মুফতি জিয়াউর রহমান :
কোয়ান্টাম মেথড তথা মেডিটেশন পদ্ধতিটি মনোবিজ্ঞানের এক উদ্ভট থিওরি৷ ইসলামের ছিটেফোঁটা না পাওয়া এসব বৈজ্ঞানিকরা জানেই না ইসলামে উৎকৃষ্ট মনোবিজ্ঞানের কার্যকর মেডিটেশন পদ্ধতি রয়েছে, যা নিমিষেই আমাদের মন ভালো করে দিতে সক্ষম৷ আল্লাহর ধ্যান, সৃষ্টির প্রতি গভীর নযরে তাকানো, আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনের প্রতি গভীর ধ্যানমগ্ন হওয়া মেডিটেশনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ৷ যেখানে কোনো কোর্স লাগে না, টাকা-পয়সা কিছুই লাগে না৷ অথচ তাদের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া লোকগুলোকে ধ্যানের নামে খেয়ালী পোলাও খাওয়ানো পর্যন্তই তাদের ক্ষমতার দৌড়৷ ইসলাম মানুষকে শুধু কল্পিত সুখের উপর নিবিষ্ট করেই তার কাজ শেষ করে না, বরং দুনিয়াতে বাস্তবিক সুখ-শান্তির নিশ্চয়তা দেয়ার পাশাপাশি পরকালীন অভাবনীয় চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির চিরন্তন নীড় জান্নাতের বাসিন্দা বানিয়েই তবে ক্ষান্ত হয়৷ বর্তমান আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম মেথড তথা মেডিটেশন পদ্ধতি ইসলাম সম্মত নয় বিবিধ কারণে। শুধু ‘ইসলাম সম্মত নয়’ বললে কম হবে৷ কোয়ান্টাম মেথড মানুষের ঈমান ধ্বংসের এক দাজ্জালীয় ফর্মুলা৷ ১৯৯৩ সালের ৭ জানুয়ারী বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কোয়ান্টাম মেডিটেশন চালু করে জ্যোতিষী শহীদ আল বোখারী (আসল নাম অজ্ঞাত)।
এরপর গত দুই যুগে লাখ লাখ মানুষকে কোয়ান্টামের অনুসারী বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিনিময়ে সে তাদের উপহার দিয়েছে ইসলামবিরোধী কুফরী আকীদা। কোয়ান্টামের আকীদায় এতই বিচ্যুতি যে, এই স্বল্প পরিসরে সবগুলো বলা সম্ভব নয়৷ এখানে সংক্ষেপে তাদের প্রধান আকীদাগুলো কেন কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক তা আলোচনা করব: এক. সকল শক্তির উৎস কে: কোয়ান্টাম কোর্স করতে প্রথমে যে প্রত্যয়ন পাঠ করতে হয়, তার শুরুতেই লেখা, “অসীম শক্তির অধিকারী আমার মন, যা চাই তাই পাব, যা চাই তাই নেব।” তাদের ‘সাফল্যের চাবিকাঠি কোয়ান্টাম মেথড’ বইটির ভূমিকাতে লিখা আছে, “মেডিটেশনের মাধ্যমেই আপনি সংযোগ সাধন করতে পারেন আপনার অন্তরের আমির সাথে, আপনার শক্তির মূল উৎসের সাথে।” (নাউযুবিল্লাহ)
এই কুফরি আকীদা সরাসরি কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক। কুরআনে আল্লাহতালা বলেন সকল ক্ষমতার উৎস আল্লাহ। তিনি চাইলে হয়, না চাইলে হয় না। (সূরা নিসা: ১২৬, সূরা আত তাকভীর: ২৯, সূরা আন নাজম: ২৫-২৫ দ্রষ্টব্য)
দুই. তাকদীর অস্বীকার: ঈমানের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, তাকদীরে বিশ্বাস করা৷ অথচ কোয়ান্টামে তাকদীর তথা ভাগ্যের লিখনীকে অস্বীকার করা হয়েছে। একই বইয়ের প্রথম অধ্যায়েই সার্কাসের হাতির উদাহারণ দিয়ে বলা হয়েছে, বন্য হাতির বাচ্চাকে ৬ ফুট শিকলে বেধে রাখার ফলে সে ঐ শিকলকেই নিজের নিয়তি মনে করে।বড় হয়ে শিকল না থাকলেও পালায় না। এমনকি সার্কাসে আগুন লাগলেও পুড়ে মরে যায়। তাদের ভাষায়, “মনোজাগতিক নিয়তির শৃঙ্খল তাকে পরিণত করে এক অসহায় প্রাণীতে।” এখানে তাকদীরকে ভ্রান্ত বিশ্বাস ও মনোজাগতিক শৃঙ্খল আখ্যা দিয়ে তা থেকে মুক্ত হতে বলা হয়েছে। এটি সরাসরি কুফরি। ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক৷
তিন. সকল ধর্ম গ্রহণযোগ্য: কোয়ান্টামের মতে সকল ধর্মের শিক্ষা এক, কাজেই যে কোনো ধর্ম পালনই যথেষ্ট এবং সকল ধর্মই গ্রহণযোগ্য। (কোয়ান্টাম উচ্ছ্বাস পৃ- ৯) অথচ আল্লাহতালা বলেন,আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র ধর্ম হল ইসলাম। অন্য কোনো ধর্ম কস্মিনকালেও গ্রহণ করা হবে না (সূরা আলে ইমরান: ১৯, ৮৫)
চার. তাদের কমান্ড সেন্টার গায়েব জানে: অদৃশ্যের সংবাদ সম্পর্কে অবগত হওয়ার বিশ্বাস লালন করা, যা একমাত্র আল্লাহ তাআলার সিফাত৷ যেমন একটি ঘটনা বলা হয়েছে, ‘ছেলে কোলকাতায় গিয়েছে। দু’দিন কোন খবর নেই। বাবা কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট। মাগরিবের নামাজ পড়ে মেডিটেশন কমান্ড সেন্টারে গিয়ে ছেলের বর্তমান অবস্থা দেখার চেষ্টা করতেই কোলকাতার একটি সিনেমা হলের গেট ভেসে এল। ছেলে সিনেমা হলের গেটে ঢুকছে। বাবা ছেলেকে তার উদ্বেগের কথা জানালেন। বললেন শিগগীর ফোন করতে৷’ (সাফল্যের চাবিকাঠি কোয়ান্টাম মেথড পৃ: ২৪১) এমনিতরো উদ্ভট বহু গল্প তারা প্রচার করছে, যা ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক৷
পাঁচ. সর্বধর্ম সমন্বয়: কোয়ান্টাম সর্বধর্ম সমন্বয় দর্শনের প্রবক্তা তাই হিন্দু, খ্রীষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের অনেক আকীদা কোয়ান্টাম গ্রহণ করেছে। বৌদ্ধ ধর্মের বিশ্বাস হচ্ছে মানুষের আদি ও অন্ত নেই (ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ, পৃ: ৬৬০)। কোয়ান্টাম কণিকার ১৫ পৃষ্টায় বলা হয়েছে, “আপনি মহাজাগতিক মুসাফির, আপনার জন্ম বা মৃত্যু নেই।” একই পুস্তকের ২১ নং পাতায় লেখা আছে, প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় গ্রহ নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়৷ (নাউযুবিল্লাহ)
ছয়. মহাজাতক লোকটি একজন জ্যোতিষী এবং স্বঘোষিত সর্বদ্রষ্টা। ইসলামে জ্যোতিষশাস্ত্র এবং অতীন্দ্রিয় দর্শন হারাম। তাছাড়া নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যাক্তি কোন জ্যোতিষী বা ভবিষ্যদ্বক্তার কাছে গমন করল, এবং সে যা বলে তা-ই বিশ্বাস করল; সে মুহাম্মাদ (সা,) এর উপর অবতীর্ণ কিতাব ও ওহীকে অস্বীকার করল।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)। অপর এক হাদীসে বর্ণিত আছে, এরূপ ব্যক্তির ৪০ দিনের নামায কবুল হবে না।
সাত. মাটির ব্যাংকে শিরক: তাদের বহুল প্রচারিত লিফলেট ‘দুঃসময়ের বন্ধু মাটির ব্যাংক’ এ এক ব্যাক্তির গল্প লেখা আছে যে, মাটির ব্যাংকে ৫০০ টাকার নোট রেখে নিজের সন্তানের রোগ নিরাময় করে ফেলে। এখানে ধরে নেয়া হচ্ছে, মাটির ব্যাংকে দান মানুষের কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারে, অথচ ইসলামী শিক্ষা হল কল্যাণ একমাত্র আল্লাহ পাকের কাছ থেকেই আসে, আর কারও জন্য কোন ক্ষতি নির্ধারিত হলে সেটাও একমাত্র আল্লাহতাআলার নিয়ন্ত্রণে, আল্লাহর সাথে এতে কোন অংশীদার নেই।
আট. মরার পরও পুনর্জন্ম লাভ করার ভ্রান্ত বিশ্বাস লালন করা, যা ইসলামী আকীদার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক৷ তাদের প্রচার অনুযায়ী বাংলাদেশে ফলিত মনোবিজ্ঞানের পথিকৃৎ এবং আত্মউন্নয়নে ধ্যান-পদ্ধতির প্রবর্তক প্রফেসর এম.ইউ. আহমাদ নাকি ক্লিনিক্যালি ডেড হওয়ার পরেও পুনরায় জীবন লাভ করেন শুধু ‘তাঁকে বাঁচতে হবে, তিনি ছাড়া দেশে নির্ভরযোগ্য মনোচিকিৎসক নেই’ তাঁর এই দৃঢ় বিশ্বাসের জোরে’ (মহাজাতক, কোয়ান্টাম টেক্সট বুক, জানু. ২০০০, পৃঃ ২২-২৪)। অর্থাৎ হায়াত-মউতের মালিক তিনি নিজেই৷ (নাউযুবিল্লাহ) অথচ হায়াত-মউতের মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা৷ এর ব্যতিক্রম বিশ্বাস করলে তার ঈমান চলে যাবে৷
এ তো গেলো আকীদাগত বিচ্যুতির পর্যালোচনা৷ আমলী বিচ্যুতির তো আর কোনো সীমা-পরিসীমাই নেই৷ পর্দা লংঘন৷ ইসলামে নামায, রোযা যেমন ফরয; ঠিক একই মানের ফরয হল পর্দা করা। তাই যেখানে নারী পুরুষের পর্দা করা সম্ভব নয়, সেসব স্থানে নিরূপায় অবস্থা ছাড়া যাওয়া জায়েজ নয়। সে হিসেবেও এসব কোর্সের ভর্তি হওয়া শরীয়তে অনুমোদিত নয়।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন-
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَزْكَىٰ لَهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ. (سورةالنور ٣٠)
“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।” (সূরা আন-নূর ৩০)
দুই. গান- বাজনার বাধ্যতামূলক ব্যবহার৷ বাজনাসহ গান-বাদ্য সম্পূর্ণ হারাম। তাই মেডিটেশন করতে গিয়ে এসব করা কিছুতেই জায়েজ হবে না।
وَاسْتِمَاعُ ضَرْبِ الدُّفِّ وَالْمِزْمَارِ وَغَيْرِ ذَلِكَ حَرَامٌ وَإِنْ سَمِعَ بَغْتَةً يَكُونُ مَعْذُورًا وَيَجِبُ أَنْ يَجْتَهِدَ أَنْ لَا يَسْمَعَ قُهُسْتَانِيٌّ )رد المحتار–كِتَابُ الْحَظْرِ وَالْإِبَاحَة–فَصْلٌ فِي الْبَيْعِ
“অর্থাৎ দফের বাজনা ও বাঁশির আওয়াজ এবং এ জাতীয় বিষয় শোনা হারাম, আর যদি আচমকা শোনে ফেলে তবে তাকে মাজুর ধরা হবে। আর চেষ্টা করবে যেন তা না শুনতে পায়।” {ফাতওয়ায়ে শামী}
মোটকথা কোয়ান্টাম মেথড তথা মেডিটেশন থিওরি হচ্ছে, মানুষের ঈমান-আকীদা ধ্বংসের এক আকর্ষণীয় ও চটকদার প্রকল্প৷ পাশাপাশি পূঁজি ছাড়া কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার এক ইন্দ্রজালিক কৌশল৷ কোনো মুসলমান এতসব আকীদাগত সমস্যা জানা সত্ত্বেও ঈমান লুটের এসব দাজ্জালী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কখনোই জড়িত হতে পারে না৷