কুতায়বা আহসান :
– পরদিন ভোরে খাইরুদ্দীনের দুই সাথী কাকাদ এবং হাসান আগাকে সুলতান তাঁর খিমায় তলব করলেন। সেদিনও যথারীতি তাঁর পাশে ছিলেন তাঁর ওজীরে আযম মুহাম্মাদ। সুলতান তাঁদের যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন পূর্বক তাঁর একেবারে পাশে বসিয়ে নিয়ে বললেন:
– আমার ধারণা রাত্রির বিশ্রাম তোমাদের দিনের ক্লান্তি দূর করে দিতে পেরেছে। অতএব আমি চাই তোমরা আজই আমার এখান থেকে খাইরুদ্দীনের কাছে চলে যাও। যাতে আফ্রিকায় তিনি যে পরিস্থিতির মোকাবেলা করছেন তা থেকে সত্তর মুক্তি পান।
– আমি তোমাদের যে সাহায্য প্রদানের ইরাদা করেছি তা কতকটা নিম্নরূপ— আমি তোমাদের সাথে আমার সেনাবাহিনী থেকে বাছাই করা অতিদক্ষ দুই হাজার সৈন্য দেব, এরা সবধরণের যুদ্ধে তোমাদেরকে যোগ্য সহায়তা দিয়ে যেতে পারবে। এ ছাড়া দুহাজার রাজাকার প্রেরণ করবো এদেরকে তোমরা যে কোনো প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে। এভাবে খাইরুদ্দীনের কাছে চার হাজার সৈন্যের একটা সহায়তা পৌঁছে যাবে। তাছাড়া আমি তোমাদের সাথে কয়েকটা যুদ্ধজাহাজও পাঠাব। জাহাজগুলোতে দূর পাল্লার কিছু কামানও থাকবে। এর ফলে তিনি অতি সহজেই শত্রুর জাহাজে আক্রমণ পরিচালনা করতে পারবেন।
– এগুলো ছাড়াও আমি তোমাদের সাথে নগদ কিছু অর্থ প্রেরণ করবো। এর মাধ্যমে তোমরা শত্রুর বিরুদ্ধে পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে পারবে।
– এর পাশাপাশি আমি আমার ওজীরে আযম মুহাম্মদ ও পরিষদের সবার সাথে পরামর্শ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আমি খাইরুদ্দীন বারবারুসাকে কেবল পাশা খেতাবই নয় বরং ‘আমীরুল বাহর’ -এর খেতাবও প্রদান করছি। এখন থেকে খাইরুদ্দীন তাঁর নামের সাথে পাশা খেতাব ব্যবহার করতে পারবেন।
– অকল্পনীয় এ উদার সাহায্য ও সহানুভূতি পেয়ে কাকাদ ও হাসান আগা আপ্লুত হয়ে উঠলেন।
– এরপর কাকাদ আনন্দঘন কন্ঠে সুলতানকে উদ্দেশ্য করে বললেন:
– সুলতানে মুহতারাম! প্রথমেই আপনার কৃতজ্ঞতা আদায় করছি। তারপর বলছি— আপনার এই সাহায্যের বদৌলতে আমরা আফ্রিকার যে অঞ্চলটাই বিজয় করবো সেটিকে আপনার সালতানাতের অংশ মনে করবেন। আমরা সর্বক্ষণ আমাদের সব সামর্থ ব্যয় করে আপনার সালতানাতের সীমা বাড়িয়ে নেবার প্রচেষ্টায় নিবেদিত থাকবো। আমরা আমীর খাইরুদ্দীনের পক্ষ থেকে আপনার আনুগত্যের শপথের পাশাপাশি ওফাদারীর শপথও করছি। আমরা আরো শপথ করছি— আমরা যে সব এলাকা জয় করবো সেখান থেকে প্রাপ্ত জিযিয়ার একটা গ্রহণযোগ্য অংশ খেলাফতের বায়তুলমালে পাঠাতে থাকবো।
– কাকাদের কথায় সুলতান খুশি হয়ে গেলেন। এরপর বর্ণিত সাহায্য সহ তাদেরকে আলবিদা জানালেন।
(৫)
– অাল জাযিরার যে অংশে স্পেনীয় জেনারেল মূন কিড-এর শাসন চলছিল সেখানে ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের এ ভীতির কারণ ছিল— তাদের জাসুসরা এসে সংবাদ দিয়েছিল খাইরুদ্দীন বারবারুসা জিজল দ্বীপে বসে তাঁর শক্তি সংহত করে চলছেন এবং নতুনভাবে মোকাবেলায় নামার জন্যে সুলতান সেলিমের কাছে তাঁর অন্যতম সাথী কাকাদ ও হাসান আগার মাধ্যমে সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছেন। সুলতানের কাছে সাহায্যের সংবাদটাই ছিল মূন কিডের ভীতির কারণ।
– মূন কিড বুঝতে পারছিল অনাগত তুফানের ধাক্কাটা প্রথমে তার উপর দিয়েই অতিক্রান্ত হবে। তাই একদিন সে তার ওখানে সমমনা সবাইকে ডেকে পাঠাল। সেই সমমনাদের মধ্যে উপস্থিত হলেন কুকুর অধিপতি ইবনে কাজি, পানুন দ্বীপের শাসক ডন মার্টন, তিউনিসের শাসনকর্তা হাসান, তিলমিসানের শাসক আবু হামু এবং সুগরাবি কবিলার একাংশের নেতা আহমদ বিন কাজি।
– মূন কিড-এর এ আহ্বানে যে দুজন নেতা সাড়া দেননি তাঁদের একজন হলেন সুগরাবিদের প্রিয়তম নেতা আব্দুল আজীজ, অপরজন বাররবারদের নেতা হাফসি। এরা কেবল নিরপেক্ষতা বজায়ের জন্যেই মূনকিডের যৌথবাহিনী থেকে আলগ ছিলেন না, বরং তাঁরা উভয়ই ছিলেন মনে-প্রাণে খাইরুদ্দীন বারবারুসার সমর্থক।
– খাইরুদ্দীন বিরোধী সবাই যখন মূনকিডের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার ওখানে এসে জমায়েত হলো তখন মূনকিড তাদের সবাইকে উদ্দেশ্যে করে বললেন:
– আমার সহয়মযোগীবৃন্দ! আমি আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য খাইরুদ্দীনের পক্ষ থেকে তাঁর সাথী কাকাদ এবং খাজা সারা হাসান আগা তুর্কদের খলীফা সুলতান সেলিমের কাছে গিয়েছেন।
এখন আমাদেরকে এ বিষয়টির প্রতি তাকালে চলবে না যে, আমাদের মধ্যে কে মুসলমান আর কে নাসারা। এখন আমাদের জন্য যে বিষয়টি ভাবতে হবে সেটা হচ্ছে— সুলতান সেলিমের কাছ থেকে যদি বারবারুসা সাহায্য পেয়ে যান তাহলে আফ্রিকার এ অঞ্চলে আমরা আমাদের শাসন টিকিয়ে রাখতে পারব কি না। আমার মনে হয় তখন আমরা অনাগত সেই ঝড়ের মুখে খড়কুটোর মতো ভেসে যাব। বারবারুসা আমাদের মস্তকগুলো কর্তন করে কুস্তুনতুনিয়ায় সুলতান সেলিমের দরবারে পাঠিয়ে দেবেন। অতএব আমি মনে করি অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে সম্মিলিতভাবে আমাদের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ দরকার। এ ব্যাপারে আমি আপনাদের প্রত্যেকের সুচিন্তিত অভিমত জানতে আগ্রহী।
– মূনকিড তার বক্তব্য শেষ করতেই তিউনিশের শাসক হাসান— যাকে মওলা হাসান নামে ডাকা হতো দাঁড়িয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন:
– খাইরুদ্দীন বারবারুসা যদি তুর্কদের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চান তাহলে মূনকিড! আপনাকে আমরা ওয়াদা দিচ্ছি একটা তুর্ক সেনাকেও আমরা জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে দেব না। খাইরুদ্দীনকেও আমরা আর তার সাথী সহ জিজলে অবস্থানের সুযোগে দেব না। বরং যতদূর সম্ভব আমরা তাঁকে তাড়া করে বেড়াব। আমাদের অঞ্চলের নিরাপত্তা আমরাই নিশ্চিত করবো।
– এরপর মূনকিডের নেতৃত্বে তারা যুদ্ধের রূপরেখা তৈরিতে মনোযোগি হয়ে উঠলো।
————
– পরিকল্পনা তৈরির পর মূনকিড তাদের উপস্থিতিতেই হিস্পানীয় সম্রাট চার্লস বরাবরে সাহায্য তলব করে দূত প্রেরণ করেন। তিনি তার দূতদেরকে এ ব্যাপারে পরামর্শ দেন তোমরা সাহায্য নিয়ে আসলে আমার এখানে না এসে আমাদের ডনমার্টন-এর অধীনস্ত পানুন দ্বীপে রেখে দেবে। প্রয়োজনে তিনি আমাদেরকে সে সব পৌঁছে দেবেন। সিদ্ধান্ত পাশ হবার পর আফ্রিকান নেতাদের ঐক্যমত দেখে মূনকিড এবং ডনমার্টন তুর্ক এবং বারবারুসা থেকে মোটামোটি নিশ্চিন্ত হয়ে যান।
– আফ্রিকান যৌথবাহিনী এবং হিস্পানীয়দের সম্মিলিত আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার নিমিত্তে খাইরুদ্দীন বারবারুসা তাঁর ক্ষতিগ্রস্ত নৌবহর আর সঙ্গী সাথীদের নিয়ে জিজল দ্বীপে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
– এক বিকেলে খাইরুদ্দীন তাঁর সাথীদের মধ্য থেকে সানআন আর সালেহকে নিয়ে সাগর উপকুলে বসে কি এক গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলেন। হঠাৎ পশ্চিম দিকে নজর পড়তে তিনি চমকে উঠলেন। দেখতে পেলেন এক অশ্বারোহী তার অশ্বটাকে যেন হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে তাঁদের দিকেই ছুটে আসছে। খাইরুদ্দীন দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর দেখাদেখি সানআন এবং সালেহও দাঁড়িয়ে গেলন। অশ্বারোহী যখন তাদের দৃষ্টি সীমায় চলে এলেন তখন খাইরুদ্দীনের চেহারায় আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল। সালেহ এবং সানআনের চেহারায়ও আনন্দের দ্যুতি খেলে গেল। আগত সেই অশ্বারোহী ছিলেন হাসান ক্রুসু।
– হাসান ক্রুসু তাঁদের কাছে এসেই লম্বা একটা লাফ মেরে ঘোড়া থেকে নেমে দ্রুত খাইরুদ্দীনের দিকে অগ্রসর হলেন। হাসান চাইছিলেন খাইরুদ্দীনের কদমবুছি করবেন। কিন্তু খাইরুদ্দীন তাঁকে ঈগলের ক্ষিপ্রতায় ঝাপটা মেরে বুকের সাথে মিলিয়ে নিতে নিতে বললেন: হাসান! তোমার স্থান এখানে নয় বরং ওখানে। তুমি আমার ছেলের বয়সী হলেও তোমার মর্যাদা আমার কাছে অনেক উর্ধে। তুমি আমার চয়নকৃত সাথীদের একজন।
– কথাটা বলে তাকে ছেড়ে দিতেই সালেহ এবং সানআনও পরপর তাকে তাকে বুকের সাথে মিলিয়ে নিলেন। কোলাকুলি পর্ব শেষ হবার পর খাইরুদ্দীন তাঁকে বললেন:
– হাসান! সবচেয়ে আনন্দের বিষয়টি হচ্ছে তুমি বড় প্রয়োজনের মুহূর্তে আমার কাছে এসে পৌঁছেছ। এই মুহূর্তে আমি তোমাদেরকে আমার কাছে চাইছিলাম। আমি কাকাদ আর খাজা সারা হাসান আগাকে তুর্কি খলীফা সেলিমের কাছে সাহায্যরে আবেদন জানিয়ে পাঠিয়েছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেখান থেকে আমি শক্তি ও সাহস বৃদ্ধিকারী জবাব পাব। যদি সে সাহায্য এসে পৌঁছায় তাহলে আমরা পর্যায়ক্রমে এখানকার সবগুলো দালাল আর শত্র“দের দেখে নেব। কাউকে ক্ষমা করবো না। মুসলমানদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ না করে আমাদের মিশন থামবে না ইন শা আল্লাহ।
– এবার বল! তুমি যে কাজে স্পেনে গিয়েছিলে তাতে কতটুকু সফলতা অর্জন করতে পেরেছো?
– মুহতারাম আমীর! আপনি জেনে খুশি হবেন, আমি যে মাকসাদ নিয়ে স্পেনে গিয়েছিলাম তাতে আমি শতভাগ সফলতা নিয়ে ফিরে এসেছি। আমি আফ্রিকায় নিহত হওয়া তাদের বিশপ লুইসের পুত্র লিসাঙ্কুর বেশে স্পেনে প্রবেশ করেছিলাম। এই পরিচয়ে আমি স্পেনের যে গির্জাতেই গেছি সেখানেই আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে। এতে ফায়দা হয়েছে এতটুকুই যে, গ্রানাডার সবগুলো বড় বড় গির্জা আমার দেখা হয়ে গেছে। সেখানকার সব পাদ্রীদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে এবং লিসাঙ্কুর পরিচয়ে সেখানে আমাকে যথেষ্ট সম্মানও দেখানো হয়েছে।
– আমীরে মুহতারাম! এ হলো আমার কাজের প্রথম সাফল্য। আমার আরেকটা সাফল্য হলোÑ আমি আল বাশারাত ওয়াদির শক্তিমান আদনানী ও কাহতানী কবীলা দুটোর নেতা সা‘দ বিন সালামা এবং কা‘ব বিন আমিরের সাথে সাক্ষাত করে এসেছি। তাঁরা আমাকে ওয়াদা দিয়েছেনÑ স্পেনের যেসব নির্যাতীত মুসলমান আফ্রিকায় হিজরত করতে প্রত্যাশী তাদেরকে খুঁজে তাঁরা নিজেদের ওয়াদিতে আশ্রয় দিয়ে গোপনে সাগর তীরের জেলে পল্লীতে পৌঁছিয়ে দেবেন। সেখান থেকে অতি সহজেই আমরা তাদেরকে উদ্ধার করে আফ্রিকায় নিয়ে আসতে পারবো।
– খাইরুদ্দীন বারবারুসা হাসানের কথা শুনে আনন্দে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন। তিনি নিজ জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে হাসান ক্রুসুর কাধ চাপড়িয়ে বললেন: মাশা আল্লাহ! সত্যিই তুমি তোমার মিশনে কামিয়াব। এবার বলো তুমি তোমার মা বোনের খুঁজ পেয়েছো? তোমার দাদার অবস্থা কী? প্রশ্ন দুটো হাসানকে উদাস করে তুলল। তাঁর মাথাটা অনেকখানি নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ল। তাঁর এ অবস্থা দেখে কেবল খাইরুদ্দীন নয়, সালেহ এবং সানআনকেও বিষন্নতায় পেয়ে বসল। হাসান ক্রুসু নিজেকে যথাসম্ভব সামলিয়ে নিয়ে ধরা গলায় বলতে লাগলেন:
– মুহতারাম! কিছুসংখ্যক লোক আমাকে এ ভুল ধারণা দিয়েছিল যে, যেহেতু তোমার মা ছিলেন স্পেনীয়, তাই খুব সম্ভব তারা নাসারানিয়াত কবুল করে কোনো গির্জায় অথবা কোনো ইবাদতখানায় বাকি জিন্দেগী কাটিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু আমার মা ও বোনকে তো আমি ভালো করেই জানি। তারা মরে যাবেন তথাপি কোনো অবস্থায়ই নাসারানিয়াত কবুল করবেন না। তারপরও আমি তাদেরকে স্পেনের প্রায় প্রতিটি গির্জা আর খানকায় তালাশ করেছি। এ ছাড়া যে সমস্ত মুসলমানদেরকে তারা জোরপূর্বক নাসারা বানিয়ে পৃথক জায়গায় রেখেছে আমি সে সব জায়গায়ও তাঁদের তালাশ করে ফিরেছি কিন্তু কোথাও তাদের খুঁজ পাইনি।
– আমীরে মুহতারাম! কিছুসংখ্যক মানুষের ধারণা— বিগত বছরগুলোতে আপনার ভাই উরুজের সময় নির্যাতিত সে সব স্পেনীয় মুসলমানদেরকে উদ্ধার করে বলকান এলাকার বসনিয়া হার্জেগোভিনা, কসোভো, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে আবাসিত করা হয়েছে, আমার মা ও বোন তাদের সে দলে থাকতে পারেন।
– কথাটা শুনে খাইরুদ্দীনের চেহারায় তিক্ত একটা হাসি প্রকাশ পেয়ে মিলিয়ে গেল।
– তিনি তাঁকে লক্ষ করে বললেন: এমন হলে তোমার চিন্তার দরকার নেই। তুমি নিশ্চিন্তে আমার এখানে কাজ করে যাও। শীঘ্রই আমি ওই এলাকায় একজন লোক পাঠাবো। যে বলকানের প্রতিটি ঘরে ঘরে তোমার মা বোনকে খুঁজে ফিরবে। এবার তোমার দাদার ব্যাপারে কিছু বল!
– হাসান আবার উদাস হয়ে পড়লেন। বললেন: দাদা আমার সাথে আগের মতোই কঠিন ব্যবহার করেছেন। তিনি তাঁর সেই সিদ্ধান্তেই অটল যে, যতদিন আমি মা বোনকে খুঁজে বের করতে পারছি না ততদিন যেন তাঁর সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা না করি। নতুবা তিনি লোহার শিক গরম করে আমাকে দাগিয়ে দেবেন। তাই আমি আমার কাজ সমাপ্তির পর তাঁর সাথে সাক্ষাত না করেই সোজা আপনার কাছে চলে এসেছি।
– হাসান ক্রুসুর কথা শুনে খাইরুদ্দীন বারবারুসার চেহারাও দুঃখবোধে ম্লান হয়ে উঠলো। তিনি গভীর হামর্দির সাথে কতক্ষণ তাকিয়ে একসময় তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে সাহস যুগিয়ে বলে যেতে লাগলেন:
– হাসান! আমার আজীজ! ভয়ঙ্কর আঁধারঘেরা রাতে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটায় সময়ের ঘড়ি ভিন্ন দিকে ঘুরে যায়, চিন্তার স্থিরতা, ওষ্টের লালিমা, চেহারার মুচকিহাসিরা হারিয়ে গিয়ে অন্তরে আতঙ্ক, ওষ্টে শৈত্যের অমসৃন খসখসে ভাব এবং চেহারায় অস্থিরতার চিহ্ন� ফুটিয়ে তুলে; তথাপি সে কঠিন বিপদও মানুষের কাছ থেকে তার স্বভাবজাত ভালোলাগা ছিনিয়ে নিতে পারে না।
– তুমি তো তোমার জীবনের বাল্যকালের বিছানা ঘুটিয়ে নিয়েছো। এখন তোমার জীবনের কন্ঠকাকীর্ণ বাগানে হাস্যরসে মাতাল যৌবনের আগমন। অতএব সময় এখন পাল্টে যেতে বাধ্য। এটা লিখে রাখতে পার! প্রতিদিন দুপুরের তীব্র দাবদাহ কামারের হাফরের মতো শরীর ঝলসায় না। প্রতিদিন মরুর বালিতে মরিচিকা নেচে খেলে না। অতি শীঘ্রই আমাদের আশপাশে মৌজের আকারে ফুঁসে ওঠা বদবখতি, আকাশের ঘনকালো সাজের রঙ ছেড়ে রঙধনুর রাঙা আলোয় ঝলমলিয়ে উঠবে। আমাদের চাদরে আমাদের জামায় সৌভাগ্যের শবনম ঝরতে থাকবে। সেদিন আমরা সময় এবং আমাদের শত্র“দের চোখে চোখ রেখে কথা বলব। তাদের থেকে আমাদের হিসাব কিতাব উসল করে ছাড়ব।
– এ টুকু বলার পর খাইরুদ্দীন বারবারুসা থামলেন। এরপর হাসান ক্রুসুকে বুক থেকে ছেড়ে দিয়ে তাঁর কাঁধ চাপড়িয়ে বললেন:
– এবার যাও! অবশ্যই তুমি ক্লান্ত। খিমায় গিয়ে বিশ্রাম কর। সে সাথে সানআনকে লক্ষ করে বললেন: সানআন! তুমি হাসানকে নিয়ে যাও! তাঁর জন্য বিশ্রামের আয়োজন কর। সানআন হাসানের হাত ধরে খিমার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন।