|
শুক্রবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানটি টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম। খুবই সুন্দর অনুষ্ঠান। খরচ হয়েছে ২০ কোটি ডলার। এর আগের কয়েকজন প্রেসিডেন্টের যেমন বড় বুশ, বিল ক্লিনটন, ছোট বুশ ও বারাক ওবামার ক্ষমতা গ্রহণের অনুষ্ঠানও দেখেছি, তবে তত মনোযোগ দিয়ে নয়, যতটা মনোযোগ দিয়ে দেখেছি মিস্টার ট্রাম্পের অভিষেক।
খ্রিষ্টধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হওয়ায় আরও ভালো লাগল। খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত দেশ বলেই নয়, খ্রিষ্টানপ্রধান দেশ দুনিয়ায় আরও আছে, কিন্তু আমেরিকার জনগণের গড ও যিশুখ্রিষ্টে অবিচল আস্থা। তাদের ভাষায়: ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’। পৃথিবীর অনেক দেশের মতো সাংঘাতিক সেক্যুলার-কাম-রাষ্ট্রধর্মের দেশ তাদের নয়। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মতো ধর্ম তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই অভিষেকের আগে ট্রাম্প সাহেব ও তাঁর রানি মেলানিয়া গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করেছেন। (অভিষেকের পরে অবশ্য তিনটি বল ড্যান্স কনসার্টের আয়োজন ছিল, তাতে দম্পতিরা নেচেছেন এবং মি. ট্রাম্প রূপসী মেলানিয়াকে দীর্ঘস্থায়ী চুম্বনে তাঁর প্রগাঢ় ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।) হোয়াইট হাউসে গিয়ে তাঁরা বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডির সঙ্গে চা বা কফি খেয়েছেন। ইসায়ী ধর্মের বিভিন্ন শাখা ক্যাথলিক, লুথারিয়ান, প্রটেস্ট্যান্ট গির্জার ধর্মযাজকেরা ও র্যাবাই (ইহুদি-ধর্মযাজক) এলেন এবং তাঁরা তাঁদের বাণী পাঠ করলেন। তাঁদের বাণীতে বারবার গড (ঈশ্বর) এবং যিশুখ্রিষ্টের নাম উচ্চারিত হলো। তারপর নতুন প্রেসিডেন্টকে প্রধান বিচারপতি শপথবাক্য পাঠ করান। তাঁর এক হাত উত্তোলিত, আরেক হাত পবিত্র বাইবেলের ওপর রাখা। একটি ট্রেতে সে বাইবেল ধরে ছিলেন মিসেস মেলানিয়া।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সরকারি পদ গ্রহণের জন্য কোনো ধর্মপালনের বিধান নেই, তবু অধিকাংশ প্রেসিডেন্ট গির্জায় যান। তা তিনি সেখানে গিয়ে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করুন বা না করুন। বারাক হোসেন ওবামাও গিয়েছেন।
কল্পনা করুন, পৃথিবীর মানুষের যে মনস্তত্ত্ব, তাতে কোনো উন্নয়নশীল দেশের, বিশেষ করে কোনো মুসলমানপ্রধান দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে শপথ নেবেন। তার আগে তিনি দেশের জাতীয় মসজিদে গিয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করলেন। তারপর গেলেন শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। সুন্নি, শিয়া বা অন্য কোনো মাজহাবের ইমামরা এলেন এবং তাঁরা তাঁদের আশীর্বাণী পাঠ করলেন। সব শেষে কোরআনের ওপর হাত রেখে সর্বশক্তিমান আল্লাহর (গড) নামে শপথ নিলেন। ওই দেশ ও ওই রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রীকে নির্ঘাৎ মুসলিম মৌলবাদী বলে আখ্যায়িত করত পশ্চিমের বস্তুনিষ্ঠ মিডিয়া।
গণতন্ত্র ইউরোপের কোনো কোনো দেশে ছিল রাজতন্ত্রের সঙ্গে মিলেমিশে, কিন্তু গত প্রায় আড়াই শ বছর যাবৎ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। সেই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সে দেশের প্রতিষ্ঠাতারা স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। এবং তাঁদের সঙ্গে মার্কিন দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের ভূমিকাও বিরাট। জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসন, জেমস ম্যাডিসন, আব্রাহাম লিংকন, থিওডোর রুজভেল্ট, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, ডি ডি আইজেনহাওয়ার, জন এফ কেনেডি প্রমুখ আমেরিকার উন্নতিতে ও গণতন্ত্র
প্রতিষ্ঠায় অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের সঙ্গে চার্লস পিয়ার্স, উইলিয়াম জেমস, যোশিয়া রয়েস, জর্জ সান্তায়ানা, জন ডিউই, আলফ্রেড হোয়াইটহেড প্রমুখ দার্শনিক ও ভাবুকেরা জাতির একটি দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়ে গেছেন। আমেরিকাকে পৃথিবীতে এক নম্বর বানাতে কোনো ধনকুবেরের চেয়ে তাঁদের এবং বিজ্ঞানী-শিক্ষাবিদদের ভূমিকাই প্রধান। পুঁজিবাদী সমাজে ধনকুবেরদের একটা ভূমিকা তো থাকেই।
শুধু আমেরিকার নয়, যেকোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের অভিষেক অনুষ্ঠান অবশ্যই আনন্দের বিষয়। কিন্তু ট্রাম্প যখন দায়িত্ব বুঝে নেন তখন তাঁর দেশে এবং পৃথিবীর অনেক দেশে তাঁর বিরুদ্ধে উত্তাল বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্তত ৬০টি দেশে নারীসমাজ রাজপথে নেমেছে বিচিত্র প্ল্যাকার্ড বহন করে এবং স্লোগান দিতে দিতে। যাঁর আশীর্বাদ আবশ্যক, সেই মাননীয় রোমান ক্যাথলিক পোপ পর্যন্ত আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন: দুনিয়া কি একুশ শতকের হিটলারকে দেখতে যাচ্ছে?
নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই মি. ট্রাম্পের কথাবার্তা ও অঙ্গভঙ্গি জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে বিশ্বব্যাপী বহু মানুষের অন্তরের গভীরতম স্থানে আঘাত করেছে। শতাধিক বছর ধরে পৃথিবীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নারী ও পুরুষ নারীর অধিকার ও মর্যাদার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন শত শত বছরের পুরুষতান্ত্রিকতার প্রাধান্য কমাতে। সেই নারী জাতিকেও তিনি অসম্মান করেছেন। মার্টিন লুথার কিং জুলিয়ারের ছিল একটা ড্রিম—স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মাধ্যমে আংশিক পূরণ হয়েছে। মি. ট্রাম্প বাকি অংশ নস্যাৎ করে দিলেন। তাঁর ১৫ সদস্যের মন্ত্রিপরিষদে মাত্র একজন কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিন বংশোদ্ভূত কারও স্থান হয়নি।
নির্বাচনের আগে মি. ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন ভারত ও হিন্দুদের তিনি ভালোবাসেন। কিন্তু নির্বাচিত হয়ে টেলিফোনে কথা বলেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও তাইওয়ানের সরকারপ্রধানের সঙ্গে। চীনের চেয়ে তাইওয়ান তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অর্থ চীনের নেতাদের বোঝার ক্ষমতা যথেষ্ট।
হিন্দুপ্রধান ভারত একটি বহু জাতি ও বহু ধর্মাবলম্বীর বাসভূমি। ভারত একটি মহান সভ্যতা। ভারতের ইতিহাস-ঐতিহ্য আমেরিকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের চেয়ে হাজার গুণ পুরোনো। সেখানে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং হিন্দুদেরই প্রাধান্য। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে এখনো ভারত একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র’। সেখানে রাষ্ট্রপতি থেকে রাষ্ট্রের যেকোনো পদে অহিন্দুদের নিযুক্তিতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু মি. ট্রাম্প হতে চান শুধু ভারতের হিন্দুদের বন্ধু—ভারতের বৌদ্ধদের নয়, পার্সিদের নয়, আহমদিয়াদের নয়, শিখদের নয়, বাহাইদের নয় এবং শুধু ভারতের কেন, কোনো মুসলমানের তো নয়ই। তাঁর এই উক্তি পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো রাষ্ট্রনায়কের সবচেয়ে সাম্প্রদায়িক উচ্চারণ।
আগামীকাল যদি চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, আমি শুধু বাংলাদেশের মুসলমানদের বড় বন্ধু। চীনের ব্যবসা-বাণিজ্য বাংলাদেশের মুসলমানরাই বেশি পাবেন। রাশিয়ার পুতিন যদি বলেন, আমরা বাংলাদেশের মুসলমানদের বন্ধু, তা হবে বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি অপমান। কারণ, তা বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদের প্রতি চরম অবজ্ঞার শামিল।
ট্রাম্প সাহেব খুবই বুদ্ধিমান। তিনি রাশিয়ার প্রশংসা করে বৌদ্ধপ্রধান চীনকে চাপে রাখতে চান, মুসলমানদের নিন্দা করে হিন্দুপ্রধান ভারতকে প্রীত করতে চান। তিনি তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে ইসলামি জঙ্গিদের নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছেন। পৃথিবীর পনেরো আনা মুসলমানও চায় ইসলামি জঙ্গিরা নির্মূল হোক, আইএস ও আল-কায়েদা নির্মূল হোক। কিন্তু তাদের নির্মূল করার ষোলো আনা দায় বিধাতা তাঁকেই দিয়েছেন, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
মুসলমানদের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী মধ্যপ্রাচ্যে কী কারণে টেররিস্ট হয়েছে, তা ট্রাম্প সাহেবের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। তিনি পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় বাদ দিয়ে চাইছেন ইসরায়েলে তাঁর দেশের দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে নেবেন। জেরুজালেম মুসলমানদের পবিত্র স্থান। সেখানে কি ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, চীনের দূতাবাস আছে? এই দূতাবাস সরানোর ঘোষণার কী অর্থ, তা তাঁর অবশ্যই জানা আছে।
সারা দুনিয়ার মানুষের কপালে যা ঘটবে, আমাদেরও তা–ই হবে। তাই বেশি ভাবার কিছু নেই। মনে হয়, হালকা থেকে মাঝারি ধরনের জঙ্গিবাদ আমাদের সরকারের জন্য সুবিধাজনক। পশ্চিমা দুনিয়া তা-ই চায়। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই বলছেন বাংলাদেশে আইএস বা আল-কায়েদা নেই; সাধারণ মানুষেরও তা-ই ধারণা, কিন্তু আমেরিকা বলতে চাইছে, তারা আকছার আছে। এর মধ্যে কিছুদিন আগে ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দুকে তথ্যমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে ৮ হাজার আল-কায়েদা জঙ্গি আছে। ৮ হাজার বা ৮০০ খুব বেশি সংখ্যা, যদি বাংলাদেশে দুই-এক শ আল-কায়েদার জঙ্গি থাকত, তাহলে জনগণ ও সরকার অবশ্যই টের পেত।
বাংলাদেশ তার তৈরি পোশাকসহ পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা বা জিএসপি নিয়ে এমনিতেই মুশকিলে আছে। দর-কষাকষির ক্ষমতা আমাদের ব্যবসায়ী নেতা ও আমলাদের পর্যাপ্ত নেই। ট্রাম্প প্রশাসন যে দয়াপরবশ হয়ে বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা দেবে, সে আশা দুরাশা। অথচ আমাদের রপ্তানি পণ্যের জন্য তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার ওপর যদি আল-কায়েদা বা আইএস নিয়ে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তাহলে বিপদের আশঙ্কা।
আমেরিকা শুধু ফার্স্ট নয়, যদি ফার্স্টতরও হয়, তাতে আমাদের ঈর্ষার কারণ নেই। কারণ, আমরা তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারব না। আমাদের রোল নম্বর দুই নয়, তিন অঙ্কের ঘরে। সম্পদে, সামরিক অস্ত্রে, জ্ঞানে যে জাতি বড়, তাকেই মানুষ বড় বলে। ওসবের অগ্রগতিতেই বড় বা এক নম্বর হওয়া যায়।
কোনো জাতির সমৃদ্ধি ও সভ্যতা চিরকাল এক রকম থাকে না। একটি সময় তা চূড়া স্পর্শ করে। তারপর শুরু তার পতনের। পতন শুরু হওয়ার পরও ২০, ৫০ বছর এক রকম থাকে, ভেতরে-ভেতরে ক্ষয় হয়ে গেলেও। তবে শাসকদের কারও না কারও হাতে পতনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। তুরস্কের ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে, যার শুরু আওরঙ্গজেব থেকে। একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যেত না। উদার ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক ছাড়া কোনো হঠকারী সংকীর্ণচেতা শাসক কোনো জাতিকে উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে না, ধ্বংসের সূচনা করতে পারে মাত্র।
আমাদের প্রাচ্যের, বিশেষ করে ভারতবর্ষের নীতি সবার সঙ্গে ঐক্য ও সম্প্রীতি। আমরা মানুষে মানুষে অবিশ্বাস, ঘৃণা, বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্র, ভীতি প্রদর্শন অপছন্দ করি। আমেরিকায় ট্রাম্প সাহেব ছাড়া আরও মানুষ আছেন। তাঁদের শুভবুদ্ধি আছে বলে জানি। যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোও শক্তিশালী। রাজনীতিকদের অনেকের দেশপ্রেম ও কাণ্ডজ্ঞান অসামান্য। মার্কিন কংগ্রেসের অনেক সদস্য তাই ট্রাম্পের অভিষেকে যোগ দেননি। সেখানকার পোশাক ডিজাইনারদের প্রায় কেউই মিসেস ট্রাম্পের পোশাকের নকশা করতে সম্মত হননি। তাই আশা করি কোনো ব্যক্তিবিশেষ পৃথিবীকে অস্থিতিশীল করতে পারবেন না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।