|
প্রেসিডেন্ট ওবামা হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নেওয়ার আগে এক দীর্ঘ ‘প্রস্থানপত্র’ (বা এক্সিট মেমো) লিখেছেন। সেখানে তাঁর আট বছরের শাসনামলে যে ‘বিশাল সাফল্য’ অর্জিত হয়েছে বলে তিনি মনে করেন, তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, পরিবেশ ও নাগরিক অধিকার—এসব ক্ষেত্রে আট বছর আগে তিনি পরিবর্তনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার প্রতিটি পূরণ করেছেন বলে তিনি মনে করেন। (বিস্তারিত: http://bit. ly/2 hVBzWk)
কিন্তু এই পত্রে ওবামা বলেননি তাঁর এত সাফল্যের পর আমেরিকার জনগণ তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন ‘নির্বোধ’ ও ‘প্রতারক’ ব্যবসায়ীকে কেন বেছে নিলেন। ওবামা যে হিলারি ক্লিনটনকে তাঁর কেদারাখানা দিয়ে যেতে চান, সে ব্যাপারে কোনো রাখঢাক করেননি। তিনি দেশবাসীকে সানুনয় অনুরোধ করে বলেছিলেন: ‘আমি খুব, খুব চাই হিলারি আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোক।’
ট্রাম্পের বিজয় শুধু ওবামার সেই অনুরোধের প্রত্যাখ্যান নয়, গত আট বছর ওবামা যা যা করেছেন, তার প্রতি আমেরিকান ভোটারদের অনাস্থারও প্রকাশ। কারণ, ট্রাম্প প্রায় প্রতিটি প্রশ্নে ওবামার অনুসৃত নীতির উল্টো প্রস্তাব রেখেছিলেন, ওবামার সব অর্জন প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রথম দিন থেকেই বাতিল করা শুরু করবেন, এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অবশ্য যাঁদের আমরা আমেরিকার জনগণ বলছি, মোট সংখ্যার হিসাবে তাঁরা মোট ভোটারের অর্ধেকের কম। ট্রাম্প জিতেছেন ইলেকটোরাল ভোটের জোরে, মোট ভোটের হিসাবে নয়।
ওবামার এই আট বছরে তাঁর নিজের দল ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্র এক-এক করে খুইয়েছে। ওবামা নির্বাচিত হওয়ার দুই বছর পর ২০১০ সালে তারা খোয়ায় কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদ, তারপর ২০১২-তে সিনেট। অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যের আইন পরিষদ ও গভর্নরশিপও তারা ক্রমশ খোয়াতে থাকে। ২০১৬ সালের নির্বাচনের পর ডেমোক্রেটিক সিনেটরের সংখ্যা ৫৫ থেকে কমে ৪৬-এ দাঁড়িয়েছে, আর প্রতিনিধি পরিষদে ২৫৬ থেকে ১৯৪। ২০০৮ সালে ডেমোক্র্যাটরা যেখানে গভর্নরের দায়িত্ব পালন করতেন ২৮টি অঙ্গরাজ্যে, সেখানে গত বছরের নির্বাচনের পর তা দাঁড়িয়েছে ১৬টিতে। আর রাজ্যপর্যায়ের আইন পরিষদের হিসাব ধরলে এই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা খুইয়েছেন ৯৫৮টি আসন।
পরাজয়ের জন্য ওবামা একা দায়ী নন, এটা সত্য। অর্থনীতি থেকে বৈদেশিক রাজনীতি, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা থেকে নাগরিক অধিকার ইত্যাদি অনেক প্রশ্নেই ওবামা প্রশাসন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্রনিরোধ চুক্তি, কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন, জলবায়ু চুক্তি—এগুলো সম্ভবত ওবামার আট বছরের সেরা অর্জন। কেউ কেউ ‘ওবামা কেয়ার’ নামে পরিচিত স্বাস্থ্য বিমাকে এই তালিকায় রাখবেন।
শাসনামলের প্রথম দুই বছর ছাড়া বাকি আট বছরই ওবামাকে রিপাবলিকান পার্টির প্রবল প্রতিবন্ধকতার মুখে কাজ করতে হয়েছে—আমরা যদি এটা মাথায় রাখি, তাহলে তাঁর আমলের এসব অর্জনের গুরুত্ব অনেক বেশি অনুধাবন করতে পারব। তবে সব দেশেই তো বিরোধী দল সরকারি নীতির বিপরীতে অবস্থান নেয়। সফল নেতৃত্ব তাঁকেই বলব, যিনি বিরোধী পক্ষের সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে জনগণকে নিজের পক্ষে আনতে সক্ষম। লিংকন পেরেছিলেন, রুজভেল্ট পেরেছিলেন, এমনকি রিগান পর্যন্ত পেরেছিলেন।
নির্বাচিত হওয়ার আগে ওবামা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি আমেরিকার বর্ণ ও রাজনীতিভিত্তিক বিভক্তি মুছে ফেলবেন। তিনি সবাইকে একত্র করবেন (‘ইউনিফায়ার’ হবেন)। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে ঠিক উল্টো। আমেরিকা আজ বিশ শতকের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক বিভক্ত। এই বিভক্তি যেমন বর্ণভিত্তিক, তেমনি রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক—এই মোটা দুই ভাগে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক সাম্প্রতিক জনমত সমীক্ষা বলছে, রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের প্রতি ১০ জনের ৪ জন মনে করেন, অন্য দলের অনুসৃত নীতি এতটা ক্ষতিকর যে তা দেশকে মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যে বর্ণবাদী ব্যবস্থা আমেরিকাকে দীর্ঘদিন ধরে কুরে কুরে খাচ্ছে, আমরা আশা করেছিলাম, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ওবামার সময়ে তা বদলাবে। কিন্তু ঘটেছে উল্টো। বর্ণবাদী বিভক্তি নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। দোষটা ওবামার নয়, এ দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বিচারব্যবস্থার মূলে রয়েছে বর্ণভিত্তিক বৈষম্য। হয়তো ওবামা ও তাঁর আফ্রিকান-আমেরিকান অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডারের কারণে সেই নোংরা চেহারাটা আরও কদর্য হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা এখন জানি, এ দেশের সাদা পুলিশ আফ্রিকান-আমেরিকানদের ওপর নির্দ্বিধায় গুলি চালায় শুধু এই কারণে যে তারা কালো, সাদা বিচারক কালো মানুষ পেলে সাক্ষী-সাবুদের তোয়াক্কা না করে লঘু অপরাধে গুরুদণ্ড দিতে দ্বিধা করেন না।
পিউ রিসার্চের সমীক্ষার আরও তথ্য, এ দেশে ৮৮ শতাংশ আফ্রিকান-আমেরিকান মনে করেন, বিচারব্যবস্থা তাঁদের প্রতি বৈষম্যমূলক। শ্বেতকায়দের ৫৩ শতাংশ এ কথার সঙ্গে একমত। সিবিএস ও নিউইয়র্ক টাইমস-এর সমীক্ষা অনুসারে, এ দেশে তিন-চতুর্থাংশ কালো মানুষ মনে করেন, পুলিশ তাঁদের ওপর যথেচ্ছ বলপ্রয়োগ করে। শ্বেতকায়দের ৫০ শতাংশ মানুষ এই অভিমতও সমর্থন করেন।
সাদা-কালোর এই বিভক্তি যে আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে, ওবামা নিজেও সে কথা মানেন। গত বছরের জানুয়ারিতে তাঁর সর্বশেষ ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণে তিনি বলেছিলেন, সাদা-কালোর বিভক্তি ও রিপাবলিকান-ডেমোক্র্যাটদের তিক্ত বাদ-বিবাদ তিনি যে কমাতে পারেননি, তাঁর জন্য সেটা সবচেয়ে গভীর অনুশোচনার বিষয়। ‘প্রেসিডেন্ট লিংকন বা প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মতো প্রতিভাধর হলে হয়তো আমি আরও বেশি কিছু করতে পারতাম’—ওই ভাষণে ওবামা স্বীকার করেছিলেন। ‘তবে আমি চেষ্টা অব্যাহত রাখব, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’ পরে তিনি এমন কথাও বলেছিলেন, রাজনৈতিক প্রচারণার সময় তিনি হয়তো এমন নানা কথা বলেছেন, যা লাল-নীলের বিভক্তি বাড়িয়েছে, তাঁর অনুসৃত নীতি কখনো কখনো তাঁদের দূরত্ব কমানোর বদলে অগ্রগতিতে বাধার সৃষ্টি করেছে। ‘আমি জানি আমাকে আরও ভালো ফল দেখাতে হবে।’ ওবামা নিজেই স্বীকার করেছিলেন।
শুধু চেষ্টার জন্য অথবা গুছিয়ে চমৎকার কথা বলার জন্য যদি নম্বর দেওয়ার প্রথা থাকত, তাহলে ওবামা হয়তো পাঁচে চার বা পাঁচ পেতে পারতেন, কিন্তু ফলাফলের বিচারে তাঁকে সেই নম্বর দেওয়া কঠিন।
ওবামার অন্য প্রধান ব্যর্থতা আমেরিকার ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে ‘অর্থনৈতিক অসাম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সাত বছর রাজত্ব চালানোর পর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি এক ভাষণে বলেছিলেন, বর্তমানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনীতি যাতে সব মানুষের উপকারে আসে, তা নিশ্চিত করা। ‘আমি ঠিক সে কারণেই প্রেসিডেন্ট হয়েছিলাম, আমি যা করি, তা সবই সে কথা মাথায় রেখে করা।’
সুন্দর কথা। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, ওবামার আট বছরের শাসন শেষে আমেরিকায় এখন ধনি-গরিব বৈষম্য আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বার্কলের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার এক হিসাব অনুসারে, গত আট বছরে ১ শতাংশ পরিবার এই সময়ে অর্জিত সব অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ৫২ শতাংশের সুফল করায়ত্ত করেছে। ২০০৮-এর মন্দার কারণে বাকি ৯৯ শতাংশ মানুষ যে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন, এত দিনে তার দুই-তৃতীয়াংশের কম তা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছেন। সে মন্দার ঝড়ে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রায় এক কোটি মানুষ বসতবাড়ির মালিকানা হারান। এমনকি ২০১৫ সালেও ১১ লাখ পরিবারের ঋণের কারণে বসতবাড়ি নিলামের মুখে ছিল। ওয়েব পত্রিকা হাফিংটন পোস্ট লিখেছে: অর্থনৈতিক বৈষম্যকে ওবামা তাঁর সময়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ বলেছিলেন, অথচ সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি তেমন কিছুই করেননি।
২০১৬ সালের নির্বাচনে হিলারির পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিল তিনি সাদা আমেরিকানদের উদ্বেগের কারণ ধরতে পারেননি। তিনি আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিকদের দলে টানতে তথাকথিত ‘আইডেন্টিটি পলিটিকস’-এ এতটাই ডুবেছিলেন যে সাদাদের উদ্বেগের বিষয়টা একদম ভুলে বসেছিলেন। ভুলটা একা হিলারির নয়, ওবামারও। গত তিন দশকে আমেরিকার উৎপাদন খাত ক্রমশ হ্রাস পাওয়ায়, মিলকারখানা বন্ধ হওয়ায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই বেকার, বিত্তহীন হয়ে পড়েন। তাঁদের অনেকেই এর জন্য দায়ী করেছেন নাফটা ও অন্যান্য বহুপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তিকে। কার্য-কারণ যা-ই হোক, বাস্তব সত্য হলো নাফটার (বা উত্তর আমেরিকার বাণিজ্য চুক্তি) কারণে অসংখ্য মার্কিন মিলকারখানা মেক্সিকোতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মধ্যবিত্ত সাদা আমেরিকানরা এ ধরনের বহুপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির বিরুদ্ধে, সে কথা জানা সত্ত্বেও ওবামা নিজে আন্তপ্রশান্ত মহাসাগরীয় সহযোগিতা বাণিজ্য চুক্তি বা টিপিপির পক্ষে জোর প্রচারণা চালিয়ে গেছেন। হিলারিও প্রথমে টিপিপির পক্ষে ছিলেন, পরে বার্নি স্যান্ডার্সের প্রবল আপত্তির মুখে তিনিও মত বদলান। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা তত দিনে হয়ে গেছে। সাদা আমেরিকান ভোটাররা ধরেই নিয়েছেন, ওবামা বা ডেমোক্র্যাটরা তাঁদের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারটা মোটেই আমলে নিচ্ছেন না। ট্রাম্প তা আমলে নিয়েছিলেন, তাই তাঁরা ট্রাম্পকেই ভোট দিয়েছেন।
ইতিহাস ওবামাকে কীভাবে বিচার করবে, তা ভাবার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু এ মুহূর্তের বিচারে ওবামা তাঁর দেশের মানুষের আশা পূরণে সক্ষম হননি, এ কথা বলা বোধ হয় একদম অযৌক্তিক হবে না। তবে পরিহাসের বিষয় হলো, তাঁর ফেলে যাওয়া চেয়ারটি এখন দখল করবেন এমন একজন মানুষ, প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোনো যোগ্যতাই যাঁর নেই। কী জানি, হয়তো ট্রাম্পের চার বা আট বছর পর এ দেশের মানুষ নিজেদের মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে নতুন করে মূল্যায়ন করবেন কী ছিল তাঁদের একমাত্র আফ্রিকান-আমেরিকান প্রেসিডেন্টের অর্জন।