|
জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছে। গত বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যে রাষ্ট্রপতির তিনটি অধ্যাদেশ জারির মধ্যে সরকারের সুচিন্তা ও সুপরিকল্পনার ঘাটতি প্রতিফলিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিবিরোধ, জেলা পরিষদ নির্বাচন ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক—কোনোটিই অধ্যাদেশ জারির মতো জরুরি বিষয় নয়। এই তাড়াহুড়োর পেছনে জনস্বার্থ নয়, সরকারদলীয় স্বার্থ কাজ করেছে বলে মনে হয়।
২০১৬ সালে সংসদ ৫০টি আইন পাস করেছে, সেগুলোর অর্ধেকই বিভিন্ন পুরোনো আইনের সংশোধনী। আরও যে কয়েকটি বিলের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোর একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো বাক্স্বাধীনতার সংকোচন, নাগরিকদের পরিবর্তে আমলানির্ভরতা, আদালত এড়িয়ে সরকারি কর্মকর্তানির্ভর সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা বিষয়ে সরকারের প্রস্তুতি একটা গভীর সংশয় তৈরি করেছে। প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন একটি ভালো উদ্যোগ কিন্তু তাতে এমন বিধান আছে, যার সহজে অপপ্রয়োগ হতে পারে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সন্তান-সন্ততি বংশসূত্রে নাগরিকত্ব পাবেন না, যদি তাঁরা ‘বাংলাদেশবিরোধী’ তৎপরতায় লিপ্ত হন। আবার জন্মসূত্রে ছাড়া অন্যভাবে অর্জিত নাগরিকত্ব বাতিল হবে যদি কারও ‘আচরণে বা কার্যে’ সংবিধানের প্রতি আনুগত্যহীনতার প্রকাশ ঘটে। কেউ বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাহার করেছেন মর্মে সরকারের কাছে ‘তথ্য’ এলেও তাঁর নাগরিকত্ব খর্ব করা যাবে। এভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে বাক্স্বাধীনতা যেন আমাদের সরকার ও সংসদের সইছে না। এ প্রসঙ্গে আরেকটি তথ্য উল্লেখ করা চলে: কোস্টগার্ড বাহিনীর সদস্যরা যদি তাঁদের ঊর্ধ্বতনদের কাছে সম্মিলিতভাবে ‘বৈধ বা অবৈধ অসন্তুষ্টি’ প্রকাশ করেন, তাহলে তা বিদ্রোহ বলে গণ্য হবে এবং সে জন্য মৃত্যুদণ্ড বা তার চেয়ে লঘু দণ্ড হবে।
সংসদ কয়েকটি আইন করতে গিয়ে তথ্য অধিকার আইনে দেওয়া তথ্য জানার অধিকারও বিবেচনায় নেয়নি। ফলে সংবিধানের বাক্স্বাধীনতা-সংক্রান্ত ৩৯ ধারা ও তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে এসব আইনের একটি বিরোধ তৈরি হয়েছে। সে কারণে বলা যায়, সংবিধানের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করে আইন তৈরি করার বিপজ্জনক প্রবণতা ২০১৬ সালে তীব্র রূপ নিয়েছে। এসব বিধান সংবিধানের ১০২ ও মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত ২৬ অনুচ্ছেদের আওতায় আদালতে চ্যালেঞ্জযোগ্য।
৫০টি আইনের মধ্যে যেগুলো সামরিক অধ্যাদেশ মুছে সংসদীয় আইনের চেহারা পেয়েছে, তাতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। ফলে এটাও বলা যায় যে সংসদ সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের আমলে প্রবর্তন করা অধ্যাদেশ নামেমাত্র বাতিল করেছে। অনেকটা আক্ষরিক অর্থেই ‘অধ্যাদেশ’ মুছে দিয়ে ‘আইন’ শব্দ প্রতিস্থাপন করেছে। এটা প্রমাণ করে যে সংস্কৃতির বদল না ঘটলে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসবে না।
সামরিক শাসনের আমলের অধ্যাদেশগুলোর বিতর্কিত ও গণতন্ত্রবিরোধী বিধানগুলোও তারা কমবেশি বহাল রেখেছে। নাগরিক সমাজের পরিবর্তে আমলাদের দিকে সরকারের ক্রমে ঝুঁকে পড়া ২০১৬ সালের আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার অন্যতম উদ্বেগজনক বৈশিষ্ট্য। একটা উদাহরণ দিই। ১৯৮৫ সালে যুব কল্যাণ তহবিল অধ্যাদেশটিতে কৃতী যুবকদের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দিতে যে বাছাই কমিটি ছিল, তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, ক্রীড়া সাংবাদিক, দুজন বিশিষ্ট সমাজকর্মী ছিলেন। ৩১ বছর ধরে এটা চালু থাকার পরে এবারে যে ৯ সদস্যের বাছাই কমিটি হয়েছে, তাতে সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবেরা নাগরিকদের তাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন নাগরিক মাত্র দুজন। নাগরিকে অনাস্থা, আমলায় আস্থা—তার মানে সরকার বশংবদ ও আনুগত্যপ্রিয়দের দিয়েই তার উন্নয়ন বাস্তবায়ন করতে চাইছে।
এমনকি তারা বাক্স্বাধীনতার বিষয়ে বছর শেষে এসে এনজিওগুলোর নিবন্ধন বিষয়ে সংসদ যে আইন পাস করেছে, তাতে বাক্স্বাধীনতা বিষয়ে সামরিক শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটিয়েছে। ১৯৭৮ ও ১৯৮২ সালের দুটি অধ্যাদেশ বাতিল করে ২০১৬ সালে বৈদেশিক অনুদান রেগুলেশন চূড়ান্ত করা হলো। এতে ‘সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান’ সম্পর্কে বিদ্বেষমূলক ও অশালীন কোনো মন্তব্য করাকে অপরাধ ঘোষণা করা হয়েছে।
রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ১৯৭৬ সালে অধ্যাদেশ দিয়ে করা হয়েছিল। তখন তথ্য অধিকারের কোনো ধারণা রাষ্ট্রে স্বীকৃত ছিল না। রেলওয়ে বাহিনী একটি শৃঙ্খলা বাহিনী। তথ্য অধিকার আইনে কোনো শৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়নি। অথচ এই আইন বলেছে, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ ও বাহিনীর সদস্যগণ কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সংবাদপত্র বা কোনো প্রকার প্রকাশনায় কোনো সংবাদ, পুস্তক, চিঠি বা অন্য কোনো প্রকার দলিল প্রকাশ বা প্রকাশে সহযোগিতা করবেন না বা প্রকাশ করিবার কারণ হবেন না।’ যদি ধরে নেওয়া হয় যে তথ্য অধিকার আইন প্রাধান্য পাবে, তাহলেও এটা বলা যায় এই বিধানের আওতায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদানে এই বিভাগের কর্মকর্তারা সন্ত্রস্ত থাকবেন।
সরকার এর আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সেনা আমলের অধ্যাদেশগুলোর আবশ্যকতা ও প্রাসঙ্গিকতা পর্যালোচনা করে যেসব অধ্যাদেশ আবশ্যক বিবেচিত হবে, সেগুলো সব অংশীজন ও সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মতামত নিয়ে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধন ও পরিমার্জনক্রমে বাংলা ভাষায় নতুন আইন করবে। কিন্তু যে ৫০টি আইন হয়েছে তাতে অল্প কয়েকটি আইনই কেবল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার শর্ত পূরণ করেছে।
সামরিক শাসন বা অগণতান্ত্রিক শাসনের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো আদালতকে এড়িয়ে চলা। ১৯৮৫ সালের উদ্বৃত্ত সরকারি কর্মচারী আত্তীকরণ আইনটির একটি ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীনে জারি কোনো সরকারি আদেশ বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো নালিশ করা যাবে না। সব থেকে হাস্যকর হলো, কর্মচারীদের কাছে হানিকর মনে হতে পারে—এমন কোনো ‘অভিপ্রায়ের’ বিরুদ্ধেও কোনো মামলা চলবে না। ১৯৭৫ সালের সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল আইনে ‘কতিপয় সংবাদপত্রের’ যেসব কর্মচারীর চাকরি বিলুপ্ত হয়েছিল ও যাঁদের আত্তীকরণের দায়িত্ব সরকার নিয়েছিল, তাঁদেরও সরকারি কর্মচারী হিসেবে গণ্য করতে হয়েছে ২০১৬ সালে। এর বাস্তব কোনো দরকার আছে, তা মনে হয় না।
সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই ২০১৬ সালেও সরকার-নিয়ন্ত্রিত মোবাইল কোর্টের বিচারকার্য সম্পাদনের এখতিয়ার আরও সম্প্রসারিত করা হয়েছে। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে মোবাইল কোর্টের তফসিলে তা অন্তর্ভুক্ত করার প্রমাণ নেই। অভিযোগ রয়েছে, মোবাইল কোর্টের তফসিল ইচ্ছাকৃতভাবে হালনাগাদ করা হয় না। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত মোবাইল কোর্টে বিচারযোগ্য হিসেবে ১০৯টি আইন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এক-এগারোতে ১০টির মতো আইন তফসিলভুক্ত ও কেবল জরিমানা করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মনে করেন সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা কাউকে জেল খাটানো সমীচীন নয়।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ১৬ ধারায় বলা আছে, এই আইনের ৬টি ধারার অপরাধের বিচার সরকারি কর্মকর্তারা করবেন। তাঁরা অনধিক দুই বছর জেল দেবেন। কক্সবাজারে অবৈধ দালান নির্মাণ, পাহাড় বা টিলা কাটা, নিচু জমি ভরাট ও পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার মতো অপরাধের বিচার সরকারি কর্মকর্তারা করবেন। মোবাইল কোর্ট কোন আইনে কতটুকু বিচারকাজ করবেন, তা সংসদ আইন দ্বারা নির্দিষ্ট করে। কিন্তু তাতে পরিবর্তন আসে এসআরওর মাধ্যমে। সংসদ লাগে না। সেই অর্থে তোপখানাতেও এখন একটি আইন প্রজননকেন্দ্র হয়েছে, যা বৈধ হতে পারে না। গত বছরে সংসদকে পাশ কাটিয়ে ২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন, ২০০৫ সালের পশু ও পশুজাত সঙ্গনিরোধ আইনে ও ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে এসআরও দিয়ে পরিবর্তন আনা হয়। এসআরও দিয়ে সংসদের কোনো আইনে সংশোধন করা শুধু মোবাইল কোর্টওয়ালারাই করতে পারছেন। অথচ সংসদ কখনো এই ক্ষমতা তোপখানার কাছে স্থানান্তর করেনি।
রেলওয়ের সম্পত্তি (অবৈধ দখল উদ্ধার) আইনও একটি ‘সমান্তরাল বিচার বিভাগ’ তৈরি করেছে। তাদের বাহিনী কর্মকর্তা ওসি হিসেবে গণ্য হয়ে অপরাধের তদন্ত করবেন। এবং ওই আইনের অধীনে অপরাধ ঘটলে তাঁকে বিনা পরোয়ানায় বাহিনীর সদস্যরাই গ্রেপ্তার করবেন। সংবিধান বলেছে, কাউকে গ্রেপ্তার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করতে হবে। নতুন আইন বলেছে, এসআই পদমর্যাদার নিচে কেউ আটক করলে আটক ব্যক্তিকে ‘অনতিবিলম্বে’ তাঁর নিকটবর্তী বাহিনীর কর্মকর্তার কাছে হাজির করতে হবে। এই ‘অনতিবিলম্বের’ কোনো ব্যাখ্যা নেই।
কোনো আইনে আগে কী ছিল এবং কী পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা জনগণের জানা গুরুত্বপূর্ণ। অথচ আইনে এমন পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা আগে কী ছিল সেটা প্রকাশ করা হয় না। কোস্টগার্ড আইনও তার একটি উদাহরণ। কোস্টগার্ড আইন করা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। এটা রহিত করে ২০১৬ সালে নতুন আইন হয়েছে। এই আইনের শিরোনামে বলা হয়, কোস্টগার্ড বাহিনীকে অত্যাধুনিক ও যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে বিদ্যমান আইন সুসংহতকরণপূর্বক তা পুনঃপ্রণয়ন করা দরকার। কিন্তু ১৯৯৪ সালে কোন বিধানের পরিবর্তে কী পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা নির্দিষ্টভাবে ওয়েবসাইটে দেওয়ার মতো পরিশ্রম আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং উইং করতে চায়নি। এমনকি এটা প্রমাণ করে যে তারা যে খসড়া বিল আকারে পেশ করেছিল, সেখানেও তারা দফাওয়ারি পরিবর্তন সংসদকে অবহিত করেনি। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এভাবেই আইন পাস চলছে। কিন্তু এটা বন্ধ হওয়া দরকার।
আশা করব, সংসদ অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের মত কতটুকু রাখল, তা তারা বিলের প্রস্তাবনায় নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দেড় লাখ মামলার অধিকাংশই যদি মিথ্যা হয়ে থাকে তাহলে এর বিচার প্রথাগত নিয়মে চলতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টে বিচারকেরা এ বিষয়ে সম্প্রতি যে মত প্রকাশ করেছেন, তার সঙ্গে ২০১০ সালে আইন কমিশনের রিপোর্ট মিলিয়ে দেখলাম। আশ্চর্য, বিচারপতি মো. আবদুর রশীদের নেতৃত্বাধীন কমিশন ঠিক এই বিষয়টি চিহ্নিত করেছিল। এমনকি তারা একটা বিলের খসড়াও করেছিল। সেটি সরকারের কাছে হেলাফেলায় পড়ে আছে। আর আমাদের ৭২টি ট্রাইব্যুনাল দেড় লাখ মিথ্যা মামলা নিয়ে বছরের পর বছর ধুঁকছেন। আইন কমিশন শেখ হাসিনার সরকার করেছে। তাহলে কেন তাদের সুপারিশ এভাবে উপেক্ষায় থাকবে? ২০১৭ সালটি তবে শুরু হোক এই আইনটির সংশোধনের মধ্য দিয়ে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।