স্বাগত ২০১৭, বিদায় ২০১৬। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরটা কেমন গেল এবং নতুন বছরে আমাদের কী করণীয়—সে নিয়ে বিশ্বের পুরোধা ভাবুক ও নেতারা নিজেদের মত দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের লেখা ও একজনের সাক্ষাৎকার প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে ছাপা হবে, প্রতিদিন দুটি করে। প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের লেখা বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় প্রকাশের একমাত্র অনুমোদনপ্রাপ্ত সংবাদপত্র প্রথম আলো। আজ ছাপা হলো ফ্রানসিস ফুকুইয়ামা ও আবদুল্লাহ গুলের লেখা।
মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত ২০১৬ সালে দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রবলভাবে আলোচনায় থাকা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটকেও ছাপিয়ে গেছে। ২০১৭ সালের দ্বারপ্রান্তে এসে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেন—এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ গৃহযুদ্ধের কারণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
এসব দেশের চলমান সংঘাত-সংঘর্ষ সন্ত্রাসবাদ ও শরণার্থী ‘রপ্তানির’ মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাকি বিশ্বকে ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে। এই সন্ত্রাসবাদ ও শরণার্থীর ঢল পশ্চিমা দেশগুলোতে পপুলিজম (জনসাধারণের আবেগ, অনুভূতি ও ভয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত সরকারের ধারণা) এবং কর্তৃত্ববাদী মনোভাব উসকে দিচ্ছে; কোনো দেশই এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না। নতুন বছরে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিরসন এবং এই সংঘাতের সংক্রামক প্রতিক্রিয়া সামলানোর উদ্যোগ শুরু করতে বিশ্বকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বেগ পেতে হবে।
শুরুতেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তিপ্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করার বিষয়টিকে অবশ্যই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে। যদিও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এ মুহূর্তে আগের মতো বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছে না, তবু ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল সেখানকার মানবিক সংকট অবসানের বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য বিশ্বসম্প্রদায়ের সমর্থনপুষ্ট এবং সুস্পষ্ট শর্তের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমঝোতা ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। এ ধরনের সমঝোতাই এই অঞ্চলে, বিশেষ করে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সক্ষম হবে। এটি হলে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতার সুযোগ তৈরি হবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পদ্ধতির বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনা, যেটা সবচেয়ে বেশি জরুরি, তা–ও সম্ভব হবে।
আমরা আশাবাদী হতে চাই, ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়া আবার শুরু করবেন এবং ফিলিস্তিন ও জেরুজালেমের মর্যাদা নিয়ে তিনি নির্বাচনী প্রচারণার সময় যে বাগাড়ম্বর করেছিলেন, সেটি তাঁর নীতি প্রস্তাব নয়। ফ্রান্সের কৃতিত্ব স্বীকার করতেই হয়, দেশটি আইএসের প্ররোচনায় চালানো জঙ্গি হামলার শিকার হয়েও এই শান্তিপ্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সামরিক সহযোগিতা দেওয়া রাশিয়াও সম্প্রতি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের নেতাদের মস্কোয় আলোচনার টেবিলে বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
এসব দেশের সাম্প্রতিক উদ্যোগ এই আভাস দেয় যে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে উদ্ভূত সন্ত্রাসবাদ ও অন্যান্য বৈশ্বিক সমস্যার ধেয়ে আসা স্রোতোধারা প্রতিহত করার লক্ষ্যে ওই অঞ্চলে সবচেয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সংঘাত অবসানের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সালে শান্তিপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হলে সৌদি আরবের প্রয়াত বাদশাহ আবদুল্লাহ ২০০২ সালে ‘আরব শান্তি উদ্যোগ’ (আরব পিস ইনিশিয়েটিভ, সংক্ষেপে এপিআই) শীর্ষক যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই সেটি গ্রহণ করতে হবে। সংঘাতরত সব পক্ষই ইতিমধ্যে এপিআই গ্রহণ করেছে; আরব লিগও এটির অনুমোদন দিয়েছে।
ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনের সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে যৌথ সামরিক অভিযান চালানোর কাজ সমন্বয় করার সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই দেশগুলোর প্রতি যথাযথ সম্মান বজায় রাখতে হবে। এই সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে অবশ্যই সেখানে রাজনৈতিক সমাধান দরকার। এসব দেশে বিভক্তির যে প্রস্তাব ইতিমধ্যে উঠেছে, সব পক্ষ এ বিষয়ে সম্মত না হওয়া পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হতে পারে না। আসল ব্যাপার হলো, এমনটা এখনো স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান নয় যে দেশগুলোর বিদ্যমান অখণ্ড সত্তাকে অটুট রাখার চেষ্টা করার চেয়ে সেগুলোকে ভেঙে নতুন রাষ্ট্র গড়া সহজসাধ্য হবে।
ইরাকে লড়াই শুরু করে বিদেশি আলোচকেরা এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাবেক নেতারা এই অঞ্চলে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়ে গেছেন। এই বিপর্যয় থেকে বিশ্ব হয়তো একটা শিক্ষা পেয়েছে; সেটি হলো দেশে দেশে বিভক্তি সৃষ্টি করলে তার ভয়াবহ ফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে; এর ভূরাজনৈতিক পরিণতি হতে পারে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। ইরাক ও সিরিয়ায় নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী এখনো সেখানকার আইনের শাসনের শূন্যতার সুযোগকে পুঁজি করছে; তারা এমন এক উগ্রবাদী লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে, যা শুধু হৃত ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের অনমনীয় সংঘাতময় নীতিকেই উসকানি দেবে। যে ভূখণ্ড ও সম্পদকে জনগণ তাদের জাতীয় উত্তরাধিকার বলে মনে করে, তা যদি তাদের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে খারাপ পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।
ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনে যে প্রক্সি লড়াই চলছে, সেটিকে প্রায়ই শিয়া-সুন্নির গোষ্ঠীগত সংঘাত বলে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু এই গোষ্ঠীভিত্তিক সংঘাতের নেপথ্যে ইরান ও সৌদি আরবের দ্বন্দ্ব একটি বড় বিষয় হিসেবে কাজ করছে। নিজেদের মধ্যকার মতভেদ কাটিয়ে উঠে এই দুই আঞ্চলিক শক্তি একটা সমঝোতায় পৌঁছালে এই অঞ্চলের বহু স্থানীয় দ্বন্দ্ব–সংঘাত কমে যাবে।
গত এপ্রিলে ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ত্রয়োদশ ওআইসি সম্মেলনে তুরস্ক ও কাজাখস্তান ‘ইসলামিক প্রক্সিমিটি ইনিশিয়েটিভ’-শীর্ষক একটি বিরোধ নিষ্পত্তির মডেল উপস্থাপন করে। এ ধরনের মডেল অনুসরণ করে উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক পদক্ষেপ গোষ্ঠীগত সংঘাত নিরসন করতে পারে। এ কথা ঠিক যে, ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে; কিন্তু এটাও ঠিক যে, অতীতে এই দুই দেশ বিভিন্ন বিষয়ে একমত হয়েছে এবং শিয়া-সুন্নির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপ ছাড়া এভাবে চলতে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে গৃহযুদ্ধ ও সন্ত্রাস চলতেই থাকবে। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনের বড় অংশজুড়ে ব্যবসা–বাণিজ্য, শিল্প, পরিবহন সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছে, যা বৃহত্তর আঞ্চলিক অর্থনীতিকেও ক্ষতির মুখে ফেলছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, কীভাবে এই সশস্ত্র লড়াই প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দিচ্ছে এবং পুরো অঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, সুনির্দিষ্ট নীতি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে। কোনো জাদুর কাঠির স্পর্শে নয়, বরং এর মাধ্যমেই সংঘাত কমতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত শুধু যে অর্থনৈতিক অবকাঠামো ও শিল্পকারখানা ধ্বংস করে দিচ্ছে তা-ই নয়, এটি স্বাস্থ্যসেবা–ব্যবস্থা, শিক্ষা কার্যক্রম, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ক্ষেত্র এবং আরও বহু সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। ইউনিসেফের একটি হুঁশিয়ারিমূলক প্রতিবেদন অনুযায়ী, লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত শিশু ও যুবকেরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা তাদের বেকার করে রাখবে; এতে ভবিষ্যতে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি হবে, তা অবর্ণনীয়।
মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিরসনে আসন্ন বছরে সফল কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে তার সঙ্গে অবশ্যই বড় ধরনের পুনর্গঠন প্রকল্প থাকতে হবে। দেশগুলো আবার যাতে লড়াইয়ে পতিত না হয়, সে জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে মার্শাল প্ল্যানের ভিত্তিতে ইউরোপ পুনর্গঠন হয়েছিল, সেই ধরনের পরিকল্পনার ভিত্তিতে এই প্রকল্প নিতে হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কারকদের অবশ্যই আঞ্চলিক অ্যাজেন্ডার ওপরের সারিতে মানবাধিকার, আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও সুশাসনের মতো নীতিকে স্থান দিতে হবে। যেসব দেশ সশস্ত্র সংঘাত এড়াতে সক্ষম হয়েছে, ২০১৭ সালে সেসব দেশের প্রধান দায়িত্ব হবে নিজ নিজ ভূখণ্ডে তুলনামূলক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা, যাতে পুরো অঞ্চলে তারা আবার শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আবদুল্লাহ গুল। তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট।