেছে সভ্যতা। ডাকঘরের এই চিঠির দিন আজ ফুরিয়ে গেছে। সভ্যতার অগ্রযাত্রায় চিঠির বদলে এসেছে কম্পিউটারে ই-মেইল, সেল ফোনের ক্ষুদে বার্তা (শর্ট মেসেজ), সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস হোয়াটস অন ইউর মাইন্ড বক্সে লিখা। বর্তমানে কুরিয়ার সার্ভিসে যে চিঠি আদান প্রদান হয় তার বেশিরভাগই প্রাতিষ্ঠানিক ও অফিসিয়াল। সেদিনের ও আজকের চিঠি সবই চিঠি। তবে কোন চিঠিতে প্রাণের আকুলতা কতটুকু তাই প্রশ্ন! বর্তমানে যার কাছে আমরা চিঠি লিখতে চাই তাকে স্কাইপি বা ভাইবারের মাধ্যমে কম্পিউটারের মনিটরে দেখে কথা বলা যায়। সেল ফোনে সরাসরি কথা বলা যায়। ক্ষুদে বার্তায় অতি সংক্ষেপে তাহলে চিঠির মতোই বইও কী পাঠকের কাছ থেকে হারিয়ে যেতে চলেছে। একসময় প্রিন্টেড বইয়ের চাহিদা তুঙ্গে থাকলেও এখন বেশিরভাগ পাঠকই ই-বুক কিংবা পিডিএফ ফরম্যাটের বই পড়ছেন। এজন্য নির্দিষ্ট কিছু ই-বুকের ওয়েবসাইটে গিয়ে বইয়ের নাম লিখলেই পাওয়া যাচ্ছে প্রিয় লেখকের জনপ্রিয় সব বই। আর তাই তো দিন দিনই প্রিন্টেড বইয়ের বিক্রি কমার সাথে সাথে অনলাইনে বই পড়ার পাঠক বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবেই প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এবং কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে কাগজ-কলমের লেখা। সূত্র. অনলাইন।
ইআম