বিগত প্রায় দুই দশক ধরে আলেম উলামা ও সমগ্র কওমি মাদরাসার ছাত্রসমাজ সনদের স্বীকৃতির জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। দেশের ধার্মিক জনগোষ্ঠী স্বীকৃতি দানের পক্ষে। এ লক্ষ্যে বেফাকুল মাদারিস বা কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডও নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে আসছে। তাই বলা যায়, এ দাবিটি দেশের ধার্মিক জনতার দাবিতে পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া এটি একটি যৌক্তিক ও সঙ্গত দাবি, যা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।
বাংলাদেশের জনগণের ধর্মীয় চাহিদা যেমন মসজিদ পরিচালনা, নামাজ পড়ানো, খুতবা দেয়া, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা, বিয়ে পড়ানো, জানাজা পরিচালনা, ওয়াজ নসিহতসহ যাবতীয় ধর্মীয় কাজ সম্পাদন মূলত দেশের আলেম সমাজের ওপর নির্ভরশীল। এসব আলেম তৈরির প্রধান মাধ্যম হচ্ছে কওমি মাদরাসাগুলো। এককথায় দেশের ধর্মীয় চাহিদা তারা পূরণ করছেন। অথচ তাদের শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতি নেই, এটি সত্যিই দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক।
দেশকে নিরক্ষরতা মুক্ত করা সরকারের একটি অন্যতম কর্মসূচি। এ ক্ষেত্রে কওমি মাদরাসাব্যবস্থা বিপুল অবদান রাখছে। তারা সরকারি কর্মকাণ্ডের বাইরে থেকেও লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর নিরক্ষরতা দূর করছে।
দেশের স্বনামধন্য ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যারা আছেন তাদের প্রায় বেশির ভাগই কওমি মাদরাসা শিক্ষিত। যেসব ব্যক্তিত্ব দেশের মানুষের ধর্মীয় উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, যারা মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নয়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন, যাদের অবদানের কারণে আমাদের সমাজে ইসলাম এক অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে তাদের প্রধান অংশ যে শিক্ষায় শিক্ষিত তার সরকারি স্বীকৃতি একটি অনিবার্য বাস্তবতা। কেননা, দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের সমাজে এ শিক্ষা স্বীকৃত ও গৃহীত। তাই তাকে অস্বীকার করা বা স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করার কোনো কারণ নেই। সরকারি স্বীকৃতি মানে দীর্ঘ দিন ধরে সামাজিকভাবে স্বীকৃত ও গৃহীত একটি ব্যবস্থাকে সরকারিভাবে মেনে নেয়া মাত্র। এটি আগেই করা দরকার ছিল।
এ শিক্ষাব্যবস্থায় কুরআন, হাদিস, আকাঈদ ও ফিকাহর ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং এ ব্যাপারে ব্যাপক শিক্ষা দেয়া হয়, যা সমমানের যেকোনো ব্যবস্থার চেয়ে উন্নত। কওমি মাদরাসার মূল লক্ষ্য হচ্ছে কুরআন, হাদিস, আকাঈদ ও ফিকাহর জ্ঞানে ব্যুৎপত্তি অর্জন। এ বিষয়গুলো ইসলাম ধর্মেরও মূল। এ বিষয়গুলো কওমি মাদরাসায় সর্বাধিক গুরুত্ব ও যতœসহকারে পড়ানো হয়। এসব বিষয়ে এখানে যে মানের শিক্ষা দেয়া হয় তা অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে উন্নতমানের। কাজেই অন্য সব শিক্ষা যেখানে স্বীকৃত সেখানে কওমি শিক্ষাব্যবস্থা স্বীকৃতি না দেয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
আমাদের কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা যারা কোনো না কোনোভাবে বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিয়াত বা আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে সেখানে তারা কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। অথচ সনদের সরকারি স্বীকৃতি না থাকাতে তাদের ওই সব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে সাধারণভাবে সমস্যা হচ্ছে।
ধর্মই আমাদের নৈতিকতার ভিত্তি। নৈতিক অবক্ষয়ের এ যুগে কওমি শিক্ষাব্যবস্থা তরুণদের চরিত্র গঠনে সর্বাধিক ভূমিকা রাখছে। যে শিক্ষাব্যবস্থা সমাজের নৈতিক ভিত্তি নির্মাণে সর্বাধিক কার্যকর সে শিক্ষাকে স্বীকৃতি না দেয়া সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলার নামান্তর।
এ শিক্ষা গুটিকয়েক ছাত্রদের মধ্যে সীমিত নয়। এ শিক্ষার অধীনে দেশের প্রায় ২০ লাখ ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত। প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষক এ কাজে নিয়োজিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় ১২ হাজারের মতো। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতিবঞ্চিত করে সমাজের অগ্রগতি ও উন্নয়নের চিন্তা অবাস্তব। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বার্থে তাদের স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন এবং তাদের দেশের উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। তদুপরি তাদের শিক্ষার মূল ধারার বাইরে রাখলে সমাজ অভ্যন্তরীণ দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়।
কওমি মাদরাসা মূলত একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা। সমাজের মূল ঐতিহ্য ধারণ, সংরক্ষণ ও বিকাশ দানে এ শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠীর শিকড়ের সাথে যে শিক্ষাব্যবস্থার সংযোগ রয়েছে তাকে স্বীকৃতি না দেয়া মূলত শিকড়কে অস্বীকার করার নামান্তর। দীর্ঘকাল ধরে এ শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের সমাজের চাহিদা মিটিয়ে আসছে। তাই সেই শিক্ষাকে অস্বীকার করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, সংস্কৃতি, মিডিয়াসহ সর্বক্ষেত্রেই আলেম সমাজকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ তাদের শিক্ষাকে স্বীকৃতি দান না করা। এসব ক্ষেত্রে আলেম সমাজের ইতিবাচক ভূমিকা ও অবদান রাখার জন্য কওমি মাদরাসার স্বীকৃতিদান অপরিহার্য। সমাজের মূল ধারায় আলেম সমাজকে সম্পৃক্ত করার জন্য এ স্বীকৃতি অনিবার্য হয়ে পড়েছে। সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণীকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে তাদের মেধা, দক্ষতা, পরিশ্রমকে অমূল্যায়ন করা হয়। যেখানে সমাজের বহু পশ্চাৎপদ শ্রেণীকে টেনে তোলার জন্য কত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে সেখানে আলেম সমাজের শিক্ষাকে ন্যূনতম স্বীকৃতি থেকেও বঞ্চিত করা হবে যা মোটেই কাম্য নয়।
পাকিস্তানে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১৯৮২ সাল থেকে এ শিক্ষার সর্বোচ্চ সনদগুলোকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে এবং এরাবিক ও ইসলামিক স্টাডিজে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এম এ এরাবিক বা এম এ ইসলামিক স্টাডিজের সমমান হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। শিক্ষকতা ছাড়া অন্যান্য চাকরির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দুটো বিষয়ে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পরীক্ষায় অংশ নিলে তারা ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ের স্নাতক ডিগ্রির যোগ্যতা অর্জন করবে। তা ছাড়া ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ও মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে দেওবন্দের সনদকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হয়। কাজেই আমাদের দেশের কওমি মাদরাসা শিক্ষাকে স্বীকৃতি না দেয়ার কোনো কারণ নেই।
বর্তমানে বেফাকুল মাদারিসভুক্ত মাদরাসাগুলোতে মূল ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও সাধারণ বিষয় যেমন বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সমাজ, অর্থনীতি, পৌরনীতি ইত্যাদিও সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কাজেই যুগের চাহিদা পূরণেও এ শিক্ষা ভূমিকা রাখছে। যারা সাধারণ বিষয়াবলি মাদরাসায় না থাকার অজুহাতে স্বীকৃতিদানের বিপক্ষে তাদের যুক্তিও আজ আর গ্রহণযোগ্য নয়।
মনে রাখতে হবে যে কওমি মাদরাসাব্যবস্থা একটি বিশুদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা। ধর্ম পালনে যেমন স্বাধীনতা রয়েছে তেমনি ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়টিও স্বাধীন থাকতে হবে। বস্তুত এ শিক্ষাব্যবস্থা কোনো সরকারি স্বীকৃতির ওপর নির্ভরশীল নয়। এ শিক্ষাব্যবস্থা ও এ ব্যবস্থায় শিক্ষিত লোকেরা সমাজ দ্বারা স্বতঃই স্বীকৃত। কারণ তারা সমাজের ধর্মীয় প্রয়োজন মিটাচ্ছেন। কিন্তু বর্তমান যুগে যেহেতু সরকারিভাবে স্বীকৃত সনদ ছাড়া কোনো ধরনের চাকরি বা পেশার ক্ষেত্রে কোনো শিক্ষা সনদ গ্রহণযোগ্য নয়, এমনকি কোনো বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যও সরকার স্বীকৃত সনদের প্রয়োজন, তাই বাস্তব কারণেই কওমি মাদরাসা শিক্ষার সনদের দাবি উঠেছে। কওমি মাদরাসা ও কওমি ছাত্রের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দেশের মেধার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এ শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট। কাজেই জাতি গঠনের বহুমুখী কাজে এ মেধাকে কাজে লাগাতে হলেও এ শিক্ষার সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রয়োজন। তদুপরি প্রায় দেড় শ’ বছর ধরে প্রচলিত ও সমাজ দ্বারা স্বীকৃত কওমি মাদরাসা শিক্ষিত প্রতিটি ব্যক্তিরই তার শিক্ষার স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এটা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অধিকার। রাষ্ট্র্র তাকে সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।
উপরিউক্ত কারণে আমরা মনে করি দেশের কওমি মাদরাসার সনদকে সরকারি স্বীকৃতিদান অপরিহার্য। এটি শুধু একটি ছোট্ট গোষ্ঠীর দাবি নয়, এটি দেশের বৃহৎ ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর দাবি। বর্তমান সরকার স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে একমত হয়েছে। সে জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। তবে কওমি মাদরাসার সাথে সংশ্লিষ্টদের মনে এ আশঙ্কাও রয়েছে যে স্বীকৃতির নাম করে কওমি মাদরাসাগুলোয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও হস্তক্ষেপ শুরু হতে পারে। তাই এ আশঙ্কা যাতে না থাকে তারও নিশ্চয়তা দিতে হবে। মোটকথা সরকারি স্বীকৃতি অবশ্যই কওমি মাদরাসার স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণ্ন রেখেই দিতে হবে। স্বীকৃতির নামে কওমি মাদরাসাকে নিয়ন্ত্রণ করা ও কৌশলে এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও সিলেবাসকে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের চেষ্টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণের সাহায্য-সহযোগিতায়, ব্যক্তিগত দান-অনুদানে এসব মাদরাসা চলছে, সামনেও চলবে ইনশাআল্লাহ। কওমি মাদরাসাগুলো সরকারের কাছে কোনো নিয়মিত বা অনিয়মিত আর্থিক অনুদান চায় না, শুধু চায় তাদের সনদের স্বীকৃতি। কাজেই স্বীকৃতি যেমন দিতে হবে তেমনি তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য যাতে কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন না হয় সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। সাথে সাথে স্বীকৃতির নামে যাতে কওমি মাদরাসায় কোনো প্রকার সরকারি হস্তক্ষেপ করা না হয় সে বিষয়টিরও নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
এটাও পড়তে পারেন
কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ
খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...