বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ৮:৩৬
Home / ইতিহাস ঐতিহ্য / সমুদ্র ঈগল ৭

সমুদ্র ঈগল ৭

কুতায়বা আহসান :

একদিন মা‘আয, নাবিল, মুগীরা এবং তাঁদের গোলাম বাসীত, আদনানী কবীলার সরদার সাদ বিন সালামার কন্যা নুবায়রা সহ ঘোড়া দৌড়িয়ে সাগর তীরের জেলে পল্লীতে অবস্থিত মৎসজীবী ও মাল্লাদের ঝুপড়িতে এসে পৌঁছালো। পল্লীতে ঢুকে তারা এক জায়গায় থেমে গেল। পাশ দিয়ে জনৈক বুড়োকে যেতে দেখে মা‘আয তার ঘোড়া থেকে নেমে বুড়োকে উদ্দেশ্য করে বলল:
মুহতারাম! এই বস্তিতে জাবির বিন মুগীছ নামক একজন ব্যক্তি থাকেন আপনি কি বলতে পারবেন তিনি কোথায় থাকেন? বুড়ো উৎফুল্ল কন্ঠে মা‘আযকে লক্ষ করে বললেন: বেটি! তুমি যদি জাবির বিন মুগীছের সাথে সাক্ষাত করতে চাও তাহলে আমার সাথে এসো। কথাটা বলেই বুড়ো একদিকে হাটা ধরলেন। মা‘আযরাও তাঁর পিছনে পিছনে এগিয়ে চললো। অল্প দূর গিয়েই বুড়ো একটি প্রশস্ত ঝুপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মা‘আযদের লক্ষ করে বললেন:
“এই যে ঝুপড়ি দেখা যাচ্ছে তিনি এখানেই থাকেন”। মা‘আয বুড়োকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলে বুড়ো সেখান থেকে চলে গেলেন। এরপর তারা পাঁচজন একে একে ঝুপড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো। তারা দেখতে পেল পুরো ঝুপড়িতে খেজুর পাতার চাটাই বিছানো রয়েছে। একদিকে পড়ে রয়েছে পুরনো একটা বিছানা। বুড়ো সে বিছানায় কাত হয়ে ছাদের দিকে থাকিয়ে রয়েছেন। তাকে সজাগ দেখাচ্ছিল। মা‘আয আর তার সাথীদের ঝুপড়িতে প্রবেশের আওয়াজ শুনে বুড়ো তাদের দিকে না তাকিয়েই অত্যন্ত উদাস কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন কে?
বুড়োর কন্ঠ থেকে এক ধরনের বেদনা, এক ধরনের অসহায়ত্ব ঝরে পড়ছিল। মা‘আয সহ সকলেই তা অনুধাবন করতে পেরেছিল। মা‘আয একটু অগ্রসর হয়ে বলতে শুরু করল:
দাদু! আমাদেরকে আপনি চিনবেন না। আমরা আপনার কাছে আজনবি। যদি অনুমতি দেন তাহলে আমরা আপনার পাশে চাটাইয়ের উপর একটু সময় বসতে পারি।
হাসান ক্রুসুর দাদা বুড়ো জাবির বিন মুগীছ কথাটা শুনে তাদের দিকে ফিরে তাকালেন। তিনি শুয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে হাতের ইশারায় তাদেরকে চাটাইয়ের উপর বসতে অনুরোধ করে বললেন:
তোমরা বসো! জানি না তোমরা কারা? কেন এই ঝুপড়িতে এসেছো। আমি তোমাদেরকে আমার ভাঙা এ আস্তানায় খোশ আমোদের জানাচ্ছি। তাঁর কথায় মা‘আযরা আনন্দচিত্মে তাঁর পাশে বসে পড়লো। এরপর মা‘আযই কথা শুরু করলো।
“দাদু আপনার নাম আমরা জানি। আপনি জাবির বিন মুগীছ। আপনি নিশ্চয় আলবাশারাত ওয়াদির দুই সরদার কা‘ব বিন আমির আর সাদ বিন সালামাকে জানেন। আমি কাব বিন আমিরের ছোট মেয়ে। আমার নাম আ‘আয। আমার পাশে যিনি বসে আছেন ইনি আমার বড় বোন নাবিল। আর আমার বোনের পাশে যিনি বসা, তিনি সরদার সাদ বিন সালামার একমাত্র কন্যা নুবায়রা। আমাদের পিছনে যে যুবক বসে আছেন তিনি আমার সহোদর। নাম মুগীরা বিন কাব। আর ঐ যে বুড়ো মতো লোকটি দেখতে পাচ্ছেন তিনি নিজেকে আমাদের গোলাম পরিচয় দিলেও আমরা তাকে আমরা আমাদের চাচা হিসেবেই মনে করে থাকি।
পরিচয় শুনে জাবির বিন মুগীছের চেহারায় হাল্কা মুচকি হাসির উদয় ঘটে মিরিয়ে গেল। তিনি কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু তার আগেই মা‘আয পুনরায় বলতে শুরু করল: ‘‘আমাদের পিতা কাব বিন আমির আমাদেরকে তাগিদ করে বলেছেন: আমরা যেন প্রত্যহ আপনার কাছে আসা যাওয়া করি। যথাসম্ভব আপনার সেবা যতœ করি। কথাটা শেষ করার সাথে সাথে কিছু একটা স্মরণ হতেই মা‘আয দৌড়ে ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে গেল এরপর এক হাতে একটা ঘাটুরি এবং অপর হাতে পানির একটা মশক নিয়ে জাবির বিন মুগীছের সামনে রাখতে রাখতে বলল: “আমাদের আব্বা বার বার তাগিদ দিয়ে বলেছেন: আমরা যেন রোজই আপনার কাছে আসা যাওয়া করি। কারণ আপনি নাকি আমাদের মিল্লাতের এক আযীম ফরযন্দের দাদা। আমরা আপনার জন্য কিছু খাবার নিয়ে এসেছি। সাথে মশকে করে পানিও নিয়ে এসেছি।
মা‘আয কথা না থামিয়ে বলে যেতে লাগলো:
“আমার আব্বু বলেছেন আপনার নাতি নাকি এই মিল্লাতের এক আযীম ফরযন্দ। মিল্লাতের জন্য নাকি তাঁর জীবনটা উৎসর্গীত। এ ছাড়া আমি মুনযির বিন যুবাইর নামক আমার এক চাচার কাছ থেকে জানতে পেরেছিÑ আপনি নাকি খাইরুদ্দীন বারবারুসার অন্যতম সাথী হাসান ক্রুসুর দাদা।
দাদা! খাইরুদ্দীন বারবারুসাকে আমরা না দেখলেও তাঁকে আমরা মিল্লাতের আযীম মুহসিন এবং পূর্ব পুরুষের পৌরুষের প্রতীক মনে করে থাকি। তাঁর খিদমাতকে জাতি কখনো ভুলতে পারবে না। মুনযির চাচার বর্ণনা মতে আপনার নাতি যদি খাইরুদ্দীন বারবারুসার ঘনিষ্ট এবং প্রিয়তম সাথীদের একজন হয়ে থাকেন, তাহলে আমরা কেবল আপনার সেই নাতিরই নয় বরং আপনার কদর ও ইজ্জতকে অজস্র সালাম জানাই।
আচ্ছা দাদু! এবার বলুন আপনি আপনার নাতি হাসান ক্রুসুর সাথে থাকছেন না কেন? মুনযির বিন যুবাইরের কাছ থেকে শুনতে পেয়েছিÑ গ্রানাডার পতনের সময় আপনার সন্তানÑ হাসান ক্রুসুর পিতা শহীদ হয়ে গেছেন। আর হাসানের মা ও বোন হারিয়ে গেছেন। তাঁদেরকে নাকি আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আপনি নাকি আপনার নাতির জন্য এই শর্ত বেঁধে দিয়েছেন যে, যতদিন তিনি তাঁর মা ও বোনকে খুঁজে পাচ্ছেন না ততদিন যেন তিনি আপনার সাথে মোলাকাতের চেষ্টা না করেন, অন্যথায় আপনি নাকি তাঁকে লোহা গরম করে দাগিয়ে দেবেন?
মা‘আয তার কথা বলে নীরব হতেই বুড়ো জাবির বিন মুগীছ হতাশার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলেন:
মা‘আয আমার বোন! আমি তোমার আব্বা কাব বিন আমিরের কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি আমার খেয়াল রাখার জন্য তোমাদেরকে বলেছেন। আমার সন্তানরা, তোমরা শোনো! এই পৃথিবীটা বড়ই আজীব। এখানে কেউ আকুল হয়ে জাতির হারিয়ে যাওয়া সম্মানকে খুঁজে বেড়ায়। কেউ অন্ধকারে পড়ে ম্লান আলোর জন্যে হা হুতাশ করে বেড়ায়। কেউ জীবনের নির্জন মরুপথে চিহ্নহীন পথের তালাশে শক্ত চাটানের গায়ে মাথা কুটে কুটে জীবনটা কাটিয়ে দেয়। কেউ জনম জনম ধরে দুঃসহ কষ্টের ভেতর জখমী দীল নিয়ে লুহাওয়ার মতো তপ্ত হতাশ্বাস ছেড়ে জিন্দেগী পার করে। কেউবা অচিন মুসাফিরের মতো পথ হারিয়ে মনযিলে মাকসুদের জন্য বিভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়ায়।
খুব সম্ভব আমার মাবুদ আমার চোখে জেগে থাকার অসীম শক্তি এবং সাগর সাগর অশ্র“ বহানোর ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আমার অন্তরে আবেগের তীব্র উত্তাপ এবং কারো সাথে সাক্ষাতের অসীম অতৃপ্ত আকাঙ্খা ভরে দিয়েছেন। আমি আমার বউমা আর নাতনিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। এদের ছাড়া আমি যেন আগুন আর এসিডবৃষ্টির মধ্যে জীবন যাপন করছি। অকুল অন্ধকারে ঝলসে দেয়া তাপপ্রবাহের মধ্যে এক ফোটা পানির জন্যে কাতর ছাতক পাখির মতো আমি দিন গুজরান করছি। জানি না, কখন আমার জীবনের শুষ্ক মরুভূমে এক ফোটা বৃষ্টি নেমে অনুর্বর জীবন জমীনটাকে ফলে ফুলে সতেজ করে তুলবে।
এটুকু বলতে বলতে তার অবস্থায় বিস্ময়কর পরিবর্তন এসে যায়। তাঁকে দেখে মনে হয় এই যেন তিনি হু হু করে কেঁদে দিবেন। তাঁর চোখ সজল হয়ে উঠেছিল। তিনি প্রবলভাবে ঠোঁট কামড়ে ভেতরে ফুঁসে উঠা উচ্ছ্বাসকে দমিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ভেতর থেকে কান্নার হেচকি গলায় এসে যেন আটকা পড়ে গিয়েছিল। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে মা‘আযের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন:
“মানুষ বলেÑ আমি আমার নাতি হাসান ক্রুসুকে ভালোবাসি না, তাই আমি তাকে আমার কাছে আসতে দেই না। তাকে লোহা গরম করে দাগিয়ে দেয়ার হুমকি দেই। কিন্তু হায়! কেউ যদি আমার দীলের পাতাগুলো একটু উল্টিয়ে দেখতো তাহলে দেখতে পেতো এর প্রতিটি পাতায় পাতায় শুধু হাসান ক্রুসুর নামই লিপিবদ্ধ রয়েছে।
এ টুকু বলার পর জাবির বিন মুগীছ নীরব হয়ে গেলেন। তাঁর চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা অশ্র“ টপ টপ করে চাটাইয়ের উপর ঝরে পড়ল। দ্রুত তিনি মাথার পাগড়ীর প্রান্ত দিয়ে অশ্র“ মুছে আবার হতাশাভরা কন্ঠে বলতে লাগলেন:
“কেউ জানে না আমি আমার নাতি হাসান ক্রুসুকে আমার কায়ার, কলিজার, এমনকি আমার আত্মার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। হায়! কোনো দরদী যদি তাকে এ কথাটা বলতো— তোমাকে তোমার দাদা নিঃস্ব অবস্থার আনন্দময় সতেজ সপ্নের মতো ভালোবাসেন। সুন্দর আর অসুন্দরের মিশ্র উদ্যানে তোমাকে হাস্যোজ্জ্বল গোলাবের মতো মনে করেন। হায় কেউ যদি আমার প্রিয় হাসানকে এ কথা বলতো যে, তোমার দাদা তোমাকে আমাদের জাতির উজাড় হওয়া শান-শওকত শৌর্য-বীর্যের প্রতীক মনে করেন। জীবন ও মরণের রঙ্গমঞ্চে জীবনের সওগাত শুনানো গায়ক মনে করেন। তোমাকে তোমার দাদা তোমাদের হারানো ঐতিহ্যের স্মারক মনে করেন।
কিন্তু হায়! আমরা আমাদের সম্ভ্রম, আমাদের স্বাধীনতা অন্যের হাতে বিকিয়ে দিয়েছি। প্রাণের আন্দালুসিয়া— একসময় যেখানে আমাদের আযাদীর চেরাগ রৌশনি ছড়াতো সেখানে আজ দুর্ভাগ্যের সমুদ্র থেকে উঠে আসা ঘুর্ণিঝড়ে সব কিছু বিধ্বস্ত। সব কিছু অন্ধকারের অতলে নিমজ্জিত। জানি না কখন সৌভাগ্যের সমুদ্র থেকে ফুঁসে ওঠা তুফানের আলোয় এ অন্ধকার বিদূরিত হবে। কোন সে জওয়ান কবে বেরিয়ে আসবেÑ যে আমাদের হাত পা থেকে গোলামীর জিঞ্জিরগুলো কেটে ফেলে আমাদেরকে এই অসহায় অবস্থা থেকে মুক্ত করবে। কখন অনাচারের এ জঞ্জাল স্তুপে আগুন লেগে সব কিছু ছাই হয়ে আমাদের আকাশ আলোকিত হয়ে উঠবে। কখন আমাদের জীবনের ভবিষ্যত শান্তির অসীম সাগরে পরিণত হবে।
হায়! যদি মিল্লাতের এমন কোনো সন্তান জেগে উঠতো, যে মুসলমানদের জন্য সাগরের প্রতিটি ঘুর্ণি আর প্রতিটি ঊর্মির মোকাবেলায় উপকুল এবং বিপদ উত্তরণের কিশতী হিসেবে গণ্য হবে।
এ টুকু বলার পর জাবির বিন মুগীছের আওয়াজ একেবারে তলিয়ে গেল। তিনি নিশ্চুপ হয়ে ঠোঁট কামড়াতে লাগলেন। আর ক্ষণে ক্ষণে পাগড়ির আঁচল দ্বারা চোখ বেয়ে ঝরে পড়া অবাধ্য অশ্র“র ফোটাগুলো মুছছিলেন।
তাঁর এ অবস্থা দেখে মা‘আয এবং তার সাথীরাও একেবারে মনমরা হয়ে হয়ে পড়লো।
মা‘আয তার জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো: “দাদু! আপনি চিন্তিত হবেন না, আল্লাহ চাহেতো আমি আর আমার সাথীরা রোজই সকাল বিকাল আপনার এখানে আসবো। আপনার পাশে বসে আপনার সেবা যতœ করার কোনো ত্র“টি করবো না। আপনি যদি হাসান ক্রুসুর দাদা হয়ে থাকেন তাহলে মনে করবেন আপনি আমাদেরও দাদা। হাসান ক্রুসু খাইরুদ্দীন বারবারুসার অন্যতম এক অস্ত্র। আর খাইরুদ্দীন বারবারুসা বর্তমানে মিল্লাতের শৌর্যের প্রতীক। এমন এক সত্তার সাথীর বুড়ো দাদুর জন্য আমরা যে কোনো কুরবানী দিতে পারি। আমরা এখন চলে যাচ্ছি। ইন শা আল্লাহ আবার আসবো। এ কথা বলার পরই মা‘আয তার সাথীদের নিয়ে সেখান থেকে উঠে নিজেদের ঘোড়ায় চলে আল বাশারাত অভিমুখে এগিয়ে যেতে লাগলো।

আরও পড়ুন : সমুদ্র ঈগল ৬ (খ)

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...